৩৭ তম কিস্তি—
সেনানিবাস শাখা ,বগুড়া-৫ম পর্ব।
গালিগালাজ না করে শুধু গালিগালাজের হুমকী দিয়েও যে কাজ হয় - মাস কয়েক আগে এ বিষয়টা আমার নজরে আসে। নেতা গোছের একজন তার সাগরেদদের বলছিলো , এ কাজটি করবি নাকি সকাল বেলায় আমার মুখ খারাপ করাবি। সাগরেদদের একজন সাথে সাথে বলে উঠলো মুখ খারাপ করার দরকার নাই বস্ –আমরা দেখছি। পরে খবর নিয়ে শুনলাম কাজটি খুব দ্রুত হয়ে গেছে। বাহবা -বলে নিজে নিজেই হাততালি দিলাম। কি সুন্দর সিস্টেম । শুধু গালি গালাজের হুমকী দিয়েই কাজ হচ্ছে , গালিগালাজ করতে হচ্ছে না। একজন জানালো সব সময় যে সে সকাল বেলার কথা বলে এমন নয় দুপুরে হলে –ভর দুপুর বেলায় , সন্ধ্যায় হলে ভর সন্ধ্যা বেলায়-এরকম ভাবে সময় পরিবর্তন করে গালিগালাজের হুমকী দিয়ে কাজ আদায় করে ।
পদ্ধতিটি আমার খুব পছন্দ হলো। ভাবলাম মন্দ কি । অফিসেও তো কাজ আদায়ে গালিগালাজ না করে কেবল গালিগালাজের হুমকী দিয়ে কাজ আদায় করে নেয়া সম্ভব হতে পারে। চেষ্টা করতে দোষ কি ? আমার অফিসে এর প্রয়োগও শুরু করলাম। বেশ ভালই চলছিল। সকালে অফিসে যেয়ে যদি দেখতাম কারো আগের দিনের কোনও কাজ শেষ হয় নাই –তবে বলতাম কাজটি এখনই শেষ করবেন নাকি আজ এই সাত-সকাল বেলাতেই আমাকে মুখ খারাপ করতে হবে। অভিযুক্ত কর্মকর্তা সব সময় বলতো মুখ খারাপ করার দরকার নাই স্যার, ৫ মিনিটের মধ্যে কাজটি হয়ে যাবে। ৫ মিনিটের মধ্যে না হলেও আধা ঘণ্টার মধ্যে কাজটি হয়ে যেত । ভালই চলছিল। কিন্তু অযাচিত ভাবে একদিন একজন মহিলা কর্মকর্তা রান আউট করার অপচেষ্টা চালালো, কিছুদিন পর অন্য আর একজন- তিনিও মহিলা কর্মকর্তা সরাসরি বোল্ড করে দিল। কিন্তু তার আগেই আমি গালিগালাজের হুমকী দিয়ে কাজ আদায়ের সেন্চুরী করে ফেলেছি। তাই সবার সামনে আমার ব্যর্থতার সে দুটি গল্প বলতে তেমন সংকোচ লাগছে না। আফটার অল , সবাই এখন জানে আমি গালিগালাজ সহ খারাপ ব্যবহার প্রুফ । ভনিতা বাদ দিয়ে –সরাসরি ঘটনাতে চলে যাচ্ছি এখন।
আমাকে মুখ খারাপ করতে হবে , না কাজটি করবেন -আমি যখন এ কথা বলতাম তখন খেয়াল করতাম একজন মহিলা কর্মকর্তা বিস্ময়ের দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। রুমে সেদিন একা বসেছিলাম । সেসময় সে রুমে ঢুকে ছালাম না দিয়েই সরাসরি বলে উঠলো –
স্যার ,আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। কণ্ঠে তীব্রতা মেশানো সংকল্প ভাব । কিছুটা ভড়কে গেলেও তাকে বুঝতে দিলাম না । গলা মোটা করে বললাম-
-বলুন।
-স্যার সবাই আপনাকে অনেক ভাল জানে। এই যে আপনি ডেইলী বলেন মুখ খারাপ করবেন। মুখ খারাপ করবেন। এটি আর বলেন না স্যার ,প্লীজ ,খারাপ শোনা যায়। কণ্ঠে এবার মিনতির সুর।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বিষটি নিয়ে ভাবলাম। বুঝলাম আমাকে অপমান করার জন্য সে এসব কথা বলছে না। এও বুঝলাম যে, সে আমার ভাল চায় । তবু মুখ রক্ষার জন্য বললাম-
-আপনাকে তো এ কথা কোন দিন বলি নাই। এ কথা অন্য কোন মহিলাকে বলেছি বলেও তো মনে পড়েনা। আপনার কি এতে? হঠাৎ অযাচিত উপদেশে মনে হয় মন কিছুটা বিগড়েও গিয়েছিল। মুখ ফসকে অভ্যাস মোতাবেক বলে ফেললাম-আজ -আপনি –দেখছি- এই সাত সকালে- মুখটা—-
-থাক স্যার । ওসব বলতে নাই , আপনার মুখে মানায় না। আসি স্যার। চলে গেল। ভালই হলো, গায়ে পড়ে উপদেশ দিতে এসেছে। বেশী বোঝে !
মহিলাদের সচরাচর এমন কথা আমি বলতাম না। কিন্তু কাকতালীয় ভাবেই হোক আর দুর্বুদ্ধিতার কারনেই হোক বা অভ্যস্থ মুখ ফসকেই হোক কি যেন কি কাজে তাকে ঐ একই পদ্ধতিতে পর পর দুই দিন তাগাদা দিতে হল। ফলাফল অবশ্য ভাল –কাজটা তাড়াতাড়ি হল।
তবে কিছু দিন পরে সে এমন একটা কাজ ভুল করে বসলো যে তাকে রুমভরা লোকের সামনে উঁচু গলায় বলে বসলাম – এ টি কি আপনার কাজের ধরন ? আজ এই ভর দুপুরে সবার সামনে দেখছি সত্যিই মুখটি খারাপ করাবেন । উপস্থিত সবাই না না করতে লাগলো। মুখ খারাপের দরকার নাই।
কিন্তু সে চোয়াল শক্ত করে বলে বসলো- স্যার আপনি প্রায়ই মুখ খারাপ করার ভয় দেখাচ্ছেন। দেখি, আজ মুখ খারাপ করেন তো -দেখি কি হয় ? বলে কি ? এরকম পরীক্ষায় পড়বো কল্পনাতেও ভাবিনি। অপমানিত হবো নাকি ? না হতে হলো না –সামনে থেকে একজন ভদ্র মহিলাকে বললো – আপনি এখন যান তো । সে চলে গেল । আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম । কি মেয়েরে বাবা ! স্যারের মুখের উপর এত বড় কথা –সামনে বসা কে যেন মন্তব্য করে বসলো।
তার সামনে গালি-গালাজ করতে না পারার ব্যর্থতার পর সিদ্ধান্ত নিলাম এ কৌশল ছেড়ে দিব।
হঠাৎ ছোট বেলায় শোনা একটা গল্পের কথা মনে পড়লো । বাড়ীর পাশের করতোয়া নদীতে ব্রীজ হয়নি তখনো। নৌকার খেয়া পারাপারই ভরসা । খেয়া পারের টোল হিসাবে মোটামুটি সবাইকে সামান্য কিছু পয়সা দিতে হতো । স্থানীয়রা ছাড়া। স্থানীয়রা বাৎসরিক ভিত্তিতে বাঁশ বা ধান দিত। যে টোল আদায় করতো ওখানে -সে ছিল ন্যাংড়া। অন্যের সাহায্যে ছাড়া উঠতেই পারতো না। অপরিচিত কেউ কেউ টোল না দিয়ে মাঝে-মধ্যে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতো। আর আদায়কারী বয়স্ক ন্যাংড়া ব্যাক্তিটি তখন চিৎকার করে বলতো -থেমে যা। বলছি থেমে যা। দৌঁড়ে পালাবার চেষ্টা করিস না। আমি যদি উঠি -যদি উঠি তবে দৌঁড়ে তোকে ধরে ফেলবো কিন্তু। অনেকেই এতে থেমে যেত এবং এসে টোল দিয়ে যেত। অনেকে আবার দৌঁড়ে পালিয়েও যেত। সফলতা ১০০% না হলেও সে কিন্তু কৌশলটা ছাড়ে নাই। আমিও ভাবলাম-মুখ খারাপ করার হুমকীতে যখন কাজ হচ্ছে তখন একজনের জন্যে এ কৌশল ছাড়া উচিৎ হবে না। কৌশল চালাতে লাগলাম। দমাদম কাজও হতে লাগলো। আমাকে আবার সেসময় মোটিভেশনের উপর ক্লাশও নিতে হতো। তাই মোটিভেশনের অনেক নিয়ম-কানুন আমার জানা ছিল এবং নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারলে আমি মজা পেতাম। যদিও ঋণাত্বক তবু এটা একটা নতুন পদ্ধতি । তাই ‘মুখ খারাপ’ করার হুমকী চলতেই থাকলো। কাজও হতে লাগলো। আমিও মজা পেতে থাকলাম।
মুখ খারাপ করার ইচ্ছে থাকলেও আমি যে মুখ খারাপ করতে চাই না -তার একটা করে উপলক্ষ্য সর্বদাই বের করতাম। এই যেমন সাত সকালে আমার মুখটা খারাপ করাবেন না। সাত সকালের পরিবর্তে প্রয়োজনে সুযোগ মত অন্য সময় ব্যবহার করতাম। বৃহস্পতিবার হলে বলতাম ছুটির আগের দিন, রবিবার হলে সপ্তাহ শুরুর দিন, রোজার মাস হলে পবিত্র এই রমজান মাসে, কিছু না পেলে বলতাম আমার মনটা আজ ভালো নেই- তার উপর দেখছি আপনি আমাকে মুখ খারাপ করায়েই ছাড়বেন।
তবে আমি সতর্কও ছিলাম- কেউ যেন না ভাবে এটা আমার মুদ্রা দোষ। আর জিনিসটা যেন বিলা না হয়ে যায়। সব সময় সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার করতাম না। কেউ যেন আমার এ কৌশল বুঝতে না পারে সে বিষয়েও সতর্ক থাকতাম। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও একদিন ধরা খেলাম- আবারও একজন মহিলা কর্মকর্তার নিকট ,যে ঈঙ্গিত আগেই দিয়ে রেখেছি । সে উপস্থিত সবার স্বাক্ষাৎ- এ একদিন গায়ে পড়ে বলে বসলো,- স্যার আপনি বারবার মুখ খারাপ করার কথা বলছেন কেন? ঠিক আছে আপনি আজ মুখ খারাপই করেন, আমিও করি। দেখি কে জেতে? এরপর গলা চড়িয়ে বলে বসলো ইংরেজী গালি নয় খাঁটি বাংলা গালি -চলুক। বাপরে বাপ! এত বড় ওপেন চ্যালেঞ্জ- এর আগে কখনও ফেস করে ছিলাম বলে মনে পড়লো না। গালিগালাজের প্রতিযোগিতা । তাও আবার একজন মহিলার সাথে, অসম্ভব। আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম সে পুরাপুরি প্রস্তুত। আগে থেকে আমি জানতামও সে একজন মুখ ভাঙ্গা মহিলা। রণে ভঙ্গ দেয়ার পরিবর্তে রণ শুরু না করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার মনোভাব বুঝতে পেরে ভদ্রমহিলা দেখলাম মনে মনে মৃদু হাসলেন,তারপর জোর কন্ঠে তাগাদা দিলেন, কই কি বলবেন, বলেন? স্যার, শুরু করেন নাকি আমি শুরু করবো ? উপস্থিত কর্মকর্তাদের কেউ কেন কিছু বলছেনা-বুঝলাম না। এই মহিলার ভয়ে নাকি তারাও চায় আমার একটা শিক্ষা হোক। এ বুলি আমি যেন ছাড়ি। তারাতো বলতে পারে ব্যাংক গালাগালি প্রতিযোগিতার জায়গা না। আমি পরিত্রান পাবার পথ খুঁজছিলাম। হঠাৎ একটা ফোন কল আসলো। ফোনালাপে প্রয়োজনের অতিরিক্তভাব নিয়ে মগ্ন হলাম। ভদ্র মহিলা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো । সে উপস্থিত সবার দিকে তাকালো , আমি তাকিয়েই ছিলাম । মনে হলো সবাই মনে মনে তাকে বাহবা দিচ্ছে। সে রুম থেকে বীরোচিত পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল।
বাসায় এসে মুখ খারাপ করার কাল্পনিক একটা বাহাসের দৃশ্য চিন্তায় আনলাম। বলা তো যায় না কোনও দিন যদি করতেই হয়। গালাগলির অনেক শব্দই জানি কিন্তু বাংলায় উচ্চারণ করে বলে বাহাসে জেতার মত কোন শ্রাব্যগালি তো দেখি না। তবে ইংরেজীতে হলে কিছু গালি হয়তো উচ্চারণ করতে পারতাম। অবশেষে বুঝলাম মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী সমাজের গালিগালাজ এখন বাংলা থেকে ইংরেজীতে স্থানান্তরিত হয়েছে। শুধু কি তাই গালিগালাজ নয় তাও কিছু বাংলা শব্দ এখন ভদ্রসমাজে উচ্চারণ করাও যায় না। বিশেষ করে যৌন বিষেশজ্ঞ ডাক্তারের কাছে গেলে বাংলা শব্দ অপাংক্তেয় হয়ে যায়। ব্রেষ্ট ক্যান্সার যত সহজে বলা যায় তার আংশিক বাংলা উচ্চারণ করে বলতে গেলে মুখ আটকে যায়। গরুর দুধ যদি কোন মহিলা বাসায় দিয়ে যায় , তাকে এবিষয়ে তেমন প্রশ্ন করা যায় না। বাংলা ভাষার নিরীহ “ধ্যাৎ” শব্দটিও এখন ইংরেজী “শীট” এ রুপান্তরিত করে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভাবতে ভাবতে বোধোদয় হলো বাঙালী শিক্ষিত সমাজে বাংলা গালি আর বোধহয় বেশী দিন টিকবে না। আজ থেকে তিন যুগ আগে ক্যান্টনমেন্ট শাখায় ম্যানেজার যত সহজে যে গালিগুলি সহকর্মীদের প্রতি উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন এখন তত সহজে বোধ হয় আর কেউ পারবে না।
যা হোক ,আমার স্ত্রীকেও ঘটনা দুটি বলেছিলাম , সে বারবার নির্দেশের সুরে অনুরোধ করেছে -যতই কাজ উদ্ধারের জন্য হোক গালিগালাজের হুমকি আমি যেন আর না দেই। আর কাউকে আমি যেন এ অপমানের কথা না বলি।
না না ,অন্য কাউকে বলব কেন ? আজ গালাগালির প্রসঙ্গ উঠলো নেহায়েত তাই লিখতে হলো।
যা হোক একটা গোপনীয় তথ্য দিয়ে প্রসঙ্গ টি শেষ করি, এখনও আড়ালে আবডালে আমি এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকি। তবে ব্যাংকে আর কোন দিন করি নাই। স্ত্রীর সামনে তো নয়ই। (ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ২২:৩০:১০ ৬২২ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম