বঙ্গ-নিউজঃ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিলেটে সমাবেশের অনুমতি পাওয়া এখনও নিশ্চিত নয়। যদিও তারা ২৩ অক্টোবরের পরিবর্তে ২৪ অক্টোবর সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছে। তবে এখনও অনুমতি মেলেনি। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন জানিয়েছে, নিরাপত্তার কারণে ২৩ অক্টোবরে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না, এটা নিশ্চিত। তবে ২৪ অক্টোবর করতে পারবে কি-না, তা এখনও নিশ্চিত নয়। এই কর্মসূচিকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ উত্তেজনা বিরাজ করছে। ঐক্যফ্রন্ট নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন, সমাবেশের অনুমতি না পেলেও তারা সিলেট যাবেন। সমাবেশের অনুমতি কেন দেওয়া হবে না জানতে চেয়ে গতকাল শনিবার উকিল নোটিশও পাঠানো হয়েছে সিলেটের স্থানীয় প্রশাসনের কাছে।
বিগত সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশের পর এটাই ছিল তাদের প্রথম কর্মসূচি। এর আগে গত ২৭ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ও বিএনপি রাজধানীতে একই দিনে কর্মসূচি ঘোষণা করে। পরে বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৩০ সেপ্টেম্বর সমাবেশের অনুমতি পায়।
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একাদশ জাতীয় সংসদের তফসিল ঘোষণার কথা জানানো হয়েছে। ফলে দেশের রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে নির্বাচনী আমেজ তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ও জাতীয় পার্টি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বিঘ্নেই সভা-সমাবেশের সুযোগ পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারবিরোধী জোটের সমাবেশে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, নিরাপত্তার কারণে সমাবেশ আয়োজনের কোনো বিষয় থাকলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সুনির্দিষ্টভাবে আয়োজকদের অবহিত করা উচিত। অন্যথায় দেশের চলমান নির্বাচনী আবহ বিনষ্ট হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। ইসির পক্ষ থেকে দেওয়া বক্তব্যকেও তার দায়সারাগোছের বলে মন্তব্য করেছেন।
এদিকে, ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন সমকালকে জানিয়েছেন, কী কারণে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না— তা জানতে চেয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে গতকাল সন্ধ্যায় উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। জবাব পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে তিনি আইনি লড়াইয়ে নামবেন বলে জানান।
এর আগে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ২৩ অক্টোবর মঙ্গলবার সিলেটে সমাবেশের অনুমতি চাওয়া হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো না হলেও আয়োজকরা অনুমতি না পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে সময় পাল্টিয়ে আবেদন জানান। সিলেট বিএনপির পক্ষ থেকে নতুন আবেদনে আগামী বুধবার ২৪ অক্টোবর নগরীর রেজিস্ট্রারি মাঠে সমাবেশের জন্য প্রশাসনের অনুমতি চাওয়া হয়। আবেদনের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সিলেটের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সেলিম মিয়া মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদকে জানিয়ে দেন, ২৪ অক্টোবরও নিরাপত্তার কারণে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। সমকালের পক্ষ থেকে কোতোয়ালি থানার ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অনুমতি না দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তবে গতকাল সন্ধ্যায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার পরিতোষ ঘোষ সমকালকে জানান, ২৩ ও ২৪ অক্টোবরের জন্য সমাবেশের আবেদন তারা পেয়েছেন। এ বিষয়ে এখনও তারা সিদ্ধান্ত নেননি। সিদ্ধান্তের বিষয়টি আবেদনকারীকে পরে জানানো হবে। পরিতোষ ঘোষ জানান, কোতোয়ালি থানার ওসিকে নিরাপত্তার বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
সিলেট জেলা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র ও জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামীম সমকালকে বলেন, মাজার জিয়ারতের যে কর্মসূচি ছিল, তা থাকবে। সমাবেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে ওপরের নির্দেশের কথা বলা হয়েছে।
তবে ওই দিন সমাবেশ করতে না পারলেও সিলেটে বড় ধরনের গণজমায়েতের ইঙ্গিত দিয়ে কাহের চৌধুরী বলেন, চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া সিলেটে মাজার জিয়ারত করতে আসার দিনও কোনো সমাবেশ ছিল না। কিন্তু সেদিন লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল। সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামতেই পারে।
এদিকে, বিরোধী জোটের নির্বিঘ্নে সমাবেশ করতে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম গতকাল সমকালকে বলেন, সভা-সমাবেশের অনুমতি দেওয়া বা বাতিলের বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এটা পুরোপুরি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে জড়িত। সিলেটে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশের অনুমতির বিষয়ে তিনি বলেন, এটা রাজনৈতিক বিষয় এবং আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিষয়। রাজনীতি বা আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিষয় ইসির দেখার কথা নয়। তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণার পর কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীর নির্বাচনী সমাবেশ দেখার বিষয়টি ইসির ঘাড়ে বর্তাবে। কিন্তু নির্বাচনী সমাবেশ ছাড়া অন্য কোনো দাবি বা ইস্যুতে কেউ কোনো সমাবেশ করতে চাইলে সেটা নিশ্চিত করার দায় ইসির নয়।
তবে ইসির এ বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি বলেন, ‘দেশে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি হচ্ছে কি-না, সেটা দেখার বিষয় অবশ্যই ইসির। কমিশন সদস্যদের ভুলে গেলে চলবে না যে তারা সাংবিধানিক পদে রয়েছেন। পদের মর্যাদা রক্ষা না করে তারা সাধারণ সরকারি কর্মকর্তার মতো কাজ করছেন। তারা যে কেরানি নন, এটা তাদের মনে রাখতে হবে। ‘
সৈয়দ আবুল মকসুদ আরও বলেন, সরকারের শরিক দল ও জোটের সবাই সভা-সমাবেশের সুযোগ পেলেও বিরোধীদলীয় জোটকে সমাবেশের সুযোগ না দেওয়ায় সরকারেরই ক্ষতি হচ্ছে। গত আট-দশ বছরে বিরোধী জোটের সভা-সমাবেশে নাশকতার কোনো নজির নেই। সরকারের এই পদক্ষেপের ফলে উন্নয়ন সহযোগীরা নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণে হতাশ হয়ে পড়বেন। এতে বিরোধী দলের নির্দলীয় সরকারের দাবির যৌক্তিকতাও জোরালো হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে সভা-সমাবেশের বিষয়ে পুরোপুরি দায়-দায়িত্ব ইসির ওপর বর্তাবে। সেখানে নির্বাচনী সমাবেশ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কারণ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়ে ইসির দায় রয়েছে।
সিলেটে ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশের অনুমতি প্রসঙ্গে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সিলেটের সমাবেশের আয়োজকদের কারও কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলার কথা বলা হয়েছে। সেসব কারণে যদি সমাবেশ করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়; তাহলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া উচিত। এখানে লুকোচুরির কোনো বিষয় নেই। তবে সিদ্ধান্ত যা-ই হোক, তা স্বচ্ছ হতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, প্রশাসনের এই আচরণ নির্বাচনীকালীন নিরপেক্ষ সরকার-সংক্রান্ত বিরোধী দলের দাবির যৌক্তিকতাকেই জোরালো করছে। কেননা আয়োজকদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা দেশের আইন-আদালতে ফয়সালা হবে। মামলার অজুহাতে কারও সভা-সমাবেশ করার সাংবিধানিক অধিকার আটকে দেওয়ার সুযোগ নেই। সমাবেশ আয়োজনের ক্ষেত্রে অন্য কোনো নিরাপত্তার ইস্যু থাকলে তাও দূর করতে হবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই।
গণজমায়েত করতে চায় বিএনপি :সিলেট ব্যুরো জানায়, সমাবেশের অনুমতি না পেলেও ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের আগামী বুধবার সিলেটে আসার কথা। এই সফরে হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহপরাণের (রহ.) মাজার এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর কবর জিয়ারতের কথা রয়েছে। গত শুক্রবার ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক শেষে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু জানিয়েছিলেন, অনুমতি না পেলেও ২৪ অক্টোবর সিলেট সফরে যাবেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। এই সফরে মাজার জিয়ারতের পাশাপাশি সিলেট নগরীতে সমাবেশ করার কর্মসূচি ঘোষণা দেন তিনি।
গত ১৬ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রথম বৈঠক শেষে ২৩ অক্টোবর সিলেট সফর ও সমাবেশ দিয়ে ফ্রন্টের যাত্রা শুরুর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ওই দিন সমাবেশের অনুমতি না মেলায় ২৪ অক্টোবর বুধবার সমাবেশ করার লক্ষ্যে শুক্রবার রাতেই জেলা বিএনপির এক নেতার বাসায় বৈঠক করেন স্থানীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। গতকাল শনিবার সকালে সিলেট বিএনপির শীর্ষ নেতারা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। মহানগর পুলিশ কমিশনার অফিসে না থাকায় বিএনপির নেতারা গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার পরিতোষ ঘোষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বিএনপির এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন, কেন্দ্রীয় সদস্য ডা. শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী, কেন্দ্রীয় সদস্য ও সিলেট জেলা বিএনপি সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামীম, জেলার সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ, সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট নুরুল হক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল গাফফার।
মহানগর বিএনপির প্রস্তুতি সভা :এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিলেট সফর সামনে রেখে শুক্রবার রাতে মহানগর বিএনপির অস্থায়ী কার্যালয়ে এক প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকির সভাপতিত্বে ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আজমল বখত সাদেকের পরিচালনায় সভায় ২৪ অক্টোবর ঐক্যফ্রন্টের কর্মসূচি সফল করতে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাজার প্রতিবাদে আজ রোববার কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে কালো পতাকা মিছিলের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এ ছাড়া সভায় আগামী ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ‘ফরমায়েসি’ রায় প্রদান থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:২৩:০৯ ৪৬৫ বার পঠিত #জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিলেটে সমাবেশের অনুমতি পাওয়া এখনও ন