২৯ তম কিস্তি—
তালোড়া শাখায় ১১ মাস- ২৩ তম পর্ব।
সোনা, রুপা, হীরা, জহরত ইত্যাদি দামী বস্তু গচ্ছিত রেখে টাকা ধার দেওয়া বা এসব জিনিসপত্র যৎসামান্য লাভে গচ্ছিত রাখার একটা পদ্ধতি প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে চলে আসছিল।
তবে বর্তমানে আমরা ব্যাংকের যে কার্যাবলী দেখি বাংলাদেশ সহ প্রাচীন ভারতে ব্যাপক ও কাঠামোবদ্ধ ভাবে তা প্রচলিত ছিলনা। তবে ব্যাংকিং কার্যক্রমের মৌলিক কিছু বিষয় মোটামুটিভাবে অনুসৃত হতো।
সুবর্ণ বণিক, বণিক, কুণ্ডু ও পোদ্দার পদবিধারী মহাজন গোছের লোকেরা শহর-বন্দর, গঞ্জ-বাজারে গদিঘর প্রতিষ্ঠা করে মাল গচ্ছিত রাখা এবং টাকা ঋণ দেওয়ার কারবার করতেন যা সাধারণ জনগনের মধ্যে ‘পোদ্দারি ব্যবসা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল । কর্ম ও পেশাভিত্তিক বাঙালি হিন্দু সমাজে সুবর্ণ বণিকরা সোনার ব্যবসায়ী বা সোনারু হিসেবে পরিচিত ছিলেন । এ সব স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের পোদ্দারি ব্যবসা ঘিরেই বাংলায় ব্যাংক ব্যবসার গোড়াপত্তন হয় ।
ঐ সময়ে অর্থ দাদনকারী, মুদ্রা বিনিময়কারী, গ্রামীণ ব্যবসায়ী ও স্থানীয় দোকানদারগণকেই ব্যাংকার হিসাবে গণ্য করা যায়।। মুসলিম শাসনামলে স্থানীয় মূলধন বিনিয়োগকারিগণ ব্যাংকারদের ভূমিকা পালন করতেন। তাদের দেওয়া দাদনপত্র বা ঋণপত্র হুন্ডি নামে পরিচিত ছিল এবং এর মাধ্যমে প্রাপক বা গ্রহীতা অর্থ স্থানান্তরও করতে পারতেন।
এপর্যায়ে মহসীন খাঁন আমাকে বললেন আমি আপনার মাড়োয়ারীদের তথ্য সংগ্রহের কাজ অনেক সহজ করে এনেছি ।
জিজ্ঞাসা করলাম –কিভাবে ?
-সকালে আমরা আমার বাসায় বসেছিলাম । সেখানে আমি ও ঝন্টু এ ছোটভাইটিকে (ইতিহাসের ছাত্রকে দেখালো) যে সব প্রশ্ন করেছিলাম এবং সে যা যা উত্তর দিয়েছিল তা লিখে এনেছি। এর ভিতর যে গুলি আপনার প্রয়োজন তা টাইপ করে নিয়েন ।মাড়োয়ারী দের নিয়ে সংগৃহীত ৩ টি কৌতুকও এখানে আছে। জুম্মার নামাজের দিন – সবারই তাড়া থাকে। বাসায় যেতে হবে। আবার ফেরৎদিব -বলে মহসীন ও ছাত্রটির নিকট থেকে বই ও কাগজপত্রগুলি নিয়ে বাসায় আসলাম।
সেখান থেকে বেছে বেছে কতিপয় প্রশ্ন ও উত্তর টাইপ করা শুরু করলাম। টাইপ করতে করতে হঠাৎ মনে হলো তারা সবাই-ই আমার মতই মাড়োয়ারীদের উপর কয়েকদিন অনেক পড়াশোনা করেছে। তবে ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ তথা জগৎেশঠের প্রসংগটি কেন আগেই আলোচনা করা হলো তা বুঝতে পারলাম না। আমার মত পাঠকবৃন্দও এতে বিভ্রান্ত না হলেই হয়। কাগজে লিখে আনা কিছুপ্রশ্ন ও উত্তর নীচে লিপিবদ্ধ করলাম।
প্রশ্নঃ নবাব মুর্শিদ কুলি খানের রাজত্ব কাল ছিল ১৭১৭ থেকে ১৭২৭ । বলা হয় তার সময় থেকে মাড়োয়ারিরা ব্যবসায়ে বেশ ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে ওঠে। তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ার পেছনে নবাবের ‘মালগুজার’ ব্যবস্থার বিশাল ভূমিকা ছিল।এই ‘মালগুজার’ ব্যবস্থাটা কি ?
উত্তরঃ‘মালগুজার’ ব্যবস্থায় ঋণগ্রস্ত ইজারাদার বা তালুকদাররা তাদের পক্ষে অর্থপ্রদানকারী জামিনদার হাজির করতে পারলে জমি নিলামের হাত থেকে রক্ষা করতে পারতো। এ সময়ে এ সব মাড়োয়ারিরা জামিনদার হতেন। ক্রমে জামিনদারি এ দেশে একটি বড় ব্যবসায়ে পরিণত হয়। জামিনদারি ব্যবসার দ্বারা বিপুল অর্থের মালিক বনে যাওয়া এসব মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অনেক জমিদারির স্বত্ব কিনেও নেয় । এভাবে সেসময় মাড়োয়ারিরা ব্যবসায়ে বেশ ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে ওঠে।
প্রশ্নঃ সে সময়ের পাট ব্যবসায়ে মাড়োয়ারীদের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে কিছু বলেন।
উত্তরঃ গত দুই শ বছরের বাংলার ইতিহাসের দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাব বেশী সময় ধরে পাটই ছিল নায়কের ভূমিকায়। প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশে পাট চাষ হলেও উনিশ শতকের প্রথম দিকে মূলতঃ এটি বিস্তার লাভ করে। ব্যাপকভাবে পাট উত্পাদন শুরু হয় ১৮৪০ সালের দিকে। ইংরেজ আমলে বাংলায় এবং পাকিস্তানি আমলে পূর্ব বাংলায় (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) পাটজাত দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন ছিল একক বৃহত্তম শিল্প। ১৮শতকের মাঝামাঝি থেকে বাংলার পাট ইংল্যান্ডে রপ্তানি হতে শুরু করে। ব্রিটিশ বস্ত্রশিল্প-দুনিয়া জোড়া খ্যাতি পায় বাংলার পাটের কারনেই । বাংলার সম্পদে ইংল্যান্ডে নতুন এক ধনিক শ্রেণীরও জন্ম হয়। পরে এই ধনিক শ্রেণীর জায়গা নেয় রাজস্থানের মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা। বিশ শতকের শুরুতে পূর্ব বাংলায় পাটের আড়তদারি আর পশ্চিম বাংলার পাটশিল্পের মালিকানায় তারাই ছিল একচেটিয়া। পাটের কারখানার মাধ্যমেই আজকের ভারতের শীর্ষ ধনী টাটা-বিড়লাদের শিল্পসাম্রাজ্যেরও গোড়াপত্তন হয় ।
অতীতে বাঙালিরা কখনোই বড় কোনো শিল্প খাত গঠন করতে পারেনি। ব্রিটিশ আমলে কিছু করেছিল মাড়োয়ারি পুঁজিপতিরা, । ক্রমেক্রমে এই মাড়োযারি পরিবারগুলোই এ দেশে পাটের ব্যবসায় একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। মাড়োয়ারিরা ১৯০০ সালের মধ্যে কলকাতার পাট ব্যবসায়ীদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ব্যবসায়ের অধিকারী হয় কলকাতার জুট বেলার্স অ্যাসোসিয়েশনের ৭৪ জন সদস্যের মধ্যে ৪৯ জন সদস্যই ছিল মাড়োয়ারি। বলে রাখা ভাল , মাড়োয়ারি ও ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলি পূর্ব বাংলার পাট ব্যবসায়ে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। কলকাতায় ছিল এদের সদর দফতর।
এছাড়াও আফিম ও নীল ব্যবসা ব্রিটিশদের একচেটিয়া হলেও এই ব্যবসায়ে মূল অর্থলগ্নীকারী ছিল মাড়োয়ারিরা।
প্রশ্নঃ উনিশ শতকে ব্যাপক হারে মাড়োয়ারিরা বাংলায় অভিবাসন শুরু করে কথাটি সঠিক কিনা ?
উত্তরঃ সঠিক । মাড়োয়ারিরা ব্যাপক হারে বাংলায় অভিবাসন শুরু করে উনিশ শতকে এবং চার থেকে পাঁচ দশকের মধ্যেই বাংলার অর্থনীতির উপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তৎকালীন পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শহর যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা,ময়মনসিংহ, নওগাঁয়, মাড়োয়ারিরা বড়বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে।
এ সময় কলকাতা ও বাংলার অন্যান্য শহরে অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের -মালিক ছিল মাড়োয়ারিরা । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে হতে এ মাড়োয়ারিগোষ্ঠী পুরো ভারতবর্ষের স্থলপথের বাণিজ্যের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। তারা এ দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যে প্রায় সম্পূর্ণভাবে আধিপত্য বিস্তার করে। ইংরেজ ঐতিহাসিক জেমস টড লিখেছেন, ‘ভারতে দশজন ব্যাংকার বা ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যক্তির নয়জনই মরু দেশের (মাড়োয়ার) বাসিন্দা।’ উনিশ শতকের একেবারে শুরুর দিকে ভারতবর্ষের ব্যবসা-বাণিজ্যে মাড়োয়ারিদের আধিপত্য শুরু হয়। এমনকি তারা আসাম সহ বার্মাতেও ব্যবসা বিস্তৃত করে। ঊনিশ শতকে কলকাতা ও বাংলার অন্যান্য শহরের অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিল তারাই। মাড়োয়ারিদের অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে আগারওয়াল সম্প্রদায়ই তখন অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে ছিল।
প্রশ্নঃ-ঢাকায় কি তখন অন্য কোন ব্যবসায়ী ছিলেন না ?
উত্তরঃ মাড়োয়ারিরাই অবশ্য তখন একমাত্র ব্যবসায়ী ছিলেন না। ১৭৮৯ সালে ঢাকায় আর্মেনীয়দের ১৩টি, , হিন্দুদের ১৩টি (জগত্ শেঠেরসহ) ও মুসলমানদের ৭ টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল।
এ প্রসঙ্গে গবেষক আনিস আহমেদ ঢাকাইয়া আসিল গ্রন্থে মুন্সী রহমান আলী তায়েশ বিরচিত তাওয়ারিখে ঢাকা (১৯১০) গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘প্রায় ১০০ বছর ঢাকা ছিল বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা— এই তিন প্রদেশের রাজধানী। এ সময় যত সুবেদার দিল্লি থেকে এখানে এসেছেন, সকলেই দিল্লির সব শ্রেণির লোকজন নিজেদের সাথে নিয়ে এসেছেন। বিদ্বান, কেরানি, যোদ্ধা, কারিগর, শিল্পী, ব্যবসায়ী, দর্জি, স্বর্ণকার, শালকার, আমুদে, রুটি প্রস্তুতকারী, ময়রা সকলেই দিল্লি থেকে এসেছেন। এ শহর বিস্তৃতি, জনবসতি, জ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যায় তখন দিল্লির অনুরূপ ছিল। বড় বড় ধনী ও সম্পদশালী লোকেরা এ শহরে ছিলেন। যদিও পরবর্তীতে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ায় এ শহরে জনবসতি হ্রাস পেতে থাকে। তবুও যত লোক এখানে থেকে যান তারা সবাই দিল্লি থেকে আগত লোকদেরই বংশধর। ব্যবসা উপলক্ষে বিদেশিরা দিনে দিনে ঢাকায় আসে ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকা আয় করে বিশাল জমিদারি ও ভূ-সম্পত্তি করে ফেলেছেন। মুঘল, গ্রিক, আর্মেনীয়, ইংরেজ, ফরাসি, পর্তুগিজ প্রভৃতি জাতি ঢাকায় বসবাস করে প্রচুর সম্পদের অধিকারী হন।’
প্রশ্নঃ-বলা হয় ,মাড়োয়ারিরা তাদের প্রাথমিককালে সবচেয়ে বড় সাফল্য পেয়েছিলেন বাংলায়। বাংলায় বাঙালীরা কেন ব্যবসায়ীর হলো না?
উত্তরঃ সে সময়ে বাংলার মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যের চেয়ে কৃষিকাজ, শিল্প-সাহিত্য নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল। বাংলার এই শূন্যস্থানে মাড়োয়ারিরা প্রবেশ করে সফলতা লাভ করেছিলেন।
আবার দেখুন সে সময় সারা ভারতে বাঙালিরা বরাবর ভদ্রলোক হিসেবেই পরিচিতি পেয়ে আসছেন ৷ শিল্পকলা,সাহিত্য, এবং নানা সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা বাঙালিদের রক্তেই ছিল৷ কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয় বাঙালিদের থেকে হাজারগুণ এগিয়ে মারওয়াড়িরা ৷ তাঁরা সবার কছে সারাদেশে বরাবরই ‘মানি মাইন্ডেড’ সম্প্রদায় হিসেবেই পরিচিত ছিল ৷ বর্তমানে চিত্রটা কিছুটা বদলালেও কোনও বাঙালি ঘরের ছেলে বা মেয়ে ব্যবসা করবেন ব্যবসায়ী হবেন , সেটা হয়তো তাঁদের অভিভাবকদের প্রথমে মেনে নিতেও কষ্ট হয় ৷ মারওয়াড়িদের ক্ষেত্রে বিষয়টা কিন্তু ঠিক উল্টো ৷ ছেলে বা মেয়ে যতোই উচ্চ-শিক্ষিত হোক না কেন, পারিবারিক ব্যবসার কাজে হাত দেওয়াটা তাঁদের জন্য একপ্রকার বাধ্যতামূলকই বলা যায় ৷ ব্যবসা কীভাবে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে , কিভাবে আরো বড় করতে হবে কিভাবে আরো সাফল্য লাভ করতে হবে তার কৌশল বি বি এ , এম বি এ পড়ে জানতে হয় না তাদের ৷ কারণ হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবসা তাঁদের রক্তেই মিশে রয়েছে ৷ বাঙালিরা শুধু দেশের মধ্যে নয়, গোটা বিশ্বেই ‘বিজনেস মাইন্ডেড’ মানুষ হিসেবে তেমন পরিচিত নন। বরং অন্যের ব্যবসায় নিজে চাকরি করে সময়মত বাড়ি ফিরতে আগ্রহী। বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে অবশ্য দিনদিন এ চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। অনেক সফল উদ্যোক্তা এখন নজরে পড়ে। তবে মারওয়াড়িদের পজেটিভ দিকগুলি থেকে এখনও অনেক কিছু আমাদের শেখার আছে।(ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ২২:৪০:০০ ৬৭৭ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম