৪২ তম কিস্তি—
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া-২য় পর্ব।
‘বিকল্প’ প্রকল্প চালু করে লুৎফর রহমান সরকার গোটা দেশে আলোড়ন ফেলেছিলেন , কিন্তু এই প্রকল্পকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহৃত হতে দেননি বলে খোদ রাষ্ট্রপ্রধানের রোষানলে পড়ে যান তিনি। শেষ পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগে তাকে হাজির হতে হয়েছিল সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের সামনে । কিন্তু সেখানেও তিনি ছিলেন অনড় , আপোষহীন ও দৃঢ় । তাকে টলাতে পারেনি সে সময়ের সামরিক ট্রাইব্যুনাল। বরং নিজের অভিযোগের বিরুদ্ধে কাজী নজরুলের মত এক ‘জবানবন্দী’ পড়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন খোদ সামরিক ট্রাইব্যুনালকেই। নজরূল সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা ধূমকেতু ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে। নজরুলকে জেলে আটক করে রাখার পর তাঁর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি লিখিতভাবে আদালতে উপস্থাপন করেন চার পৃষ্ঠার বক্তব্য। পরবর্তীতে তা রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে খ্যাতি অর্জন করে। লুৎফর রহমান সরকারও সে দিনের সামরিক ট্রাইব্যুনালে এমনি একটি ‘জবানবন্দী’ পড়েছিলেন।
সামরিক আদালতে দাঁড়িয়ে সেই সত্যভাষণের পুরস্কার মিলেছিল , কারাদণ্ড। দীর্ঘ ৮১ দিন কারাভোগের পর কিছুদিন কর্মহীন কাটিয়ে তিনি যোগ দেন প্রথমে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডে চিফ অ্যাডভাইজার হিসেবে, এরপর প্রাইম ব্যাংক লিঃ-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে। দুটো ব্যাংককে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছেন লুৎফর রহমান সরকার তার অভিজ্ঞতা ,মেধা, প্রজ্ঞা, পরিকল্পনা আর কর্মকুশলতা দিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে চুক্তি শেষে চিফ অ্যাডভাইজার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের । বেসরকারি এই ব্যাংকটিকেও অত্যন্ত শক্ত খুঁটির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।
তার জীবনাদর্শের একটা পরিচয় পাওয়া যায় জেলখানা থেকে স্বজনদের কাছে লেখা তার এক চিঠিতে , ‘জীবন সরল রেখায় চলে না। জীবন পিচঢালা পথ নয়। জীবন চলে নদীর মতো এঁকেবেঁকে। জীবনে চড়াই-উৎরাই আছে, উত্থানপতন আছে। জীবনে সুখ যেমন আছে দুঃখও তেমনি আছে। এ জন্যই জীবন বিচিত্রময় আনন্দময়। শুধুই আনন্দ শুধুই সুখ, জীবনে অকল্পনীয় ব্যাপার। তাই সুখে যেমন আত্মহারা হতে নেই, তেমনি দুঃখেও ধৈর্যহারা হতে নেই।’
লুৎফর রহমান সরকার চিরকাল শিল্প, বাণিজ্য- সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সারা কর্মজীবনে যখনই সুযোগ এসেছে তখনই নামি, অনামি, চেনা-অচেনা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের উৎসাহ জুগিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি এক সময় বলেছিলেন , ‘আমার চাকরি জীবনে আমি আমার সাধ্যমতো সবসময় শিল্প, সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করার চেষ্টা করেছি। এ ব্যাপারে কাউকে ফিরিয়ে দিয়েছি বলে মনে পড়ে না।’
কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৩-৫-৮৬ তারিখে মেয়েকে লেখা তার চিঠির নীচের অংশ থেকে তার দার্শনিক মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
”শরীরটা একটা প্রাইভেট কারের মতো। এর রং কি সেটা বড় কথা নয়। একে কত যত্ন করে পরিচর্যা করে পরিপাটি পরিচ্ছন্ন রাখতে পার। তারই ওপর নির্ভর করে এর স্থায়িত্ব ও চলার ক্ষমতা। আমাদের শরীরটাও আমাদের মনের বা আত্মার বাহন। গাড়ি যেমন আস্তে আস্তে বুড়ো হয়, তখন এর চলার ক্ষমতা রহিত হয় এবং একদিন তা পরিত্যক্ত হয়, শরীরও ঠিক তেমনি। আত্মা অবিনশ্বর কিন্তু আত্মার বাহন নশ্বর, ভঙ্গুর। তবে যথাযথ পরিচর্যা ও যত্ন নিলে শরীর নামক বাহনটিও বহুদিন সুন্দর ও সচল থাকে।”
(ব্যাংকাররা শরীর চর্চার জন্য তেমন সময় পান না , আবার অনেকেই এ ব্যাপারে মনোযোগীও নন । আমি মনে করি তার এ লেখা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই শরীর চর্চায় এখন থেকে মনোযোগী হবেন।)
বই তার খুব প্রিয় ছিল। নিজের সংগ্রহেও অসংখ্য বই ছিল। সমৃদ্ধ পারিবারিক লাইব্রেরি গোটা পরিবারের জন্যসব সময় ছিল অফুরন্ত আনন্দের উৎস। সামরিক আদালতে জেলদণ্ড ঘোষণার পরপরই মেয়েদের ডেকে বলেছিলেন, ‘আমার পড়ার ঘরে টেবিলের ওপর কিছু বই রেখে এসেছি। বইগুলো পাঠিয়ে দিও’।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তার একটি বই তাঁকে উৎসর্গ করে লিখেছেন,লুৎফর রহমান সরকার ‘এই অন্ধকার সময়ে সততা ও মূল্যবোধের অন্যতম প্রদীপ ॥’
নিজে অসম্ভব ব্যস্ত জীবন পার করেছেন। কিন্তু নৈতিক মূল্যবোধ থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। তিনি বিশ্বাস করতেন নৈতিক মূল্যবোধ থেকে সরে গেলে তরুণ সমাজের বিপর্যয় অবসম্ভাবী। দেশকে তারা ঠেলে দেবে ভয়াবহ সঙ্কটের দিকে। নৈতিকতা হলো ব্যক্তির মৌলিক মানবীয় গুণ এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যা অর্জন করলে তার জীবন সুন্দর ও উন্নত হয়। তাই তাদের অনুপ্রেরণা দেবার জন্য সংকলিত করেছেন, ‘হাদীসের বাণী’, ‘বরণীয় জনের স্মরণীয় বাণী’ নামের দুটি প্রেরণামূলক বই।
তিনি সব সময় বলতেন, কখনো দিনের শেষ মুহূর্তে বা তাড়াহুড়ার মধ্যে ব্যাংকারদের কোনো কিছু অনুমোদন করতে নাই। তিনি আরো বলতেন ব্যাংকের চাকুরি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কেননা ব্যাংকারদের সব সময় এক পা জেলখানায় দিয়ে রাখতে হয়। তিনি সুদীর্ঘ কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে এসে দুর্ভাগ্যজনকভাবে জেল খেটে তার জীবদ্দশায় এ কথার সত্যতা প্রমাণ করে গেছেন । অবশ্য দুর্নীতি ব্যাংকিং নিয়মনীতির কোনোরূপ ভুলত্রুটি বা পেশাগত ব্যর্থতার কারণে তিনি জেলে যাননি, তাকে জেলে যেতে হয়েছিল অপ- রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে।
আপসহীন দৃঢ়তা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ঠ্য । কখনো কোনো চাপ বা হুমকির কাছে মাথা নত করেন নাই। সাময়িক আপসও করেন নাই। কোনো অন্যায় ক্ষমতার তোয়াক্কা করেন নাই । যেটা তার বিবেকে মনে হয়েছে ঠিক, সত্য- সে কাজেই এগিয়ে গেছেন। পেশাদারি জীবনে অনেক অন্যায় আবদার এসেছে, কিন্তু তিনি যেটা ভালো মনে করেছেন, দৃঢ়তার সাথে তাই করেছেন। কাউকে খুশি করার জন্য, তোষামোদ করার জন্য কিংবা কোন ব্যক্তিগত সুবিধা নেবার জন্য কখনই তিনি নিজের বিবেক বিবেচনাকে বিসর্জন দেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, ‘লুৎফর রহমান সরকার ছিলেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা ব্যাংকার, উদ্ভাবনী-সৃজনশীল ও গণমুখী ব্যাংকিংয়ের পথিকৃৎ। পেশাদারিত্বের এক অনুপম দৃষ্টান্ত হয়ে তিনি প্রায় ৫০ বছরের ব্যাংকিং পেশায় অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে দেশে আধুনিক ব্যাংকার সৃষ্টিতে নিরলস কাজ করে গেছেন।’ ড. আতিউর রহমান আরো বলেছেন, “ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন লুৎফর রহমান সরকার
, আর্থিক অর্ন্তভুক্তিমূলক কাজে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন তিনি। এছাড়া কৃষি, শিক্ষা, আত্মকর্মসংস্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করাসহ নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন তিনি।”
দেশের এ খ্যাতিমান লেখক ও প্রথিতযশা ব্যাংকার জীবনের শেষদিকে এসে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। তাকে তেমন কোনো লেখালেখি, টকশো ,বক্তৃতা বা আলাপ-আলোচনায় অংশ নিতে দেখা যায়নি। ব্যাংকিং খাতে সংঘটিত বিভিন্ন উত্থান-পতনের মধ্যেও তাকে কোনোরূপ মন্তব্য করতেও দেখা যায় নাই। সারা জীবন তিনি দেশের ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে নিবেদিত থাকলেও শেষ জীবনে সুখ-দুঃখ ও মান-অভিমানের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে নীরবে-নিভৃতে থেকেছেন। (ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ৯:১৫:৩৯ ৫০১ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম