জৈন ধর্ম কি (Jain) এবং কাহারা জৈন ধর্মের অনুসারী- জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » ফিচার » জৈন ধর্ম কি (Jain) এবং কাহারা জৈন ধর্মের অনুসারী- জালাল উদদীন মাহমুদ
বৃহস্পতিবার, ২২ নভেম্বর ২০১৮



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

গত পরশু সাভার নিবাসী সুরসিক , সুলেখক ও আমার লেখার একান্ত ভক্ত - উৎসাহদাতা বাবু স্বপন কুমার চক্রবর্তী , এস পি ও (অবঃ) আমার বরাবরে লিখেছেন, “আপনি জৈন ধর্ম সম্পর্কেও লিখুন। আপনার বেশ তত্ব ও তথ্য বহুল লিখাগুলো আগ্রহী পাঠকদেরকে তৃপ্তি দেবে। আমি বিনা অপারেশনে হার্টের চিকৎসা নিয়েছি বাংলা মটর এলাকার সাওওল হার্ট সেন্টারে। ওখান কার ভারতীয় ডাক্তার জনাব বিমল ছাজেড় একজন জৈন ধর্মাবলম্বী । আমি তার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট।” তার এ লেখা পাবার পর ভাবলাম , মাড়োয়ারীদের নিয়ে অনেক লিখেছি। তাদের অন্যতম প্রধান ধর্ম জৈন ধর্ম নিয়ে তো লেখা হয় নাই। তাই এ লেখা । আজ থেকে মাড়োয়ারী পর্বও শেষ ঘোষনা করলাম। আগামীকাল শুক্রবার থেকে আবার রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন- এর পরবর্তী কিস্তি আল্লাহ চাহে রাত ৯.৩০ মিনিট থেকে পুনঃ শুরু হবে।

প্রশ্নঃ মাড়োয়ারীরা হিন্দু ও জৈন ধর্মের অনুসারী । মুর্শিদাবাদের তৎকালীন শেঠরা ছিলেন জৈন ধর্মাবলম্বী। জৈন ধর্ম কি ?

উত্তরঃ জৈনধর্ম (Jain) প্রাচীন ভারতে প্রবর্তিত একটি ধর্মমত। ভারতের প্রধান ধর্মগুলির অন্যতম জৈনধর্ম ভারতের কোনো কোনো অংশে ধর্ম হিসেবে এখনও টিকে থাকলেও এদেশে এর অনুসারীদের দেখতে পাওয়া যায় না বললেই চলে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সাত শতকের চীনা তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাং পুন্ড্রবর্ধন (উত্তরবঙ্গ) ও সমতট এ (দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গ) বহুসংখ্যক দিগম্বর জৈনধর্ম প্রচারকদের দেখতে পান। গবেষকরা কিন্তু বলে থাকেন খ্রিস্টপূর্ব চার-তিন শতকের মধ্যে সমগ্র বাংলা জৈন মতবাদ প্রচারকদের প্রভাবাধীন হয়ে পড়েছিল । তবে ঐতিহাসিক যুগের গোড়ার দিকে জৈনধর্ম বাংলায় প্রচলিত থাকলেও এটি কখনই অন্যান্য অঞ্চলের মতো এদেশে তেমন বিস্তার লাভ করে নি। বর্তমানে বিশ্বের নানা দেশে এই ধর্মমতাবলম্বীদের দেখা যায়। জৈনধর্মের মূল বক্তব্য হল সকল জীবের প্রতি শান্তি ও অহিংসার পথ গ্রহণ। আধুনিক বিশ্বে জৈন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম হলেও এই ধর্ম বেশ প্রভাবশালী। পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকা, দূরপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া ও বিশ্বের অন্যত্রও অভিবাসী জৈনদের দেখা মেলে.
জৈনধর্মের প্রাচীনত্ব প্রসঙ্গে ড. হেইনরিক জিমার লিখেছেন:-
জৈনদের ধারণা তাঁদের ধর্ম সুপ্রাচীন কালের। এই ধারণার মধ্যে সত্যতা আছে। যে প্রাচীনত্বের কথা বলা হচ্ছে, সেটি প্রাক-আর্য যুগীয় তথাকথিত দ্রাবিড় পর্যায়ের। সাম্প্রতিককালে সিন্ধু উপত্যকায় পরবর্তী প্রস্তরযুগীয় একাধিক বৃহদাকার শহর (উক্ত শহরগুলির ধ্বংসাবশেষ) আবিষ্কার হওয়ার ফলে এই ধারণাটি নাটকীয়ভাবে আলোকিত হয়েছে। এই শহরগুলি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা সম্ভবত চতুর্থ সহস্রাব্দের হতে পারে।
জৈনধর্মের উৎসটি স্পষ্ট নয়। ভারতের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন প্রমুখ কয়েকজন গবেষক মনে করেন যে, জৈনধর্ম হিন্দুধর্মের তুলনায় অনেক প্রাচীন একটি ধর্মমত ।

জৈনরা বিশ্বাস করে যে তাদের ধর্ম সম্পূর্ণ মানব বিবর্তনের পথে প্রথম ধর্ম বা মানুষের আদি ধর্ম। তবে জৈন ধর্মমতের প্রথম দেখা পাওয়া যায় হরপ্পা সভ্যতারও আগে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে পাঁচ হাজার বছর আগেও এই ধর্ম প্রচলিত ছিল। । মূলত হরপ্পা মহেঞ্জাদারোর ধর্ম ও আধ্যাত্ম-চেতনা আজো টিকে আছে জৈন ধর্মের মধ্যে দিয়ে।
জৈন ধর্মকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ প্রদান করেন পার্শ্বনাথ ও মহাবীর। মহাবীর গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক। বৌদ্ধ ও জৈন উভয় ধর্মেই ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয় না। উভয় ধর্মেই জীবহত্যা মহাপাপ এবং অহিংসা পরম ধর্ম।
২০১১ সালের আদম শুমারী মোতাবেক ভারতে বসবাস রত প্রায় ৪৫ লক্ষজৈন ধর্মের লোক মধ্যে সবচেয়ে বেশী জৈন ধর্মের লোক বাস করে মহারাস্ট্রে (১৪ লক্ষ) , তারপর রাজস্থানে (সোয়া ৬ লক্ষ)। ভারতে জৈন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে শিক্ষিতের হার সবচেয়েবেশী – ৯৫%।

জৈনদের ২ ভাগে ভাগ করা যায়। হয়।
১. দিগম্বর- যারা সম্পূর্ণ নিরাভরন থাকায় বিশ্বাসী
২. শ্বেতাম্বর- যারা অল্প বস্ত্র পরিধানে বিশ্বাসী।
দিগম্বর : দিগম্বর সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা নিজ শরীরের আচ্ছাদনের জন্য বস্ত্রের উপযোগ গ্রহণ করেন না, তাঁরা সর্বদা নগ্ন থাকেন। দিগম্বর সম্প্রদায়ের বিশ্বাসমতে একজন সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুকে সবসময় নগ্ন অবস্থায় থাকতে হবে।। তার কারণ হলো একজন প্রকৃত ভিক্ষু কখনো জাগতিক বা পার্থিব বিষয়-সম্পত্তির অধিকারী হবেন না। তিনি জাগতিক আবেগ-অনুভূতি (যেমন- লজ্জা ইত্যাদি ) প্রদর্শন করবেন না। এমনকি সামান্য একটি ভিক্ষাপাত্রও নিজের অধিকারে রাখতে পারবেন না। কথিত আছে দিগম্বর : দিগম্বর সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের একটি দল বাংলা অঞ্চল অতিক্রমকালে ওই সময় এই দেশের অধিবাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন।
দিগম্বর সম্প্রদায়ের বিশ্বাস মতে নারীরা কখনও মুক্তি লাভে সমর্থ নয়। তাদের মুক্তি লাভের জন্য অন্য কোনো জন্মে পুরুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করেই তা অর্জন করতে হবে। কারণ নারীরা যথার্থরূপে একজন যোগীর জীবন যাপন করতে সক্ষম নন। সামাজিক কারণেই তাদেরকে বস্ত্র পরিধান করতে হয়। একজন নারীর নগ্ন অথবা বস্ত্রহীন থাকাটা সম্ভব তো নয়ই বরং তা একটি অবাস্তব ধারণা। তাদের মতে নারীরা স্বভাবজাতভাবে ক্ষতিকর।
শ্বেতাম্বর: এরা সাদা রঙের কাপড় পরিধান করেন। সাথে একটি ভিক্ষাপাত্র , হাঁটার পথ থেকে পোকামাকড় সরাবার জন্য একটি ঝাড়ু ,বইপত্র এবং লেখার সামগ্রী তারা অধিকারে রাখতে পারেন। এ দেশে আসা জৈনদের সবাই ছিল শ্বেতাম্বর।

আমার মুল আলোচনার বিষয় হলো মাড়োয়ারীদের ব্যবসা নিয়ে। অনেক মাড়োয়ারী জৈন ধর্মের অনুসারী ছিলেন। আমার জানার বিষয় হলো জৈন ধর্মের মধ্যে এমন কিছু কি ছিল , যা তাদের ব্যবসায়ী হিসাবে প্রতিষ্টিত হতে সহায়তা করেছিল।
বিষয়টি অনুসন্ধান করার জন্য ব্যবসা প্রশাসনে পড়া একজনকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। আজ সে তার রিপোর্ট জমা দিয়েছে। যা নিম্নে তুলে দিলাম -
জৈন ধর্মের অনুসারীরা কিছু মূল জীবন দর্শনকে জৈন আচরনের ভিত্তি বলে জানেন । তার মধ্যে নিম্নরুপ মূল নীতি সমূহ আছে-
-জৈন ধর্মের মূল নীতি অহিংসা।
-জৈন ধর্মের দ্বিতীয় পিলার সততা। জৈন মতে একজন পুত্র সন্তান যেমন তার মাকে বিশ্বাস করতে পারে, মানুষের সততা সেই পর্যায়ের হওয়া উচিৎ যাতে তোমাকে সবাই মায়ের মতন বিশ্বাস করবে। আর যদি সততার জন্যে হিংসার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা থাকে, জৈন নীতি অনুযায়ী নির্বাক থাকায় শ্রেয়।
-জৈন ধর্মের তৃতীয় পিলার হলো-লোক ঠকানো যাবে নাঃ
জৈন ধর্মের নির্দেশ ঃ
১। -কারুর আর্থিক বা অন্য দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা, চুরির সমান
২. কেহ কিছু স্বেচ্ছায় দিলে-তবেই তা গ্রহণ করবে। বলপূর্বক বা ছলপূর্বক কিছু নেওয়া নিষিদ্ধ।
৩.. চুরি করা বস্তু বা যে লাভ অনৈতিক কাজ থেকে আগত, তা গ্রহণযোগ্য না।
-জৈন ধর্মের চতুর্থ পিলার ব্রহ্মচর্য্য :
জৈন ধর্মে স্ত্রী ছাড়া আর কারুর সাথে মেলামেশা স্বীকৃত না। জৈন ধর্মের মূলনীতি এক্ষেত্রে হচ্ছে, যা কিছু নেশার বস্তু, যা কিছু আসক্তির জন্ম দেয়, তার সব কিছুই পরিত্যাগ করতে হবে। আসক্তি থেকে মুক্তি, তা মদ্যপান থেকে ভাল খাবার অনেক কিছুই হতে পারে –তা পরম কাম্য। ফলে এই ধর্মে মদ্যপান, গাজা ভাং ইত্যাদি সম্পূর্ন নিষিদ্ধ।

জানিনা তারা আজো এসব কড়াকড়ি ভাবে পালন করে কিনা। ব্যতিক্রম সব স্থানেই আছে। পলাশী যুদ্ধের সময় তার প্রমানও পাওয়া গেছে। তবে পার্শীদের বাদ দিলে ভারতে নাকি জৈনরাই এখনও সব থেকে বড় ব্যবসায়ী। ধর্মের মুল নীতিগুলি পালন করতে গেলে বিশ্বাসযোগ্য থাকতেই হয়। ধর্মীয় কারনেই নাকি জৈন ব্যবসায়ীরা সব থেকে বেশী বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন। তবে তাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমার হাতে কোন তথ্য নাই।

বাংলাদেশ সময়: ২৩:১৫:৪৯   ১৪১৮ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

ফিচার’র আরও খবর


অ্যানেন্সেফ্লাই কী? - রুমা আক্তার
শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নের অগ্রদূত : স্পিকার ; ১০০০ নারী উদ্যোক্তা’র মধ্যে ৫ কোটি টাকার অনুদান প্রদান
“ম্রো’ আদিবাসীর গো হত্যা’ অনুষ্ঠাণ ” - তানিয়া শারমিন
আলোকিত স্বপ্ন নিয়ে তৃতীয় বর্ষে রবিকর ফাউন্ডেশন
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন রক্ষায় প্রয়োজন জেন্ডার সংবেদনশীল নীতির পর্যালোচনা
জিনগত ত্রুটির অপর নাম “ডাউন সিনড্রোম”- রুমা আক্তার
মোহাম্মদ শাহ আলমের জীবন ও কর্ম
ইসফাহান নেসফে জাহান
সিলেটে গ্রুপ ফেডারেশনের কর্মশালায় বির্তকিত মুরাদ- আয়োজকদের দুঃখ প্রকাশ
ডলারের দাম যেভাবে বাড়ছে, টাকার দাম কেন কমছে

আর্কাইভ