বঙ্গ-নিউজঃ রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের পরও ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা থেমে নেই। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) বলছে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নগরবাসীর সচেতনতার বিকল্প নেই। জনগণ সচেতন হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়ার কথা প্রথম আলোকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল করিম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসাদুজ্জামান, ঢাকা
প্রথম আলো: ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো কী?
মীর রেজাউল করিম: ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার অনেক কারণ আছে। ঢাকা শহরের আয়তনের তুলনায় লোকসংখ্যা অনেক বেশি। পথচারী অনেকেই জানেন না, কীভাবে রাস্তায় চলাচল করতে হয়। কীভাবে সড়কে পার হতে হয়। পথচারীদের কিছুটা হয়তো ভুল আছে। পাশাপাশি আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি আছে। চালকদের মধ্যে বেপরোয়া যান চালানোর প্রবণতা আছে। চালকদের মধ্যে আছে কিছু অসুস্থ প্রতিযোগিতা। মোটরসাইকেল নিয়েও আমরা চিন্তিত, আমরা আতঙ্কিত। মোটরসাইকেল চালকেরা বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছেন, ফাঁকা স্থান পেলে সেখানে ঢুকে যাচ্ছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এসব কারণে আমাদের শহরে দুর্ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে। আশপাশের দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মাত্রা এখনো অতিক্রম করেনি। ভিয়েতনামে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা অনেক বেশি। বিশেষ করে মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার সংখ্যা। নিরাপদ সড়কের দাবি আছে। আমরাও চাই, সড়ক নিরাপদ হোক। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে আমরা অনেক কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। আমরা প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। সাম্প্রতিক ঘটনার পর অনেক জায়গায় র্যালি করেছি, আলোচনা সভা করেছি। আমরা রোভার স্কাউট, গার্ল গাইডস, বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্টের সদস্যদের এনেছি। সবকিছু তো পুলিশ এককভাবে পারবে না, জনগণের সহায়তা লাগবে। জনগণ সচেতন হলে আমাদের কাজটা অনেক সহজ হবে। এত বড় একটা মেগাসিটি, এত বিরাট জনসংখ্যা। কোনো কিছুই সহজ না। ঢাকা মহানগরের শত বছরের যে বিকাশ, এখানে কারিগরি অনেক ত্রুটি আছে। এটাও সড়ক দুর্ঘটনার একটা কারণ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা চালাচ্ছি। আমরা ট্রাফিক শিক্ষার দিকে মনোযোগী হয়েছি। ট্রাফিক আইন মানা যদি আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে আনতে পারি, তাহলে সে ক্ষেত্রে সড়কে একটা শৃঙ্খলা নিশ্চয় আসবে।
প্রথম আলো: কারিগরি ত্রুটির বিষয়ে অন্য দপ্তরগুলোকে জানানো হয়েছে কি না?
মীর রেজাউল করিম: আমরা যখনই কোনো সমস্যা দেখি, পর্যবেক্ষণগুলো পাই, তখনই তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিই। সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে এসব বিষয় জানানো হয়েছে। একটা রাস্তা শুরুতে একভাবে দেখি যতখানি প্রশস্ত, মাঝখানে গিয়ে তা আবার সংকীর্ণ অবস্থায়। এটা একটা বড় সমস্যা। ইন্টারসেকশনগুলোতেও সমস্যা আছে। আমরা জানি, কোথায় কী সমস্যা।
প্রথম আলো: ঢাকার রাস্তার অনেক জায়গায় জেব্রা ক্রসিং নেই?
মীর রেজাউল করিম: ছাত্র আন্দোলনের পর সবাই এখন কাজ করছে। শহরের রাস্তার কোথায় কোথায় জেব্রা ক্রসিং দরকার, সেই তালিকা আমরা সিটি করপোরেশনকে দিয়েছি। এখন কিন্তু ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে। রাতে গিয়েও দেখবেন, সিটি করপোরেশনের লোকজন কাজ করছেন। যে শহরে মার্কিংগুলো (জেব্রা ক্রসিংসহ সংকেত চিহ্ন) ইনভিজিবল হয়ে গিয়েছিল, এখন তা দৃশ্যমান। জেব্রা ক্রসিংগুলো দৃশ্যমান, রোড লেনগুলো দৃশ্যমান আছে। ফুটওভারগুলো এখন মোটামুটি ব্যবহারযোগ্য, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়েছে। সব কর্তৃপক্ষই আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা সড়কে শৃঙ্খলা আনার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি।
বিমানবন্দর সড়কে এখনো দুর্ঘটনা হচ্ছে, লোকজন মারাও যাচ্ছে যত্রতত্র পার হচ্ছে পথচারীরা। ছবি :- আসাদুজ্জামান
বিমানবন্দর সড়কে এখনো দুর্ঘটনা হচ্ছে, লোকজন মারাও যাচ্ছে যত্রতত্র পার হচ্ছে পথচারীরা। ছবি :- আসাদুজ্জামান
প্রথম আলো: ঢাকা মহানগরীতে রাতে ট্রাফিক পুলিশ তেমন থাকে না, রাতেও সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে?
মীর রেজাউল করিম: রাতে সব জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ থাকে না, এটা সত্য কথা। তবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকে। পুরো ঢাকা শহরে রাতের বেলায় ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করার মতো অবস্থা আমাদের নেই। আমরা এই মুহূর্তে তা চিন্তাও করছি না। যেসব ইন্টারসেকশনে ট্রাফিক পুলিশ না থাকলে যানজট লাগার সম্ভাবনা থাকে, সেখানে আমরা ট্রাফিক পুলিশ রেখেছি। রাতের বেলা রাস্তা ফাঁকা থাকে, ট্রাক বা অন্য যানবাহনের চালকেরা তখন বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান।
প্রথম আলো: ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে (বিমানবন্দর সড়ক) এখনো দুর্ঘটনা হচ্ছে, লোকজন মারাও যাচ্ছে?
মীর রেজাউল করিম: পথচারীরাই মারা যাচ্ছেন। বিমানবন্দর সড়কটি রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে (সড়ক ও জনপথ বিভাগ) বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। সড়ক বিভাজনের দেয়াল টপকে পথচারীরা পার হচ্ছেন। এ সড়কে দ্রুতগতিতে যানবাহনগুলো চলাচল করে। লোকজন যাতে যত্রতত্র পার না হতে পারেন, সে জন্য আমরা একটা উদ্যোগ নিয়েছি, যা রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। সড়ক বিভাজনের যে দেয়াল আছে তারপরও আরও দুই থেকে আড়ই ফিট উঁচু বেড়া দেওয়া হচ্ছে। হোটেল র্যাডিসনের সামনে তা দৃশ্যমান। এটা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। লোকজন আর দৌড়ে পার হতে পারবেন না, যেখানে ফুটওভার ব্রিজ আছে সেখান দিয়ে পার হতে হবে।
প্রথম আলো: ঢাকার সড়কে যানবাহনগুলো এখনো বেপরোয়া গতিতে চলছে?
মীর রেজাউল করিম: আমরা যেভাবে শৃঙ্খলা চেয়েছি, হয়তো কাঙ্ক্ষিত শৃঙ্খলা আনা যায়নি। তবে একটা পরিবর্তন সড়কে এসেছে। যেখানে ট্রাফিক পুলিশ নেই, সেখানে গাড়ির দরজাগুলো খুলে ফেলছে। আমাদের যাত্রীদেরও দোষ আছে। যাত্রীরা রাস্তার মাঝখানে নামার জন্য চালকের ওপর চাপ প্রয়োগ করছেন। বিমানবন্দর সড়কগুলোতেও সেটা দেখেছি। আমাদের যাত্রীদের সভ্য হতে হবে। চালকদেরও সচেতনতার ঘাটতি আছে। এসব বিষয় নিয়েও কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের অর্জন শতভাগ না হলেও আমাদের অর্জন আছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
বিমানবন্দর সড়কে এখনো দুর্ঘটনা হচ্ছে, লোকজন মারাও যাচ্ছে যত্রতত্র পার হচ্ছে পথচারীরা। ছবি :- আসাদুজ্জামান
বিমানবন্দর সড়কে এখনো দুর্ঘটনা হচ্ছে, লোকজন মারাও যাচ্ছে যত্রতত্র পার হচ্ছে পথচারীরা। ছবি :- আসাদুজ্জামান
প্রথম আলো: সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে চালকেরা অনেকাংশে দায়ী?
মীর রেজাউল করিম: চুক্তিভিত্তিক চালানোর কারণে রাস্তায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা হচ্ছে। অধিক যাত্রী নেওয়ার প্রবণতা, ধাক্কাধাক্কি—এগুলো হচ্ছে। পরিবহন মালিক সমিতিও চাচ্ছে, চালকদের নিয়োগপত্র দেওয়ার। চালকেরা চুক্তিভিত্তিক কাজের মজাও হয়তো পেয়ে গেছেন, অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। চালকেরা চুক্তিতে চালাতে চান। তাঁরা চুক্তিতে চাইলে তো হবে না। আইনের মধ্যে আসতে হবে, নিয়োগপত্র দিতে হবে। আমরা মালিক সমিতির সঙ্গে মিটিং করেছি। তারা নিয়োগপত্র দেওয়ার কার্যক্রমও শুরু করেছে। আশা করি, এ ব্যাপারে দ্রুত একটা ফয়সালা হবে।
প্রথম আলো: অ্যাপসের মাধ্যমে ঢাকায় যানবাহন চলছে, অনেক অভিযোগও আসছে?
মীর রেজাউল করিম: সরকার রাইড শেয়ারিং নীতিমালা করেছে। রাইড শেয়ারিংয়ের কয়েকটা প্রতিষ্ঠানকে আমরা ডেকেও এনেছি, কথা বলেছি। নতুন একটা বিষয় এলে ঢেউ আসে, আস্তে আস্তে তা আবার নিয়ন্ত্রণেও আসে। এখন রাস্তায় মোটরসাইকেলের সংখ্যা অনেক বেশি। লোকজনের অর্থনৈতিক সংগতি বেড়েছে, মোটরসাইকেল কিনতে পারছে, গাড়ি কিনতে পারছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে এগুলো সম্পৃক্ত। শৃঙ্খলা চলে আসবে।
প্রথম আলো: ঢাকার সড়কে ট্রাফিক সিগন্যাল ঠিকঠাকমতো কাজ করে না?
মীর রেজাউল করিম: ঢাকা মহানগরের ট্রাফিক সিগন্যালের কার্যক্রম দেখে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সম্প্রতি আমরা তাঁদের সঙ্গে মিটিং করেছি। তাদের প্রজেক্ট শেষ হবে আগামী ৩১ ডিসেম্বর। তাদের ভাষ্য মতে, ঢাকার ১০০টা ইন্টারসেকশন নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে ১২ টি ইন্টারসেকশনের লাইট ঠিক আছে। তবে আমরা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় লাইট ইন্সটোলেশন এখনো পাইনি। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমাদের কাছে হস্তান্তর করবে সিটি করপোরেশন।
প্রথম আলো: সড়ক দুর্ঘটনা রোধ এবং দায়ীদের ধরার জন্য সিসি ক্যামেরা বড় ভূমিকা রাখতে পারে?
মীর রেজাউল করিম: সিসি ক্যামেরাগুলো ঢাকার সড়কের ইন্টারসেকশনগুলোতে আছে। সব জায়গায় তো আর সিসি ক্যামেরা নেই। টেকনোলোজি পৌঁছাতে সময় লাগবে। পুরো ঢাকা শহর সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে সময় লাগবে। আমরা বলছি, ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যকে নিরাপদ রাখুন।
বাংলাদেশ সময়: ১০:৩৭:৪১ ৫২৫ বার পঠিত #রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থী