২১তম কিস্তি—
তালোড়া শাখায় ১১ মাস- ১৫ তম পর্ব।
ব্যাংকাররা যে যে বিষয়েই পাশ করুক না কেন আর্থিক প্রণোদনা , পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে ও পদোন্নতির জন্য ব্যাংকসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে অল্পবিস্তর ধারণা থাকতে হয়। বিশেষ করে ব্যাংকিং আইন-কানুন-প্রাকটিস ,হিসাববিজ্ঞান , ব্যবস্থাপনা, বিপণন, আইন, অর্থনীতি, ব্যবসায় যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, সংগঠন, অর্থ ও হিসাব, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও মুদ্রা বিনিময়, ঋণের ঝুঁকি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি সম্পর্কে। ব্যাংক পরিচালনার জন্য এ রকম দরকারি ১২টি বিষয় দুই পর্বে (পার্ট-১ ও পার্ট-২) নিয়ে বছরে দুবার আয়োজন করা হয় ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা। বিশেষ কৃতিত্বের জন্য সনদের সঙ্গে রয়েছে আলাদা অ্যাওয়ার্ড। তা ছাড়া, স্ব স্ব ব্যাংকে ডিপ্লোমা পাসের সনদ জমা দিলেই পাওয়া যায় এককালীন আর্থিক পুরস্কার । ব্যাংকে পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিবেচনা করা হয় ডিপ্লোমা পাসের সনদ।
রমিজ সাহেবের উৎসাহ আর আমার ভবিষ্যত উজ্জ্বল না হবার উৎকণ্ঠায় ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষার জন্য ফরম ফিলাপ করলাম। একজনকে দিয়ে বগুড়া শহর থেকে গাইড বই আনালাম। পড়াও শুরু করলাম। একদিন পরীক্ষার হলে হাজির হলাম। শুনলাম এ সেন্টারে এটাই প্রথম ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা। বুঝলাম কিছু মিসম্যানেজমেন্ট হতে পারে। সিট নম্বর নাই। যার যেখানে ইচ্ছা বসছে। আমি ও্র রমিজ সাহেব পাশাপাশি বসে পড়লাম। চারদিকে তাকালাম। প্রায় সবার হাতে গাইড বই , তাও আবার প্রকাশ্যে। রমিজ সাহেব অবশ্য বলেছিল সবাই বই নিয়ে যাবে। আমি বিশ্বাস করি নাই। আর বই নিয়ে আসাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পরীক্ষা শুরু হলো। হৈ হৈ রৈ রৈ। চারদিকে যেন উৎসবমুখর পরিবেশে পরীক্ষা চলছে। ইনভিজিলেটররা যে কি করছে বুঝলাম না। যা পড়ে এসেছিলাম ভুলে যাবার যোগাড়। আর বেচারা রমিজ। আমার ভুলে আজ রাজ্য হারা। হাতে বই নাই। পাশের জন বই থেকে লিখছে আর সেটুকুই সে দেখে দেখে টুকছে। আমি যা পড়ে এসেছিলাম -এ গোল মেলে পরিবেশে তার সবই যেন এলোমেলো হয়ে পড়ল ।
পরীক্ষার পরে আমার মনে গুনগুন করা শুরু করলো গুনাই বিবি ছবির কানন বালা সরকারের গাওয়া গান “ দাদা আর যাবোনা ঐস্কুলেতে , ঐ স্কুলেতে লিখতে গেলে দাদা গো সন্মান বাঁচেনা ।”
পরের পরীক্ষার আগে রমিজ সাহেব বললো যতই বলেন গাইড বই ছাড়া হলে আর যাবনা। রমিজ যদি পরীক্ষা না দেয় তবে আমার সাথী কে হবে? নিক না বই । মূল বই তো নয় কেবল গাইড- এ আর এমন কি? এতে “অন্নপাপ” গোছের কিছু হবে না। চুপি চুপি বলে রাখি যে পরিস্থিতি চলছিল তাতে রমিজ আমার নিষেধ শুনতোও না।
দ্বিতীয় পরীক্ষার দিনে বেশ আগেই আমরা সেন্টারে পৌঁছলাম। কে যেন গুজব ছড়ালো আজ কড়াকড়ি হবে। ম্যাজিষ্ট্রেট আসবে। গেটে চেক করে করে রুমে ঢোকাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। রমিজ সাহেব বিমর্ষ হয়ে পড়লো। অনেকেই দেখি প্যান্টের বেল্টের নীচ দিয়ে তলপেটের সাথে বই ঢুকিয়ে নিচ্ছে। কেউ দুই উরুতে বই বাঁধছে। ও দিকে রুমে ঢোকার সময় হয়ে গেছে। দেখলাম একজন দারোয়ান হলের গেটে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বই থাকলে সে নিয়ে নিচ্ছে। তবে শরীরে হাত দিচ্ছে না। রমিজ সাহেব ২ টি গাইড এনেছে। একটি তার জন্য অন্যটি আমার জন্য। আমি বললাম আমারটা বাহিরে রেখে দিন –ওভাবে আমি বই নিবনা। বিপদে এবার বন্ধুর পরিচয় দিল রমিজ সাহেব। বললো দুইটি বইই আমি নিব। হলে গিয়ে আপনাকে দিব। আমি না না করতেই থাকলাম। রমিজ সাহেব বললো এ সব ঢং করার সময় এখন আর নাই। আর মাত্র ৫/৭ মিনিট আছে। আপনি আমার সাথে আগে বাথ রুমে চলেন। পরিস্থিতি বুঝে সে আগে থেকেই কোথ্থেকে যেন একটু দড়ি যোগাড় করে নিয়েছে। হাত ধরে টেনে আমাকে বাথরুমে নিয়ে বললো বই ২টি আমার উরুতে বেঁধে দিন।
প্যান্ট তার উরু পর্যন্ত উঠলো না। আমিও এ বিষয়ে এক্সপার্ট না। দন্ডয়মান আর একজনকে রমিজ সাহেব অনুরোধ করলো। যে পর্যন্ত প্যান্ট উঠলো –সে পর্যন্ত তুলে ২ পায়ে ২টি বই খুব শক্ত করে বেঁধে অসম্ভব দ্রততার সাথে সে গিটটু দিয়ে হলের দিকে দৌড় দিল।। সাথে সাথে পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাও পড়লো।রমিজ সাহেবকে তাগাদা দিলাম। রমিজ সাহেব হাঁটতে শুরু করতেই বাঁধলো মহা বিপত্তি।
২টি বইই যে হাঁটু বরাবর বাঁধা হয়েছে। হাঁটু তো আর ভাঁজ হচ্ছে না। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। বললাম আমার ঘাড় ধরে হাঁটেন –ঘাড় ধরতে কিছুতেই সে রাজী হচ্ছিল না। দিলাম এক ধমক । সাথে সাথে ঘাড় ধরে হাঁটার চেষ্টা করলো । তাতেও বিশেষ লাভ হল না। পাশ থেকে একজন বুদ্ধি দিল ঘাড় ধরে লাফ দিয়ে যান ভাই। ভাবলাম , ব্যাঙও তো এভাবেই লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। এতে দোষের কি ? আমার কাঁধে ভর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে রমিজ সাহেব।অন্যরা এ দৃশ্য দেখছে। লজ্জায় আমি আমার চোখ বন্ধ করলাম। “হাঁটুতে ব্যথা নাকি ? “ -দারোয়ানের প্রশ্নে চোখ খুলে দেখি গেটের কাছে পৌঁছে গেছি। দারোয়ানও এগিয়ে এসে তাকে সিটে বসতে সাহায্য করলো। সামনের সীটের একটু বয়স্কগোছের পরীক্ষার্থী বললেন উনার স্ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হবে।আমাদের দোকানে আছে। একদম চীপ রেট। ওরে বাপরে ! পরীক্ষার হলেও ব্যবসার বিজ্ঞাপন।
সিটে নির্বিঘ্নে বসতে পারলেও বই আজ আর সেও খুলতে পারলো না , অন্যরাও পারলো না। কথা বলতে বাঁধা নাই তবে বই খোলা একদম নিষেধ। প্রথম প্রথম দু”একজন চেষ্টা করলো বই বের করতে তাদের সাথে সাথে বহিস্কার করা হলো। ভীষন কড়াকড়ি শুরু হলো। তবে আমি সহ বেশ কয়েকজন আজ একটু ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দিতে পারলাম। মনে হলো পাশ হবে। পরীক্ষা শেষে সবাই আগে বের হোক তারপর আমরা বের হব-এভাবে প্লান করলাম।দারোয়ান আবার এগিয়ে এল।ও দিকে আবার সেই স্ক্রাচের বিক্রেতাও এসে জুটলো আর বার বার বলতে লাগলো হাঁটুর উপর বেশী চাপ দিলে ক্ষতি হতে পারে।”আচ্ছা দাঁড়ান”-বলে সে আর দারোয়ান মিলে রমিজ সাহেবের বগলের নীচে হাত দিয়ে এবং আরো কি কি যেন ভাবে পা দুটো মাটি থেকে আলগা করে নিল। তাদের দুজনের উপর সোয়ার হতে রমিজ সাহেব বাধ্য হল। আমি নীরব দর্শক হয়ে পীছন পীছন হাঁটা শুরু করলাম। একটা রিকশার সামনে নিয়ে এসে তাকে তাতে তুলে দিল তারা। কিন্তু গার্ড যখন দেখলো তাকে বকশিস দেয়া হচ্ছে না এবং সেই স্ক্রাচের বিক্রেতা যখন শুনলো স্ক্রাচ কেনা লাগবেনা-তখন তারা বিরস বদনে স্থান ত্যাগ করলো। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। উত্তরের লোকগুলি বোধহয় একটু বেশ সহজ সরল।
পরের পরীক্ষাগুলোতে আরো কড়াকড়ি শুরু হলো। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমতে থাকলো। রেজাল্ট বের হলে দেখা গেল আমি প্রধম দিনেরটা বাদে অন্যগুলোতে পাশ করেছি। রমিজ সাহেব প্রথম দিনেরটা সহ সম্ভবতঃ আর একটি তে পাশ করেছিল।
আমি যখনকার কথা বলছি তা কবেই গত হয়ে গেছে। বর্তমানে সবকিছু একটি সিস্টেমের উপর দাঁড়িয়ে গেছে। এখন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ,পরীক্ষক ,পরীক্ষার্থী সবাই অনেক সচেতন। তবে কিছু কিছু পরীক্ষার্থী বার বার অকৃতকার্য হওয়ায় হতাশার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।
আমি এ পর্যন্ত দেখেছি যারা লেগে থেকেছে তারা সবাই পাশ করেছে। হয়তো কারো কারো একটু বেশী সময় লাগছে। হাল ছাড়লে কিন্তু হবে না।
আজ অবশ্য সে সময়ের আর একটি পরীক্ষার কথা মনে হচ্ছে-আর মনে মনে হাসছি।(ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ৮:০৮:০৩ ৬১৫ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম