বঙ্গ- নিউজ ডটকমঃ গ্রামীণ ব্যাংক ভালোভাবেই চলছে, এর কাঠামো পুনর্গঠনের দরকার নেই। সরকারের মালিকানা বাড়ানো হলে এটি আরেকটা দায়ে পরিণত হবে।
দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদেরা এসব কথা বলেন।এমনকি বর্তমান সরকারের একজন মন্ত্রীও এর সমালোচনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, সরকারের উদ্যোগে রাজনৈতিক জেদের বশে গ্রামীণ ব্যাংকের কাঠামো ভাঙা হচ্ছে।
সম্প্রতি সরকার গঠিত গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন গ্রামীণ ব্যাংককে ১৯ বা ততোধিক স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর এবং এতে সরকারি শেয়ারের পরিমাণ ৫১ শতাংশে উন্নীত করার সুপারিশ করেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও গ্রামীণ ব্যাংকের একসময়ের চেয়ারম্যান আকবর আলি খান মনে করেন, গ্রামীণ ব্যাংকের পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত ঋণগ্রহীতা গরিব সদস্যদের কাছ থেকে আসা উচিত। কেননা গরিব মানুষ কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয় না।
আকবর আলি খানের মতে, সফল আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক কাজ করছে। কোনো গ্রাহক এ পর্যন্ত কোনো অভিযোগ করেননি। তাঁরা ঋণ নিচ্ছেন, আবার তা ফেরতও দিচ্ছেন। তাহলে কেন পুনর্গঠন দরকার। তিনি বলেন, ৫১ শতাংশ মালিকানা সরকার নিতে চায় আইন সংশোধন করে। কিন্তু বিগত ৪০ বছরে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান লাভজনকভাবে পরিচালিত করতে পারা যায়নি। এভাবে করলে আরেকটা দায় সৃষ্টি হবে। তিনি মনে করেন, যেভাবে গ্রামীণ ব্যাংক চলছে, সেভাবেই চলতে দেওয়া উচিত। হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কেন গ্রামীণ ব্যাংক পুনর্গঠন করব? অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস চলে যাওয়ার পর গ্রামীণ ব্যাংক ভালোভাবে চলছে। তাহলে কেন আবার গ্রামীণ ব্যাংক ভেঙে পুনর্গঠন করা হচ্ছে? একটা প্রতিষ্ঠান যদি ভালোভাবেই চলে, তবে নতুন করে পুনর্গঠনের প্রয়োজন নেই।’
মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, ‘সরকারি মালিকানায় গেলে কী হয়, তা আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারি। সরকারি মালিকানাধীন শুধু আর্থিক খাত নয়, উৎপাদন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত পুঞ্জীভূত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এতে শুধু ভর্তুকির পরিমাণই বেড়েছে। নামমাত্র সুদে ঋণ দেওয়া হয় এসব প্রতিষ্ঠানকে। এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তাই সরকারি মালিকানায় গেলে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম ব্যাহত হবে। যে উদ্দেশ্যে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত, তা-ও ব্যাহত হবে।
রাজনৈতিক জেদের বশেই সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংস করতে চাইছে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, এর জন্য কোনো বিশ্লেষণ প্রয়োজন হয় না। রাজনৈতিক জেদের কারণে বর্তমান সরকার ব্যাংকটির কাঠামো পরিবর্তন করে খণ্ড খণ্ড করতে চাইছে। এই ব্যাংকটির সব সফলতাকে ব্যর্থ করতে চাইছে। এটা অর্থনৈতিক বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশের কল্যাণে কোনো কাজে আসবে না।
হোসেন জিল্লুর মনে করেন, সরকারের এ ধরনের চিন্তাভাবনার পেছনে তিনটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, ব্যাংকটি ভালো করছে না; দ্বিতীয়ত, সুশাসনের প্রচণ্ড অভাব রয়েছে; তৃতীয়ত, আরও উন্নতি করা দরকার। অথচ অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ড. ইউনূস চলে যাওয়ার পর গ্রামীণ ব্যাংক ভালো করছে। আর গ্রামীণ ব্যাংক ভালো করেছে বলেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছে।
পল্লী বিদ্যুৎ কিংবা শিল্প ব্যাংকের আদলে গ্রামীণ ব্যাংকের কাঠামো পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ দুটি প্রতিষ্ঠান কি আদৌ ভালো করতে পেরেছে? আমরা জানি, এই দুটি প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারেনি।’
গ্রামীণ ব্যাংককে ১৯ টুকরা করার গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদের বলেন, ‘নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের বিরাট সম্পদ। বাংলাদেশের কখনোই কোনো ক্ষতি করেননি তিনি। অথচ তাঁকে আমরা যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি। যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা পাশ্চাত্য দেশ, এমনকি আরব দেশগুলোও মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে আমাদের কর্মকাণ্ডে খুশি নন। তাঁকে নিয়ে আমরা যা করছি, তাতে আমাদের দেশের গ্রামের মানুষেরাও অখুশি।’
ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফিন্যান্সের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক এম এ বাকী খলীলী বলেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের যে সুপারিশ পত্রপত্রিকা থেকে জানতে পেরেছি, তা একেবারেই অনভিপ্রেত।’ দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির বিশ্ব পরিচিতি ও স্বীকৃতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখার মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার চিন্তাটি অবান্তর ও অবাস্তব।’
বাকী খলীলী আরও বলেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের রাজনৈতিক কোনো দৃষ্টিভঙ্গির কথা আমি বলব না, তবে ৫১ শতাংশ মালিকানা সরকারের হাতে রাখার সুপারিশের বাস্তবায়ন হলে শঙ্কা জাগে, এত সুন্দর একটি প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো হয়ে যায়।’
বাংলাদেশ সময়: ১০:১০:৪৪ ৪৪৯ বার পঠিত