৫৭ তম পর্ব–
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া -১৬।
একজন কৃষকের কাছ থেকে কৌশলে ঋণ আদায়ের ঘটনা আমাকে এখনও পীড়া দেয়। হেড অফিসের স্যার আমাদের আদায়ের টার্গেট দিয়ে সে সপ্তাহে ঢাকায় গেছেন । আমরা কৃষিঋণ আদায়ের জন্য ফিল্ডে গেছি। খালি গা , মুখে সামান্য দাঁড়ি,-চিরুনী না পড়ায় সে দাঁড়িও বাঁকা হয়ে গিয়েছে , লুঙ্গি হাটুর উপর তোলা কালো –বেঁটে - খাটো ঋণগ্রহীতা এক কৃষককে রন্জু তার বাড়ী থেকে ডেকে আমার সামনে আনলো। মনে হয়, তার আড়াই হাজার টাকা ঋণ ছিল । তাগাদা প্রদানের এক পর্যায়ে রন্জু সেই ঋণগ্রহীতাকে বললো ঋণ শোধ না দিলে ব্যাংক মামলা করবে। থানা থেকে পুলিশ এসে কোমরে দড়ি বেঁধে আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে। তখন কেমন হবে ? জেলে হাফ-প্যান্ট পরে থাকতে হবে। পারবেন ? কৃষকটি মাটির দিকে মুখ দিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলো। কোন কথা বলে না। রন্জু আবার মামলার পরিনতি স্মরণ করে দিল। তবুও মুখে কোন কথা নাই। শুধু কোমর থেকে গামছা খুলে চোখ মুছতে লাগলো। চোখ মুছার দৃশ্য দেখে আমাদেরও খারাপ লাগলো । আমরা তার কাছ থেকে কোন কমিন্টমেন্ট না পেয়ে অন্যদিকে চলে গেলাম। বিকেলে মোটর সাইকেলে আবার ঐ পথেই ফিরছিলাম। রন্জু পীছনে বসা। একস্থানে দেখলাম ঐ কৃষকটি দাঁড়িয়ে আছে। হাত ইশারায় সে আমাদের থামতেও বলছে। থামলাম। থামতেই লোকটি সোজা এসে রন্জুর হাত চেপে ধরলো। বললো –বাপজান, হামি কয়দিন আগে হামার বেটিকে বিয়ে দিছি। তোমরা মামলা করলে হামাক যদি পুলিশ কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে লিয়ে যায় তবে হামি আর সমাজে মুখ দেখাতে পারমু না। হামি জীবনে হাফ-প্যান্ট পিন্দি নি –ক্যামনে পিন্দিতে হয় কবার পারিনা। মামলা করা হবে না বাপজান। হামার এগডা দুধের গাই আছে। সামনের হাটে বেঁচে লুন শুধ দিমু। সে কথা রেখেছিল । লোন শোধ দিয়েছিল । তবে তার কয়েক মাস পরেই সরকার ৫০০০ টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণ সুদাসলে মওকুফ করে দিয়েছিল। বাং বাং
বাংলাদেশে আরো কয়েকবার কৃষি ঋণ মওকুফ করা হয়েছিল। কৃষি ঋণ মওকুফ করার অনেক পুরোনো নজিরও আছে। ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্বব আইন সংশোধন করে ১৯২৮ সালের পূর্বে বন্ধকি সূত্রে সৃষ্ট সকল দেনা বাতিল বলে ঘোষণা করেছিলেন বৃটিশ সরকার।
কৃষি ঋণ আদায়ের বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে আজ আমার ঈমান আলীর কথা ভীষন ভাবে মনে পড়ছে। শুনলাম জয়ন্তী বাড়ী গ্রামের এই ঈমান আলী একাই নামে বেনামে ৭/৮টি ঋণ নিয়েছে। তাকে একদিন ব্যাংকে আসতে বলায় সে ব্যাংকে এসে আমার সামনে বসে তার করুন কাহিনী শোনাল।
তার বাপ-চাচারা ৪ ভাই। তার মধ্যে ৩ ভাই নিঃসন্তান। অন্য ভাইয়ের একমাত্র সন্তান ঈমান আলী। একপর্যায়ে সে তার বাপ-চাচার সমুদয় সম্পত্তির মালিক হয়। বিয়ের পর বাবাও মারা যায়। জোটে অনেক শুভাকাঙ্খী । তথাকথিত এসব শুভাকাঙ্খীদের উৎসাহে ঈমান আলী জুয়াতে আসক্ত হয়ে পড়ে। ফসল উঠলে অনেক টাকা হাতে আসতো। জুয়াতে সব শেষ। তখন শুভাকাঙ্খীরা তাকে চড়া সুদে ঋন দিতে শুরু করে। সুদাসলে ঋন শোধ করতে জমি বিক্রি শুরু করে ঈমান আলী। সে একটা দুষ্ট চক্রে পড়ে যায়। ফসল উঠে , হাতে টাকা আসে ,জুয়া খেলে , হাতের টাকা শেষ হয় , ঋণ নেয় ,জুয়া খেলে , হাতের টাকা শেষ হয় , জমি বিক্রীকরে ঋণ শোধ দেয় আর জুয়া খেলে। অনেকক্ষণ ধরে সে তার দুঃখের কথা বলছিল। এক পর্যায়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম, ঈমান আলী আপনি জীবনে অনেক ভুল করেছেন। ঈমান আলী জানালো ভুল একটাই তার। বন্ধুদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে জুয়া খেলা। সে যদি শুধু জমি বিক্রি করে জুয়া খেলতো এতদিনেও তার জমি বেচা শেষ হতো না।
কথা বলার ফাঁকে তাকিয়ে দেখলাম লম্বা-কালো ধরনের ঈমান আলীর চোখ-মুখ কেন জানিনা খুব মায়াবী। সরল সরল ভাব। স্পষ্ট মনে পড়ছে নীচে বড় বড় পকেটওয়ালা কড়া বেগুনী রংয়ের হাফহাতা শার্ট গায়ে দেয়া ঈমান আলীকে কেন জানিনা আমার তখন নবাব সিরাজদৌলা ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছিল। আর ঐ শুভাকাঙ্খীদের মীরজাফর-জগৎ শেঠ।অখ্যাত এক গ্রামের ততোধিক অখ্যাত এক ঈমান আলীর চোখের গভীরে তাকিয়ে আমি যেন বাংলার কৃষকদের বঞ্চনার ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম।
উনিশ শতকের শেষদিকে গ্রামীণ মহাজন, কাবুলিওয়ালা, জোতদার, সাহা, বেনিয়া, তেলি ও অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতারা গ্রামাঞ্চলে যেসব সাধারণ ও কৃষিঋণ দিত সেগুলির সুদের হার ছিল বার্ষিক ২৫% থেকে ৪০%।
একজন কৃষকের কাছ থেকে কৌশলে ঋণ আদায়ের ঘটনা আমাকে এখনও পীড়া দেয়। হেড অফিসের স্যার আমাদের আদায়ের টার্গেট দিয়ে সে সপ্তাহে ঢাকায় গেছেন । আমরা কৃষিঋণ আদায়ের জন্য ফিল্ডে গেছি। খালি গা , মুখে সামান্য দাঁড়ি,-চিরুনী না পড়ায় সে দাঁড়িও বাঁকা হয়ে গিয়েছে , লুঙ্গি হাটুর উপর তোলা কালো –বেঁটে - খাটো ঋণগ্রহীতা এক কৃষককে রন্জু তার বাড়ী থেকে ডেকে আমার সামনে আনলো। মনে হয়, তার আড়াই হাজার টাকা ঋণ ছিল । তাগাদা প্রদানের এক পর্যায়ে রন্জু সেই ঋণগ্রহীতাকে বললো ঋণ শোধ না দিলে ব্যাংক মামলা করবে। থানা থেকে পুলিশ এসে কোমরে দড়ি বেঁধে আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে। তখন কেমন হবে ? জেলে হাফ-প্যান্ট পরে থাকতে হবে। পারবেন ? কৃষকটি মাটির দিকে মুখ দিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলো। কোন কথা বলে না। রন্জু আবার মামলার পরিনতি স্মরণ করে দিল। তবুও মুখে কোন কথা নাই। শুধু কোমর থেকে গামছা খুলে চোখ মুছতে লাগলো। চোখ মুছার দৃশ্য দেখে আমাদেরও খারাপ লাগলো । আমরা তার কাছ থেকে কোন কমিন্টমেন্ট না পেয়ে অন্যদিকে চলে গেলাম। বিকেলে মোটর সাইকেলে আবার ঐ পথেই ফিরছিলাম। রন্জু পীছনে বসা। একস্থানে দেখলাম ঐ কৃষকটি দাঁড়িয়ে আছে। হাত ইশারায় সে আমাদের থামতেও বলছে। থামলাম। থামতেই লোকটি সোজা এসে রন্জুর হাত চেপে ধরলো। বললো –বাপজান, হামি কয়দিন আগে হামার বেটিকে বিয়ে দিছি। তোমরা মামলা করলে হামাক যদি পুলিশ কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে লিয়ে যায় তবে হামি আর সমাজে মুখ দেখাতে পারমু না। হামি জীবনে হাফ-প্যান্ট পিন্দি নি –ক্যামনে পিন্দিতে হয় কবার পারিনা। মামলা করা হবে না বাপজান। হামার এগডা দুধের গাই আছে। সামনের হাটে বেঁচে লুন শোধ দিমু। সে কথা রেখেছিল । লোন শোধ দিয়েছিল । তবে তার কয়েক মাস পরেই সরকার ৫০০০ টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণ সুদাসলে মওকুফ করে দিয়েছিল।
ঈমান আলী যখন ঋণ নিয়েছিল গ্রামে তখন সুদের হিসাব হতো সাপ্তাহিক ভিত্তিতে প্রতি হাজারে। দশ টাকা ধার দিয়ে সপ্তাহে এক টাকা করে সুদ দিত অসহায় সহায় সম্বলহীন মানুষ।
তাই গ্রামীন মহাজনের চড়া সুদের কারনে ঈমান আলীর নিঃস্ব হবার কাহিনী আমার বিশ্বাস হলো।
সবইতো বুঝলাম, কিন্তু ঈমান আলীর ঋণতো শোধ দিতে হবে। সে জানালো এখনও বসত বাড়ী সংলগ্ন এক টুকরো দামী জমি আছে তার। সেটা বিক্রি করে ঋণ শোধ দিবে মর্মে সে কথা দিল।
ঈমান আলী কথা রেখেছিল।
অন্যরকম একটি ঘটনাও মনে পড়ছে আজ। সে সময় জেলায় জেলায় জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে বিশেষ কৃষি ঋন কমিটি ছিল। কমিটির এক সভায় সিদ্ধান্ত হলো কৃষি ঋনের আদায় বাড়ানোর জন্য ব্যাংক ম্যানেজার কর্তৃক পুলিশের সহায়তা নিতে হবে। পিডিআর অ্যাক্টয়ের আওতায় দায়েরকৃত সার্টিফিকেট মামলার বিপরীতে পুলিশের সহায়তা নিয়ে দু’একজন গ্রেফতার হলে আদায় বাড়বে। জোনাল হেডের অব্যাহত তাগাদার প্রেক্ষিতে অনেক কষ্টে থানায় রাজী করানো হলো যে একজন ব্যাংক কর্মীর সাথে দুজন পুলিশ যাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত শৈলধুবড়ী গ্রামে। কারন ঐ গ্রামেই তথাকথিত ব্যাংকের দায়েরকৃত সার্টিফিকেট মামলার আসামী বেশী। দু জন পুলিশের সাথে সাইকেল নিয়ে রঞ্জু সকাল সকাল রওনা দিল দুর্গম শৈলধুবড়ী গ্রামে। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো কিন্তু তাদের ফেরার নাম-গন্ধ নেই। অবশেষে রাত ৮টা কি ৯ টার দিকে তারা আসলো।
তার কাছ থেকে শুনলাম এক লোমহর্ষক কাহিনী। এক বাড়ীর বৈঠকখানায় বসে যখন আসামী ধরার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল তখন হঠাৎ এক আসামী এক পুলিশের লাঠি নিয়ে দৌড় দেয়। তাকে আর ধরা সম্ভব হয় নাই। ও দিকে থানায় পুলিশের এ লাঠি জমা দিতে হবে। এ পর্যায়ে পুলিশেরা আসামী ধরার পরিবর্তে লাঠি খোঁজার কাজেই বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যায়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও গন্য মান্য ব্যাক্তিদের মধ্যস্থতায় সন্ধ্যার পর লাঠি ফেরৎ পাওয়া যায়।
থানার পুলিশ আর কোনওদিন ঋণ আদায়ে এ অঞ্চলে আসতে রাজী হয় নাই।
আমি যখন কৃষি ঋণ আদায়ের এ সব অতীত স্মৃতি লিখছি তখন প্রতিবেশী দেশ ভারতের একটা পরিসংখ্যান হঠাৎ নজরে আসে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে যত ঋণ মওকুফ কিংবা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, তার মাত্র ১৯ শতাংশ পেয়েছেন কৃষকরা। বাকি ৮১ শতাংশ পেয়েছেন দেশের তাবৎ শিল্পপতিরা। আমাদের দেশের এরুপ কোন পরিসংখ্যান আমার হাতে এখন নাই। আমাদের দেশে প্রতিবছর ব্যাংকগুলি কর্তৃক এখন প্রায় ২০-২২ হাজার কোটি টাকা কৃষি ঋণ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত থাকে। বর্তমানে সুদের হার অনেক কম। তবু আমি বলবো , কম সুদে ও সহজ শর্তে যদি এ বিপুল ঋণ বিতরণ করা হতো তবে গ্রামীন জনগণের অবস্থার আরো উন্নতি হতো। এন.জি.ও গুলো সম্পত্তি বন্ধক বা জামানত ছাড়াই সাপ্তাহিক কিস্তি ভিত্তিক ঋণ দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ সহজ পদ্ধতির এ ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এন.জি.ও গুলোর মাধ্যমে সহায় সম্বলহীন , জামানত প্রদানে অক্ষম অসহায় লোকজন উপকার যে পাচ্ছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। এন জি ও গুলোর কল্যানে গ্রামে ঋণ প্রাপ্তি বর্তমানে সহজ হলেও এ ঋণের জন্য ঋণগ্রহীতাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার পথ দিন দিন রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঋণ পরিশোধের চিন্তায় আরাম আয়েশ , বিনোদন,আনন্দ ভ্রমণ সবকিছু হারাম হয়ে যাচ্ছে। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু, বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী তাদের জীবন থেকে দিন দিন দুরে সরে যাচ্ছে। তাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী চিন্তা আর চিন্তা। সাপ্তাহিক কিস্তির চিন্তা।এন.জি.ও গুলোর সুদের হার ও পরিশো্ধ শর্ত পূর্বের তুলনায় এখন সহজ হলেও এখনও তা হত দরিদ্র্য মানুষের জন্য পুরাপুরি সহনীয় হয়ে উঠেছে বলে মনে হয় না। সুদের হার নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থার পুরাতন নজিরও আছে। মহাজন আইন ১৯৩৩ –এ বিধান ছিল যে জামানতি ঋণের ক্ষেত্রে ১৫%-এর অধিক এবং অজামানতি ঋণের ক্ষেত্রে ২০%-এর অধিক সুদ আরোপ করা হলে উদ্বৃত্ত সুদ অবৈধ বলে গণ্য হবে।
সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকগুলো যদি নামমাত্র সুদে সল্প পরিমান কিস্তির মধ্যম মেয়াদী পল্লী ঋণ দিত তবে মনে হয় তাদের অনেকেই এ দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তি পেত।
সরকার কর্তৃক ইতোমধ্যেই সুদের হার কমানো ও গ্রামে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে –সরকারী ভর্তুকীর মাধ্যমে হলেও এ হার আরো কমানো যায় কিনা , মেয়াদ বাড়িয়ে কিস্তির পরিমান ছোট করা যায় কিনা -তা ভেবে দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানাই।
একদিন হঠাৎ শোনা গেল ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ হোসেন স্যার বগুড়ায় আসবেন। (ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ১০:৫৯:৪৩ ৫২৬ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম