16 তম কিস্তি—
তালোড়া শাখায় 11 মাস- দশম পর্ব।
আমি আর রফিক সাহেব কত যে রঙ্গ -রসিকতা করতাম তার কোন ইয়াত্তা নাই। তালোড়ার এক ভদ্রলোক ,নাম বোধ হয় রাখাল বাবু তার সাথে আমাদের খুব ঘনিষ্ঠতা হলো। উনি একজন ভারত -বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং সদাই তা প্রমানে সচেস্টও ছিলেন। একদিন রফিক সাহেব বলে বসল আপনি তামিল ভাষা জানেন? উত্তর না বোধক ছিল। রফিক সাহেব বললো আমি তামিল, মালায়ালাম ও কানাড়ী ভাষা জানি এবং আমার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বললেন উনিও জানেন। রাখাল বাবু খুব করে ধরলেন উনি শিখবেন। সাথে জুটলো আর এক ব্যবসায়ী আহাম্মাদ আলী। উভয়ই শিখতে চায় তামিল ভাষা। অফিস শেষে আহম্মদ আলী ভাই এর দোকানে বসত আড্ডা। রফিক সাহেব সেখানে সবক দেয়া শুরু করে , “বাগাডুলিছে কমড়ি ওয়া চমড়ি, হই হই হই। ”আমাকে অনুবাদ করে দিতে বলে সাথে অবশ্য একটা চোখ ইশারাও দেয়। আমি অনুবাদ করি এ কথার অর্থ হল আপনারা কি সত্যিই শিখতে চান? দুজনেই বলে হ্যাঁ হ্যাঁ। রফিক সাহেব বলেন বলতে হবে তামিলে “উকড়ি।” আমি সাথে সাথে বিজ্ঞের মত বলে উঠি “উকড়ি “ মানে ”অবশ্যই।” দুই জনের মধ্যে আহম্মদ আলী ভাই বেশী রসিক হলেও ক অক্ষর গো মাংশ। তাকে নিয়েই বেশী মজা হতো। প্রায়ই অফিস শেষে সবাই এসে জুটতো আর অদ্ভুদ ভাষা শেখার অদ্ভুদ আসর বসতো আহম্মদ আলী ভাই এর দোকানে । ভাষা বিশেষজ্ঞ রফিক সাহেবের পাঠদানের সময় মাঝে মাঝে উপস্থিত থাকতো দারোয়ান হাবিল। রফিক সাহেবের অঙ্গভঙ্গি দেখে এক দিকে কাত হয়ে মুখে হাত দিয়ে সে কেবল হাসতো। আর রমিজ সাহেব হো হো করে হেসে উঠত। আহম্মদ ভাইয়ের এ সব হাসি সহ্য হত না ,বলত প্রথম প্রথম একটু –আধটু ভুল হতেই পারে। এতে হাসির কি আছে ?
”উকড়ি” শব্দটি কিভাবে উচ্চারণ করতে হবে তা শিখতে আহম্মেদ ভাই গলদ ঘর্ম হতেন। রফিক সাহেব দুই চোয়াল ধরে পেটে চাপ দিয়ে ধরতো আর আহম্মদ ভাইকে বলতো নাক বন্ধ করে উচ্চারন করুন ”উকড়ি”। না হচ্ছেনা। আবার চেষ্টা করুন। রফিক মাঝে মধ্যেই জ্ঞান দান করতেন নতুন ভাষা শিখতে হলে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আর পাঞ্জাবী লুঙ্গি পড়া লম্বা দাড়িওয়ালা আহম্মদ ভাই পরম নিষ্ঠার সাথে ”উকড়ি ”শব্দটির উচ্চারণ শেখার কসরত করতো। কিছু দিন পর আহম্মদ ভাই জানালো “উকড়ি ” শব্দটির উচ্চারণ শেখা তারপক্ষে বোধ হয় আর সম্ভব হবেনা। কারণ তার বুক তলপেট ব্যাথা করে। আর যে দেশের লোক এরুপ অদ্ভুতভাবে উচ্চারণ করে তারা ভাল থাকে যে কেমনে এ বিষয়ে আহম্মদ ভাই ঘোরতর সন্দেহের উদ্রেক হয়। শুণ্যস্থান পূরণের জন্য আমি বলি আহম্মেদ ভাই ওদের সবার না এ ভাষা উচ্চারণ করতে যেয়ে শেষ বয়সে পিঠের ব্যাথা হয়। ওরা না সবাই তখন ২টা করে লাঠিতে ভর দিয়ে হাটে। আহম্মদ ভাই ওদেশের লোকদের বেকুফ মনে করে ভাষা শেখার আগ্রহ হারাতে বসে। রাখাল বাবু তো আগে থেকে এ ভাষার যথার্থতা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্ধে আছেন। শেখার প্রতি তার কোন আগ্রহ দেখা যাচ্ছেনা , তবে গভীরভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষন করে যাচ্ছেন। এক পর্যায়ে আহম্মেদ ভাই প্রস্তাব দিয়ে বসে ম্যানেজার সাহেবকেও এ ভাষা শেখাতে হবে। রফিক সাহেব মাথা নেড়ে ছলনা করে বলেন উনি তামিল ভাষা জানেন। ম্যানেজার সাহেবের সাথে আহম্মদ ভাইয়ের খুব রসিকতার সম্পর্ক ছিল। আহম্মেদ ভাই বলে বসে আমাকে একটা কথা শিখিয়ে দেন যা আমি ম্যানেজারকে বলতে পারি। রফিক সাহেব রাজী হয়। বলেন ম্যানেজার সাহেবের সাথে দেখা হলে আপনি বলবেন ”ফোকা কূ”। এর মানে? আপনি কেমন আছেন ? এরপর শুরু হয় উচ্চারণ পদ্ধতি। আহম্মেদ ভাই লম্বা মানুষ। রফিক সাহেব শিখিয়ে দেয় প্রথমে আপনি কোমড় হেলিয়ে ম্যানেজার সাহেবের কানের কাছে গিয়ে এক নিশ্বাসে বলবেন ”ফোকা ”তার পর দীর্ঘটানে চিৎকার করে বলবেন ”কূ –উ-উ- উ।” রফিক সাহেব তাকে বারবার প্রাকটিস করাতে থাকেন আর হচ্ছে না হচ্ছে না বলে তাকে গলদঘর্ম করে তোলেন। অবশেষে ওকে হয়। পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আহম্মদ ভাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আর আমার মাঝে অস্বস্তির সৃষ্টি হয় । ভাবি এ সব করা ঠিক হচ্ছে কিনা । রফিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাই। কিন্তু তিনি হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে সব কিছু তে এত সিরিয়াস হতে না করে। আমি ভাবি তামিল ভাষার কাল্পনিক কিছু শব্দ শিখাতে যেয়ে সবাই মিলে একটি সিরিয়াস খেলায় মেতে উঠছি তার ফলাফল ভাল নাও হতে পারে। যা হোক ম্যানেজার সাহেব প্রত্যহ আহম্মেদ ভাইয়ের দোকানের (গদীঘর) সামনে দিয়েই আসতো। ঠিক হল পরদিন সকালে প্রত্যহের মতই আহম্মেদ ভাই ম্যানেজারের কুশল জিজ্ঞাসা করবে – তবে এবার তামিল ভাষায়। রুমে এসে এ নিয়ে দুঃচিন্তা করছি দেখে রমিজ সাহেব বলল , বাদ দেন ,দেখেন আহম্মেদ ভাই কোনও দিনও ম্যানেজারকে এসব বলতে যাবেনা। আমারও তাই মনে হল। ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সবাই অফিসে এসেছে । কিন্তু ম্যানেজার সাহেবের আসতে লেট হচ্ছে কেন ভাবছি , এমন সময় তিনি ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে অফিসে ঢুকতে ঢুকতে বলতে থাকেন রফিক সাহেব আহম্মদ ভাই মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। আমি অফিসে আসছি আর সারা রাস্তায় আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করে খালি ফোক কূ না কি ফোকা টু বলে। আপনি নাকি শিখিয়ে দিয়েছেন। ও একটা মূর্খরে ভাই। না হলে রাস্তায় মানুষ জনের মধ্যে কি এরূপ করে । রফিক সাহেব মুখটা গম্ভীর করে ততোধিক গম্ভীরভাবে শুধু বলেন আচ্ছা আমি বিষয়টি দেখছি। ম্যানেজারও শান্ত হলেন। দেখলাম অভিনয় গুন থাকলে যে কোন ক্রিটিক্যাল সিচ্যুয়েশনও সামাল দেয়া যায়। রফিক সাহেব বরাবরের মত সেভাবে আজও সামাল দিলেন।
এত বছর পর ভাবছি একটু বাড়াবাড়ি হলেও এটা এক ধরনের বিনোদন ছিল। হয়তো বা রফিকীয় ষ্টাইল। জানি কোন কোন পাঠক এটাকে ফাজলামির পর্যায়ে ফেলবেন। তবে এপ্রিল ফুল হিসাবে এটা করলে তারা হয়ত একে উচ্চমার্গীয় বিনোদন হিসাবে স্বীকৃতি দিতেন। সে সময় ফেসবুক ছিলনা , টিভির উদ্ভট সিরিয়াল ছিল না। এভাবেই মানুষ সময় কাটাতো। আমরা বাল্য কালে নানা ভাবে সহপাঠিদের বোকা বানিয়ে মজা পেতাম। বাড়ীর আড়ালে লুকিয়ে থেকে অকস্মাৎ বিকট চিৎকার করে কারো সামনে হাজির হতাম । পরবর্তীতে এ কাজে মুখোসও ব্যবহার করা হত। বিষয়টা সামান্য হলেও পদ্ধতিটি আবহমান বাঙালরি সংস্কৃতিরই একটি অংগ। সে সময় বাড়ী আর অফিস ,অফিস আর বাড়ী এ রকম ছিল না। অফিস শেষে যানযটে পড়ে থাকতেও হত না। সমমনা গ্রাহকদের সাথে আড্ডা জমতো। ব্যাংকের ব্যবসায়িক সম্পর্কের বাহিরেও তৈরী হত একটা সামাজিক সম্পর্ক। বিশেষ করে জেলা শহর থেকে অনেক দুরে তালোড়ার মত স্থানে আত্বীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের স্থান দখল করত স্থানীয় গ্রাহক সমাজ। হাত বাড়ালে এখনও বন্ধু মিলে। তবে এজন্য মনের মত মন থাকা চাই।
ভালই দিন কাটছিল । কিন্তু কয়েক মাস বাদেই আমার মাঝে কতিপয় টেনশন দেখা গেল।(ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ৮:৪৮:৩১ ৬৯৬ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম