৪৩ তম কিস্তি—
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া-৩য় পর্ব।
সহকর্মীদের প্রতি ‘লুৎফর রহমান সরকার-এর মমত্ববোধ ছিল অসাধারণ। তিনি মনে করতেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে সকল দায় তার নিজের। মামলায় তার সহকর্মীদের জড়ানো প্রসঙ্গে তিনি সামরিক আদালতে বলেছেন “এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব আমার নিজের। আমার সহকর্মীদের যাদের এ মামলায় অহেতুক জড়িত করা হয়েছে তাদের কোনো দোষ বা দায়-দায়িত্ব নেই। একইভাবে আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোও অমূলক ও ভিত্তিহীন। আমি দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পারি, আমি কোথাও কোনো অনিয়ম করিনি বা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করিনি। যা কিছুই করেছি সম্পূর্ণ সদিচ্ছা নিয়েই করেছি এবং সম্পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিকভাবেই করেছি। ব্যাংকের ক্ষতি হয় বা দেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করা তো দূরের কথা, চিন্তার মধ্যেও কোনোদিন স্থান দেইনি। সারা জীবন ধরে শুধু মঙ্গল কামনা করেছি। মঙ্গলের জন্য সাধনা করেছি। মঙ্গলের জন্যই একাগ্রচিত্তে কাজ করছি। এর এতটুকু ব্যতিক্রম কোথাও আজও হতে দেইনি।”
তিনি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী ছিলেন । সেদিন বলেছিলেন- ”মহামান্য আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে আজ আমি দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পারি, এ আদালতের বিচারে আমার কি হবে জানিনে, তবে সময়ের বিচারে আমি অবশ্যই জয়ী হব। সে ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কারণ আমি জানি ন্যায় ও সত্যের পথে আছি এবং আমি যা করেছি তা দেশের বৃহত্তর কল্যাণ ও ব্যাংকের মঙ্গলকে সামনে রেখেই করেছি। আজ হোক কাল হোক সত্য ও ন্যায়ের জয় হবেই। মঙ্গল ও কল্যাণেরই জয় হবে- এ আমার গভীর অনুভূতি, দৃঢ় প্রত্যয় এবং আন্তরিক বিশ্বাস।”
দীর্ঘ ৮১ দিন কারাভোগের পর তিনি মুক্তিলাভ করেন।
শুধু মুনাফার জন্য ব্যাংকিং নয়, মানুষের কল্যাণে ব্যাংকিং –এ কথা তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তিনি সবাইকে তার চারিত্রিক ভালোবাসা দিয়ে মুগ্ধ করতেন। ব্যাংকিং খাতকে অধিকতর মানবিক করার প্রচেষ্টা ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। সর্বক্ষেত্রে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিায় তিনি ছিলেন সদা সচেষ্ট। ‘হাদীসের বাণী’ বইটির ভূমিকাতে লুৎফর রহমান সরকার লিখেছেন, ‘হাদীসের বাণী সংকলন করার কোনো যোগ্যতাই আমার নেই। তবু কেন এ কাজে হাত দিলাম? বর্তমানে তরুণ সমাজ যে হারে নৈতিক মূল্যবোধ থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে, তাতে দেশে একটা বিরাট মূল্যবোধের সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই তাদের নৈতিকতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের প্রজন্মের অনেক দায়িত্ব রয়েছে বলে আমি মনে করি। এই দায়িত্ব পালনের জন্যই মূলত এ ক্ষুদ্র সংকলেনে হাত দেয়া।’
আমাদের দেশে মৃত্যুর পর সন্মান দেখানো বা পুরস্কৃত করার একটা রেওয়াজ প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন পুরস্কারের তালিকায় মরণোত্তর শব্দটি সগৌরবে স্থান দখল করে নিয়েছে । জীবনবীমার পলিসি দাবী পরিশোধে মরণোত্তর শব্দটি মানানসই, কিন্তু গুণের স্বীকৃতি প্রদান কালে মরণোত্তর পদক কিন্তু বেমানান ঠেকে । তবে দেশমাতৃকার জন্য জীবনদানের বেলায় এটি অবশ্যই ঠিক আছে। বাঙালি সব কিছুতেই এখন এগিয়ে আছেন। কিন্তু গুণীজনদের স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে কেন তারা কুণ্ঠিত তা বোধগম্য নয়।
লুৎফর রহমান সরকার এর ভাগ্যে স্বীকৃত জাতীয় মরণোত্তর পুরস্কার জোটেনি। ব্যাংকাররা যে তাদের কর্মকান্ডের দ্বারা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে এবং তা নিয়মিত রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃত হলে ব্যাংকারগণ ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ হবেন –এ ধারনা এখনও প্রতিষ্টিত হয়নি। প্রতিষ্টিত হয়নি , তাতে কি হয়েছে ? এখনও তো শুরু করা যায়।
উল্লেখ্য অর্থনীতি ছাড়া অন্য বিষয়গুলোতে ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হলেও, অর্থনীতিতে পুরস্কার প্রদান শুরু হয় ১৯৬৯ সালে। আলফ্রেড নোবেল তার উইলে অর্থনীতির কথা উল্লেখ করেছিলেন না। কিন্তু পরবর্তীতে অর্থনীতির গুরুত্ব অনুধাবন করে এ বিষয়টিকেও নোবেল পুরুস্কারের আওতায় আনা হয়।
১৯৭৬ সালে প্রথমবার সাহিত্য, সাংবাদিকতা, শিক্ষা- এই তিনটি ক্যাটাগরিতে বিশেষ অবদানের জন্যে দেশের ৯ জন ব্যক্তিকে একুশে পদক দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ক্যাটাগরি বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ৯ টি ক্যাটাগরি নির্বাচিত হয়েছে। এগুলি হচ্ছে, (১) ভাষা আন্দোলন (২) মুক্তিযুদ্ধ (৩) ভাষা ও সাহিত্য (৪) শিল্পকলা (৫) শিক্ষা (৬) গবেষণা (৭) সাংবাদিকতা (৮) গণমাধ্যম ও (৯) সমাজসেবা। ক্যাটাগরি কি আর বাড়ানোর সুযোগ নাই?
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ,বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি,চিকিৎসাবিদ্যা,শিক্ষা,সাহিত্য,সংস্কৃতি,ক্রীড়া,পল্লী উন্নয়ন, সমাজসেবা/জনসেবা.জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, জনপ্রশাসন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ , সরকার কর্তৃক নির্ধারিত অন্য যে কোন ক্ষেত্রে- স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার দেয়া হয় । প্রায় প্রতি বছর কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য জীবিতদের পাশাপাশি মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়ার রীতিও আছে। এখানে ব্যাংকারদের বিবেচনার সুযোগ আছে বলে মনে হয়।
বিভিন্ন জাতীয় পদক প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের অন্তর্ভূক্তি এখন সময়ের দাবী।
দি ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (আইবিবি) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) যৌথভাবে লুৎফর রহমান সরকারকে ২০১০ সালে ডিসেম্বর মাসে রাজধানীর র্যা ডিসন হোটেলে সংবর্ধনা প্রদান করেছিলেন।
আশার কথা এই যে ,অনেক বিলম্বে হলেও লুৎফর রহমান সরকার তার স্মৃতিধন্য কর্ম ক্ষেত্রে বিপুলভাবে স্বীকৃত হয়েছেন।
লুৎফর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে দীর্ঘদিন খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স’ বিভাগে রয়েছে ‘এল আর সরকার চেয়ার প্রফেসর’।
তিনি ১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ১৯৯৮ সালের ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ষষ্ঠ গভর্নর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর লুৎফর রহমান সরকারের (এল আর সরকার) স্মৃতি ধরে রাখতে তাঁর নামে একটি লাউঞ্জ উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল ভবনের নির্বাহী ফ্লোরে (তৃতীয় তলা) ২০১৫ সালে লাউঞ্জটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান। ব্যাংকের মূল ভবনের নির্বাহী ফ্লোরে (তৃতীয় তলা) এই লাউঞ্জটি দেশের আধুনিক ব্যাংকিং খাতে অনুপ্রেরণা যোগাবে বলে কর্তৃপক্ষের আশা।
তিনি ১৯৭৬ সালে অগ্রণী ব্যাংকে মহাব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দিয়ে পরে ১৯৮৩ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান। অগ্রণী ব্যাংক ভবনের ৫ম তলা তার নামে (এল আর সরকার, এক্সিকিউটিভ ফ্লোর) নামকরণ করা হয়েছে। দরজার সামনে তার বিশাল ছবিও আছে।
সেই ১৯৮৩ সালে তিনি অগ্রণী ব্যাংক থেকে বদলী হয়ে গেছেন , তারপর শতশত নিবার্হী -কর্মকর্তা -কর্মচারীর পদভারে অগ্রণী ব্যাংক ভবনের লিফট- সিঁড়ি প্রকম্পিত হয়েছে , কিন্তু এল আর সরকার কে বিস্মৃতির আড়াল থেকে টেনে বের করার কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় নাই । অথচ তা তার প্রাপ্য ছিল। অবশেষে দেখা পাওয়া গেল তার এক যোগ্য উত্তরসূরীর। তিনি আর কেউ নয় অগ্রণী ব্যাংকের বর্তমান এমডি জনাব শামস্-উল ইসলাম। তিনি জাতির জনকের স্মৃতি অগ্রণীর বুকে ধারণ করার স্মারক নির্মাণ করে ইতোমধ্যেই কিংবদন্তীতূল্য উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গেছেন। তারই উদ্যেগে সুসজ্জিত হয়েছে অগ্রণী ব্যাংক ভবনের ৫ম তলার এক্সিকিউটিভ ফ্লোর এবং এ ফ্লোরের নামকরণ করেছেন তিনি এল আর সরকার, এক্সিকিউটিভ ফ্লোর । ফ্লোরে ঢোকার মুখেই সরকার সাহেবের বিশাল ছবিও আছে। সততা ও কর্মদক্ষতার প্রতীক লুৎফর রহমান সরকারকে প্রাপ্য সন্মান দিয়ে তিনি দেশের হাজার হাজার সচেতন ব্যাংক কর্মচারী ,কর্মকর্তা ও নিবার্হীদের সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। গুণীজনরাই গুণীজনকে মূল্যায়ন করেন । পরবর্তী প্রজন্মও যেন গুণীজনের সন্মাননা জানাতে পিছপা না হয়- তার সিগন্যাল তারা স্যারের এ উদ্যেগের মাধামে পেয়ে যাবে। এ সিগন্যাল খুবই জরুরী কারণ যে দেশে গুণীজনের সন্মান হয়না সেদেশে কখনো গুণী ব্যক্তি জন্মায় না ।
লুৎফর রহমান সরকারকে বাংলাদেশের ‘আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থা’র জনক বলে মত দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। বিচ্ছিন্ন কিছু পেশাগত বিড়ম্বনা আমলে না নিয়ে বলা যায় লুৎফর রহমান সরকার ছিলেন দেশের ব্যাংকিং অগ্রযাত্রার এক পথিকৃৎ। নানারূপ পৃষ্ঠপোষকতা ,আশীর্বাদ বা তদবীর নিয়ে দ্রুত উচ্চ থেকে উচ্চতর পদে পদোন্নতি নেবার প্রচেষ্টা দেশে আজ কালচারে পরিণত হতে চলেছে , কিন্তু লুৎফর রহমান সরকার ছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত। কর্মজীবনের শুরু থেকে প্রতিটা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে এবং নিয়মিত অধ্যবসায় ও সততার মাধ্যমে পেশাগত উৎকর্ষ সাধন করেই অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে।
১৯৫৬ সালে রেডিও পাকিস্তানের ব্রডকাস্টিং হাউজে মনিটরিং বিভাগে অ্যানালিস্ট হিসেবে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও ১৯৫৭ সালে করাচির তৎকালীন হাবিব ব্যাংকে অফিসার হিসেবে যোগ দিয়ে ব্যাংকে তার কর্মজীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে তদানিন্তন পাকিস্তানের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণরের দায়িত্ব পালন ছাড়াও পেশাগত জীবনে তিনটি ব্যাংকের (অগ্রণী, সোনালী ও প্রাইম) শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। রূপালী ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক ছিলেন। এছাড়াও তিনি ইসলামী এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংক তৈরির উদ্যোক্তা ছিলেন।
আমাদের দাবী, তাঁর কর্মকান্ডের স্মৃতি বিজড়িত অন্যান্য ব্যাংকও উদ্যোগ নিয়ে তাঁকে সন্মানিত করুক। এছাড়াও লুৎফর রহমানকে মনে রাখতে হলে তার সৃষ্টিকর্মকে একত্রিত করে নতুন প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে হবে। লুৎফর রহমানের ওপর স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করার উদ্যোগ নিতে হবে।(ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ২২:০২:৩৪ ৫১৯ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম