বঙ্গ-নিউজ: প্রতিবছর ১২ নভেম্বর এলে আঁতকে উঠে লক্ষ্মীপুরের মানুষ । ১৯৭০ সালের এইদিনে উপকূলে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। জেলার রামগতি ও
কমলনগর উপজেলার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এর আঘাতে চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা ৮ থেকে ১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। স্রোতে ভেসে যায় নারী শিশু, বৃদ্ধসহ অসংখ্য তাজা প্রাণ।
এ দিনটি ফিরে এলে সেইদিন বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো এখনও ভয়ে আঁতকে উঠে। ৪৮ বছর পরেও প্রিয়জন হারানো মানুষরা ভয়াল এ দিনটিকে ভুলতে পারেনি।
** ভয়াল ১২ নভেম্বর: আজও কাঁদেন স্বজনহারা মানুষ
১২ নভেম্বর এলেই নির্দিষ্ট কিছু সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করে। মিলাদ মাহফিল, কোরআনখানি ও নিহতদের স্মরণে স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। কিন্তু এত বড় একটি ঘটনা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করা হয় না। যে কারণে এ দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ করার দাবি উঠেছে।
লক্ষ্মীপুরের কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উপকূল দিবস বাস্তবায়নের দাবিতে ১২ নভেম্বর (সোমবার) মানববন্ধন ও আলোচনা সভা করবে বলে জানা যায়।
১৯৭০ সালের এইদিনে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া দশ বছরের কিশোর শহিদুল ইসলাম এখন প্রায় বৃদ্ধ। ওই দিনের সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তার বাবা নুরুল হক মাস্টার, ভাই আবুল কালামসহ ১৮ জন কৃষি-শ্রমিক নিহত হয়েছেন। বাবা-ভাইয়ের মরদেহ খুঁজেও পাননি তার স্বজনরা।
লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের চর জাঙ্গালিয়া গ্রামের বাসিন্দা বেঁচে যাওয়া সেই শহিদুল কান্নায় ভেঙে পড়ে স্মৃতিচারণ করেন সেই দিনের। তিনি বলেন, ভয়াল ওই দিনে কমলনগরের চরকাদিরা ভুলুয়া নদী সংলগ্ন খামার বাড়িতে বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে ছিলেন তিনি। তারা তিনিজন ছাড়াও আর ১৫ জন কৃষি-শ্রমিক ওই বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ওই দিন সন্ধ্যার দিকে নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পায়। রাত ৮টার দিকে ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়। তীব্র বাতাসে ঘর ভেঙে পড়ে। এদিকে পানি বাড়তে থাকে। বাঁচার জন্য সবাই ভাঙা ঘরের চালায় অবস্থান নেন। তিনি একটা কাঠের বাক্সের ভিতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে পানির ঢল ধেয়ে আসে। চোখের সামনে ঢেউ ভাসিয়ে নেয় তার বাবা-ভাইসহ ১৭ জনকে। পরের দিন সকালে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূর থেকে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়।
স্বজন হারারা জানান, সেদিন রেডিওতে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেওয়া হয়। কিন্তু উপকূলে পর্যাপ্ত রেডিও ছিল না। যাদের ছিল তারা বিশ্বাস করেনি। ওই দিন সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ছিল। সন্ধ্যায় থেকে হালকা বাতাস শুরু হয়। গভীর রাতে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। যার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার। ঝড় আর স্রোতে উপকূল লন্ডভন্ড হয়ে যায়। চারদিকে লাশ আর লাশ ভাসতে থাকে। পানি কমতে কমতে লাশে পচন ধরে। ওই পরিস্থিতিতে অসংখ্য লাশ দাফন করাও সম্ভব হয়নি। শিয়াল-কুকুর টেনে হিঁচড়ে খেয়েছে। সে রাতে লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে লক্ষ্মীপুরের রামগতির মেঘনা উপকূলীয় চর আবদুল্লাহ, কমলনগরের ভুলুয়া নদী উপকূলীয় চরকাদিরা, নোয়াখালীর হাতিয়া, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় এটি হানা দেয়। চারিদিকে লাশ আর লাশ, লাশের গন্ধে মানুষ কাছে যেতে পারেনি। ৩ থেকে ১০ ফুটের জলোচ্ছ্বাসের কারণে মাটি দেওয়া যায়নি মৃত মানুষগুলোকে। প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের প্রায় ১০ লাখ লোকের প্রাণহানির ঘটনার দুই দিন পর সরকারিভাবে খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু হয়।
৭০ এর ১২ নভেম্বর পরবর্তী উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতায় নিয়োজিত ছিলেন লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার বাসিন্দা এএইচএম নোমান। তিনি জানান, তার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হচ্ছে রামগতি চর আবদুল্লাহ ইউনিয়ন। জেলে পল্লী অধ্যুষিত এ ইউনিয়নটি ছিল প্রায় নারী-শিশু শূন্য। সেই রাতে সিএসপি আব্দুর রব চৌধুরীর চর কোলাকোপার ১১৩ জন আত্মীয়-স্বজনকে জলোচ্ছ্বাসে নিয়ে যায়। সে দিনের হাজারও নির্মম ঘটনার সাক্ষী দেশের দক্ষিণ উপকূল।
বাংলাদেশ সময়: ৯:২৩:৫৩ ৫৫৯ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম