“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
শুক্রবার, ১২ অক্টোবর ২০১৮



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

চতুর্দশ কিস্তি—
তালোড়া শাখায় 11 মাস- অষ্টম পর্ব।

ডেমাজানি (বর্তমানে নয় মাইল হাট শাখা নামে স্থানান্তরিত) শাখা, বগুড়া । আমি ম্যানেজার ,সেই কেয়ার টেকার আমিনুর তখন ক্যাশিয়ার । ব্যাংক ভবন থেকে প্রায় মাইল তিনেক দুরে ফুলকোট নামক গ্রামে আমিনুরদের পৈত্রিক বাড়ী। সেখান থেকে প্রত্যহ হেঁটে হেঁটে অফিসে আসে । শাখার সবাই আমাকে চেপে ধরল আমি যেন আমিনুরকে একটা সাইকেল কেনার বুদ্ধি দেই। যুক্তিযুক্ত প্রস্তাব। তাছাড়া সাইকেলের প্রতি আমি খুব দুর্বল । আমার দাদার একটি ফিলিপস কোম্পানীর সাইকেল ছিল । দশ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। হ্যান্ডেলের উপর খোদাই করা “মেড ইন ইংল্যান্ড ” লেখাটা উনি সবাইকে গর্ব করে দেখাতেন। বলতেন খাঁটি বিলেতী জিনিস। ।

আসলে সে সময় বাইসাইকেল ছিল সড়ক যোগাযোগের জনপ্রিয় ও অভিজাত বাহন। গ্রামের মেঠোপথে চলত সাইকেল , শহরের পাকা সড়কে চলত সাইকেল। ষাটের দশকের শুরুতে জাপানের তৈরি হোন্ডা-৫০ মোটরসাইকেল আমদানি হয়ে এলে গ্রামের গেরস্ত ও শহরের মধ্যবিত্তরা জাপানের হোন্ডা ব্রান্ডের মোটর সাইকেল কেনা শুরু করেন। বাইসাইকেলের কদর থাকার পরও তখন থেকে মোটরসাইকেল রাস্তার রাজা হতে থাকে।

সেময় নামকরা বাই সাইকেল ছিল রেলি সাইকেল ।আমি আমিনুরকে বুদ্ধি দিলাম একটি রেলী সাইকেল কিনতে । বিয়ের সময় নতুন জামাইয়ের উপহার চাহিদা ছিল রেলি বাইসাইকেল। হ্যান্ডেল বা স্টিয়ারিংয়ের হাতলের নিচে ব্রেক, বেল। চিকন টায়ারের ভেতরে টিউব। এই টায়ারে বোতলের মত ডায়নামা ঘুরিয়ে সামনে বাতি জ্বালানো হতো। চাকা ঘোরাবার জন্য প্যাডেলের সঙ্গে চেন। চেন কভার। ছোট্ট একটু বসার জায়গা। সীট কভার। একজনের চলার জন্য নির্মিত বাইসাইকেলে চালকের আসনের সামনের লম্বা রডের ওপর আরেকজন বসত। পেছনে জিনিসপত্র রাখার কেরিয়ারেও একজন বসতে পারত। ।আমিনুর কিনলে রেলি সাইকেলই কিনুক।কিন্তু আমিনুর সাইকেল কিনতে কিছুতেই রাজী না ।

সেসময় কলেজে দূরের শিক্ষার্থীরা সাইকেলে চেপে আসত। ষাটের দশকে পুলিশও দায়িত্ব পালনে বাইসাইকেল ব্যবহার করত।সে তুলনায় আমিনুর কত বড় লাটসাহেব ? সাইকেল চালাতে তার অসুবিধা কি ?আমার জেদ চেপে বসল।

মাঝে মাঝেই তাগাদা দেয়া শুরু করলাম। বললাম-টাকার সমস্যা ? সে বলে ” না টাকার সমস্যা নাই। আমি তো ঠিকমত সাইকেল চালাতে জানিনা ,অভ্যাস নাই” ইত্যাদি। সবাই মিলে অভয় দেই। আরে ,কিনলে চালাতে শিক্ষতে আর কতক্ষণ? অবশেষ একটা সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল সে কেনে। রেলি কিনা তা এখন আর কিছুতেই মনে করতে পারছি না। তবে আমি খুশী হই। কিন্তু ৭/৮ দিন পর এলাকার এক গ্রাহক জানায় যে, ক্যাশিয়ার সাহেবতো হেঁটে হেঁটে অফিসে আসেন। তিনি নিজে দেখেছেন। আমি বললাম সাইকেল তো কিনলো। গ্রাহক জানালো হেঁটে আসার সময় সাইকেল তার হাতে থাকে তবে সে তাতে চড়েনা। আমি বুঝলাম সে এখনও সাইকেল চালানো রপ্ত করতে পারে নাই। ডাকলাম তাকে। কিন্তু সে বলল ” আমি ছোট বেলা থেকেই সাইকেল চালাতে পারি। প্র্যাক্টিস ছিলনা , তাই কাউকে বলিনি। আমার বাবারও সাইকেল ছিল। “ বুঝলাম গ্রাহক সাহেব ভুল তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু সপ্তাহখানেক পর অফিসের পিওন আবার একই কথার পুনরাবৃত্তি করলো। ক্যাশিয়ার সাহেব সাথে সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে অফিসে আসেন। এতা মহা জ্বালারে। ক্যাশিয়ার তখন টাকা গুনতে মহাব্যস্ত। ধীরে ধীরে গনে। আঙ্গুল চলে কি চলে না। তবে অতিশয় সৎ এবং স্থানীয় বলে গ্রাহকরা ধৈর্য্যচ্যুত হয়ে তার উপর চড়াও হয় না। এ সময় বেশী কথা বলা যাবে না। শুধু শুধালাম আমিনুর তুমি সাইকেল চালানো সত্যি সত্যিই জানো কিনা। বলে কি ”স্যার আগে থেকেই জানতাম ,এখন বাড়ীতে প্র্যাকটিস করে আরো পাকা হয়েছি।”
পড়ে গেলাম এক মহা গোলক ধাঁধায়। কিন্তু ব্যাংকে কাজের চাপে বিশেষ করে কৃষি ঋণ বিতরণের চাপে বিষয়টি আপাততঃ ভুলে গেলাম।
একদিন একটু সকাল সকাল অফিসে গেছি। অস্থায়ী টি বয় রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করলাম বিষয়টি। সে বললো ”নিজের চোখেই দেখবেন, আসেন। ”চললাম তার পিছু পিছু, আমিনুর যে মেঠো পথ দিয়ে আসে সেই পথে। 15/20 মিনিট হাঁটার পরই আমিনুরের সাক্ষাৎ পেলাম। হ্যাঁ, সত্যিই তো। সে সাথে সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে অফিসের দিকে আসছে। কখনো হ্যান্ডেলের বাম প্রাপ্ত ডান হাত দিয়ে ধরছে কখনও ডান প্রাপ্ত। এতে এক এক সময় এক এক স্টাইলের সৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু বেচারার অনেক কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো সাইকেলের বোধ হয় পাম্প নাই। টায়ার টিপে টুপে টোকা দিয়ে দেখলাম ফুল পাম্প। তাহলে রহস্যটা কি?
রহস্য আমিনুরই জানালো- স্যার আজকাল মানুষ আর ভাল নাই। রাস্তায় গরু -বাছুর বেঁধে রাখে, বেল বাজালেও সরেনা। মাঝে মধে আমারও বেল দেয়ার কথা মনে থাকে না।ব্রেক ধরার কথাও ভুলে যাই। প্রথম প্রথম কয়েক দিন চেষ্টা করেছি। এর সাথে ওর সাথে ধাক্কা লাগে। তাই এখন সাইকেলে আর চড়িনা। হেঁটেই আসি। হেঁটেই আসো ,তাতো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু হেঁটেই যদি আসো, তাহলে অযথা সাইকেল কেন সাথে? স্যার আপনি যদি মাইন্ড করেন। কি বলে ,আমি কেন মাইন্ড করব। ”অনেক বলে কয়ে আমার ভালর জন্যই তো সাইকেল কিনতে বলেছিলেন। সে কি আর আমি বুঝি না। কিন্তু রাস্তা ঘাটের এই অবস্থা কি আর করা। ”-আমিনুরের এ কথাতে আমরা মজলাম না।

আমি আর রাজকুমার মিলে তাকে অনেক বুঝালাম। অভ্যাস হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। অগ্যতা রাজী হলো আগামী কাল থেকে সাইকেলে চড়েই সে আসবে। রাজকুমার জানাল ক্যাশিয়ার সাহেব এখন সাইকেলে চেপেই অফিসে আসছে। আমি নিজেকে একজন সার্থক মোটিভেটর হিসাবে ভাবা শুরু করলাম। ইতোমধ্যেই প্রায় মাস খানেক পার হয়েছে। আমিনুরের সাইকেল চালাতে আর অসুবিধা হবে না।

ঐ শাখার ভল্টের চাবি ৩ জনের কাছে থাকতো। প্রথমে খুলে দিতাম আমি। তারপর ২য় কর্মকর্তা, শেষে ক্যাশিয়ার আমিনুর । সেদিন আমাদের চাবি দিয়ে খুলেছি। এক প্রাইমারী শিক্ষক টাকার জন্য চেক নিয়ে দন্ডায়মান। ২য় কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করলাম ,আমিনুর কি এখনও আসেনি ? উত্তর না বোধক। বললাম ,কাউকে দিয়ে কি চাবি পাঠায়েছে ? অসুস্থ থাকলে বা নিকটাত্মীয় মারা গেলে ব্যাংকাররা মাঝে মাঝে তা করে থাকে । অন্যথায় ব্যাংকের কী হোল্ডারদের হঠাৎ অফিস কামাইয়ের জো নাই। নতুন বা আগের দিন অন্য একজনকে চাবী বুঝিয়ে দিয়ে তবেই না ছুটি নিতে হয়। আমিনুর তো এসব কিছুই করে নাই আবার কখনই সে লেট করেও আসেনা। এসব ভাবছি। এমন সময় রাজকুমারের গলা -স্যার , তাড়াতাড়ি বাহিরে এসে দেখে যান। গেলাম। দেখি ৪/৫ জন লোক একজন লোককে বহন করে আনছে। লোকটির সারা গা মাথা সব কাঁদায় মাখা। একজনের সাথে কাঁদায় মাখা একটা সাইকেল। কিছু কচুরী পানা সাইকেলের ক্যারিয়ারে তখনও আটকে আছে। কাছে গিয়ে দেখি আরে এতো আমাদের আমিনুর। এক হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে বেশ সচেতনার সাথেই। আমাকে দেখেই হাতটা বের করলো দেখি চাবির ব্যাগ । তখনও খুব শক্ত করে ধরে আছে।

আমার হাতে চাবির ব্যাগ দিয়ে বললো স্যার, আজকের দিনের জন্য আমাকে একটু ছুটি দেন। ছুটিতো দিবই। কিন্তু কেমনে এমন হলো। জোরে আসতেছিলাম স্যার বাঁক ঘোরার সময় একটুও ব্রেক ধরার কথা মনে হয় নাই ,সাইকেল নিয়ে রহিম মেম্বারের ডোবার মধ্যে পড়ে গেছলাম। সবাই টেনে টুনে তুলছে তাই রক্ষা। তবে চাবী হারায়নি স্যার। ব্যাংক থেকে প্রায় 1000 ফুট দুরে রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে তার নীচেই রহিম মেম্বারের এঁদো ডোবা। সেই ডোবাতেই পড়ে এ অবস্থা । আমার খুব খারাপ লাগল। বললাম আমিনুর আমার জন্য তোমার আজকের এ অবস্থা । আমিনুর আর্তনাদ করে উঠল ,না না আপনার কোন দোষ নাই । দু ’পায়ের মানুষেরই বিশ্বাস নাই , দু”চাকার সাইকেলের কি বিশ্বাস স্যার ? আমিনুরের বদান্যতা আমার অপরাধবোধ লাঘব করলো , আমিনুরের জীবনদর্শন ভঙ্গুর দুনিয়াদারীর কথা মনে করে দিল। আমি উদাস হয়ে পড়লাম। রাজকুমার ব্যাংক প্রাঙ্গনের উঠানের টিউবওয়েলের নিকট তাকে নিয়ে গেল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছে আমিনুর।আমি সে দিকে তাকিয়ে ভাবছি মানুষের সম্মিলিত সিদ্ধান্তও ভুল হতে পারে । আরো কত কি যে কতক্ষন ভেবেছি তা আজ আর মনে নাই। চেক নিয়ে অপেক্ষারত মাস্টার সাহেবের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ভল্ট খুলে দিতে হবে। লেন দেন শুরু হবে আবার। জগৎ চলবে জগৎ-এর নিয়মে। শাখায় কোন এক্সট্রা ক্যাশিয়ার নাই । সেকেন্ড অফিসারই হবে আজকের ক্যাশিয়ার। ও দিকে রাজকুমার আমিনুর আর তার অলুক্ষনে সাইকেলকে নিয়ে ফুলকোট গ্রামের দিকে রওনা দিল। আমিনুরকে ক্যারিয়ারে চড়ে বসানো হল। রাজকুমার সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে রওনা দিল। সেও সাইকেল চালাতে বোধ হয় পাকা না।
পরদিন যথারীতি আমিনুর অফিসে এল। জানাল গায়ে বেশ জ্বর । তবে কাজে সমস্যা হবেনা ।হ্যাঁ , ব্যাংকারদের কাজের সময় জ্বরের কথা মনে রাখলে চলে না। আর ম্যানেজারদের দেখেও না দেখার ভান করতে হয়। তবু আমি তার কপালে হাত দিলাম ।বেশ জ্বর। সেকেন্ড অফিসারকে বললাম পাশে বসে একটু সাহায্য করতে। সাইকেল নিয়ে কোন কথা হলনা। অবশ্য আমি আর কোন দিনই তাকে সাইকেলে চড়তে বলিও নাই।
থাক-আমিনুরের কথা এখন থাক । রফিক অধ্যায় আসন্ন । (ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ৯:০২:৫২   ৬০৩ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

বিনোদন’র আরও খবর


১৬ ব্যান্ডের সবচেয়ে বড় কনসার্ট আজ আর্মি স্টেডিয়ামে
এবার হিন্দি সিনেমার নায়িকা বাংলাদেশের জয়া আহসান
আজ আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস, —”পুরুষ ও ছেলেদের সাহায্য করো”
শুভ জন্মদিন সুরের পাখী রুনা লায়লা
শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্রে সানি লিওনের ছবি!
রক্তাক্ত অমিতাভ বচ্চন হাসপাতালে
চঞ্চল,মেহজাবীন, তিশা, ফারিণ,পলাশ, শাহনাজ খুশি -সবাই গেলেন আমেরিকায়
দুই না তিন পুত্র সন্তানের বাবা শাকিব খান! সূত্রঃ জনকন্ঠ
শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নের অগ্রদূত : স্পিকার ; ১০০০ নারী উদ্যোক্তা’র মধ্যে ৫ কোটি টাকার অনুদান প্রদান
বুবলীর সন্তানের বাবা শাকিব খান, বয়স আড়াই বছর

আর্কাইভ