৪৯ তম কিস্তি—
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া ৯ম পর্ব।
ভাদ্র ও আশ্বিন মাস মিলে বাংলার শরৎ কাল । শরৎকে ইংরেজিতে “অটাম” বলা হলেও উত্তর আমেরিকায় একে “ফল” হিসেবে ডাকা হয়। পৃথিবীর ৪টি প্রধান ঋতুর একটি হচ্ছে শরৎকাল। সারা পৃথিবীতে শরৎকালের আগমন গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের মধ্যবর্তী ঋতু হিসেবে । এসময় রাত তাড়াতাড়ি আসে এবং আবহাওয়া ক্রমান্বয়ে ঠাণ্ডা হতে থাকে। শরতের স্নিগ্ধতা এক কথায় অসাধারণ। গ্রীস্ম ঋতুর প্রচন্ড দাবদাহের পর বর্ষা আসলে প্রথম প্রথম খুব ভাল লাগতো বর্ষা । কিন্তু অনেক সময় দেখতাম ক্যালেনডারে বর্ষাকাল চলে গেছে কিন্তু প্রকৃতিতে রয়ে গেছে , তখন বর্ষা বিরুক্তিকর মনে হতো। এরুপ পরিস্থিতে প্রকৃতিতে শরৎ কাল এলে আমার মনে নজরুলের সেই গানটি দোলা দিত-
শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ
এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই।
বকুল বনে এক্লা পাখি,
আকুল হ’ল ডাকি’ ডাকি’,
আমার প্রাণ থাকি’ থাকি’ তেমনি কেঁদে ওঠে সই।।
কবরীতে করবী ফুল পরিয়া প্রেমের গরবিনী
ঘুমায় বঁধু-বাহু পাশে, ঝিমায় দ্বারে নিশীথিনী।
ডাকে আমায় দূরের বাঁশি কেমনে আজ ঘরে রই।
কালিদাস ছিলেন সংস্কৃত ভাষার এক বিশিষ্ট কবি । মহাকবি কালিদাস ‘মেঘদূত’ কাব্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন I খ্রিষ্টীয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতাব্দীতে তার জন্ম ।মহাকবি কালিদাস শরৎ বন্দনায়ও ছিলেন অগ্রবর্তী। তিনি বলেন-“প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ, নব বধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎ কাল সমাগত প্রায়।’ কবি তার‘ঋতুসংহার’ কাব্যে শরৎকাল বিষয়ে লিখেছেন—‘কাশ ফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয় যার নূপুরের শব্দ, পাকা শালি ধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা, অপরূপ যার আকৃতি সেই নব বধূর মতো শরৎকাল আসে I” আজ থেকে দেড় হাজারেরও বেশী বছর আগে কবি কল্পনায় শরতের ও নারীর এই তুলনা দেখে বিস্ময়াভিভূত না হয়ে উপায় নেই।
তবে রবীন্দ্রনাথই তাঁর গান, কবিতার মাধ্যমে বাঙালীকে সর্বপ্রথম শরৎকাল উপভোগ করতে শিখিয়েছেন ৷ মুস্তফা মনোয়ার বলেন, ‘‘শরৎ যে এত সুন্দর আগে হয়ত বাঙালি জানতোও না ৷ রবীন্দ্রনাথই তাঁর গান, কবিতার মাধ্যমে সবাইকে শরৎকাল উপভোগ করতে শিখিয়েছেন ৷ তাঁর গানগুলো শুনলেই শরতের সমস্ত সৌন্দর্য ধরা পড়ে ৷”
শরৎকে কবি গুরু বরাবরই দেখেছেন শান্তি, মঙ্গল ও সমৃদ্ধির ঋতু হিসেবে। তিনি লিখেছেন—
‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ শেফালী ফুলের মালা
নবীন ধানের মঞ্জুরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা
এসো হে শারদ লক্ষ্মী তোমার শুভ্র মেঘের রথে
এসো চির নির্মল নীল পথে…’
রবীন্দ্রনাথ শরৎ- এর সকালকে এতটাই ভালবেসেছেন যে শারদ রাতের প্রভাতে তিনি তাঁর জীবনকাল শেষ করে পরের প্রজন্মের বা উত্তরসূরী কারও হাতে তাঁর বাঁশিটি দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই তো গেয়েছেন :-
আমার রাত পোহালো শারদ-বুকে/ বাঁশি-বাঁশি, তোমার দিয়ে যাবো/ কাহার হাতে।’
বাঙলার প্রকৃতিতে ঋতুর রানি শরৎ মানেই নদীর তীরে তীরে কাশফুলের সাদাহাসির প্লাবন। বর্ষার মাঝামাঝি থেকে শুরু করে শরৎকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত জাতীয় ফুল শাপলার দেখা মেলে। মাঠে মাঠে সবুজের মেলা। করতোয়া নদীর ধারদিয়ে যেতাম সাদা সাদা কাশফুল ফোটা দেখেই বুঝতাম প্রকৃতিতে শরৎ এসে গেছে। শরৎ -এ ক্ষেতে ক্ষেতে আমন ধানের চারা বাড়তে থাকতো। শরৎ কিন্তু ফসলের ঋতু নয় । ফসল পাকা বা কাটা এ ঋতুতে হয় না। প্রতীক্ষায় থাকে কৃষকেরা আসন্ন নবান্নের। কৃষি ঋণ এর আদায়ও এ সময় কমে যায়। সবাই বলে আমন ধান কাটার পর লোন শোধ দিব। ডেমাজানিতে অনেক হিন্দু পরিবার ছিল। পাল পাড়াও আছে এখানে। করতোয়ার বুকে যখন নৌকা চলত, তখন পালপাড়ায় তৈরি মাটির পাতিলের আগে প্রচুর কদর ছিল। প্রতিদিন নৌকায় ৪০ হাজার পাতিল যেত ময়মনসিংহে। এখন নদীতে পানি নেই। নৌকা চলে না। মাটির জিনিসেরও কদর নেই। পালেরা প্রায় বেকার। তখন দুর্গাপূজা বেশ ঘনঘটা করেই পালন হতো। এ সময় অফিসে কে যেন তালের বড়া নিয়ে এসে খাওয়াতো –আজ তার নাম আর স্মরণ করতে পারছি না।
বাংকে কারেন্ট থাকলেও আমাদের বাড়ীর এলাকায় তখনো কারেন্ট যায় নাই। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেংগে গেলে বাড়ীর বারান্দায় দাড়িঁয়ে মাঝে মাঝে চাঁদের আলো দেখতাম। বিদ্যুৎবিহিন শরৎ কালের রাতে জ্যোৎস্নার অপরূপ রুপ যে দেখে নাই তাকে ভাষা দিয়ে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নাই। মেঘ মুক্ত আকাশে যেন জ্যোৎস্নার ফুল ঝরতো। শরতের আকাশের মতো আকাশ আর কোনও ঋতুতে দেখা যায় না ।
বাংলার কবিরা শুধু শরৎ বন্দনাই করেছেন। এ সময়ের ভ্যাপসা গরম নিয়ে কোথাও তেমন বর্ণনা নাই। সুন্দরের পূজারী কবিদের তা করারও কথা নয়। কিন্তু বাংলার নন এসি জনতার কাছে ভাদ্রের ভ্যাপসা গরম চরম বিরুক্তির উদ্রেক ঘটায় । ভাদ্র মাসে শুরু হওয়া ভ্যাপসা গরম আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত থাকে। শরীর ঘেমে যায়। এই ঘাম না শুকালে গরম আরো বেশি অনুভূত হয়। অস্বস্তিও বাড়ে। বাঙালীদের আলোচনায় এ সময় আবহাওয়া নিয়ে কথা-বার্তা হঠাৎ বেড়ে যায়। একে অপরের সাথে দেখা হলে বলে আজকে যা ভ্যাপসা গরম পড়েছে –টেকাই দায়।
শরৎ আসলেই প্রকৃতি হেসে ওঠে। সেদিকে আজ আমাদের কারোরই যেন কোনই ভ্রুক্ষেপই নেই। শরৎকালের প্রকৃতি যখন কোমল-শান্ত-স্নিগ্ধ-উদার হয়ে উঠে আমরা তখন ফেসবুকে ডুবে থাকায় শরতের জোছনা ভরা চাঁদ দেখিনা। কাশবনের নয়নাভিরাম দৃশ্যে মুগ্ধ হওয়ার মত সময়ই তো নেই আমাদের হাতে। অপার সৌন্দর্য নিয়ে ঋতুর রাণী শরতে রকমারী ফুলে ফুলে ভরে যায় দেশের গ্রাম গঞ্জ- বন বাদার-নদীর চর। নদ-নদীর কিনারে কিনারে বালির চরে চরে হেসে ওঠে শুভ্র- সাদা কাশবন। প্রকৃতিতে শাপলা-শালুক-পদ্ম-জুঁই-শিউলি-কাশফুল-কেয়া–কামিনী-মালতি-মল্লিকা-মাধবি-ছাতিম -দোলনচাঁপা-বেলি-জারুল-নয়নতারা-ধুতরা-ঝিঙে-জবা–রাধুচূড়া-সহ নাম না জানা নানান ফুলে হেসে ওঠে। কিন্তু শহুরে বসে আমরা কতজন খোঁজ রেখেছি শরতের এই অপার সৌর্ন্দর্যে্য। বিজ্ঞানের স্রোতে স্রোতে ভাসতে ভাসতে আজ আমরা ভুলতে বসেছি শরতের রুপ-রস-রং হৃদয়ঙ্গম করার মানসিকতাও। ব্যস্ত জীবনে শরতের সৌন্দর্যের রুপের মুগ্ধতা থেকে হতে যাচ্ছি চিরবঞ্চিত।
জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে শরৎকালের সেই মাধুর্য এখন হয়তো তেমন আর একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। সময়ের বিবর্তনে গ্রামে-গঞ্জে কাশফুলের আধিক্যও কিছুটা কমে গেছে ৷ তবু আমি সবাই কে আহ্বান জানাবো প্রকৃতিতে শরৎ আসলে যদি সুযোগ থাকে তবে কাশফুল, গোধূলি , শিউলি আর জ্যোৎস্নার মাঝে হারিয়ে যেতে।(ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ২১:৪২:১৪ ৫৩০ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম