আল-আমিন আহমেদ সালমান, স্টাফ রিপোর্টার বঙ্গ-নিউজঃঃ কোনো একদিন এক বড়ভাইয়ের সাথে আলাপকালে, আমাকে জিঞ্জাসা করল হলুদ সাংবাদিকতা কি বুঝ? উত্তরে বললাম জ্বী। পরে আবার আমাকে প্রশ্ন করলেন কাঙ্গাল হরিনাথ সম্পর্কে জান? তারপর বললাম না। তখন তাঁর মুখে গ্রামবাংলার সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথের গল্পটা শুনলাম।
শ্রী হরিনাথ মজমুদার ওরফে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার। কুষ্টিয়া জেলার গড়াই তীরবর্তী কুমারখালী গ্রামের কুন্ডুপাড়ায় ১২৪০বঙ্গাব্দ ও ২২জুলাই ১৮৩৩খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন। অভাব অনটনের মাঝে বড় হলেও অবহেলিত সমাজের বৈষম্য এবং জমিদারদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সচেতন করে তোলার জন্য তিনি ১৮৬৩সালে কুষ্টিয়ার প্রথম সংবাদপত্র ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশ করেন।
নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি তাদের হৃদয় কোঠায় স্থান করে নেন। শত বাধা উপেক্ষা করে অসীম সাহসের সাথে তিনি লিখেছেন ইংরেজদের দুঃশাসন, নীলকর, জোতদার জমিদারদের শোষন নিষ্পেশনের বিরুদ্ধে। এ পত্রিকাটি কালক্রমে প্রথমে পাক্ষিক ও সবশেষে এক পয়সা মূল্যমানের সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এতে কুসীদজীবী ও নীলকর সাহেবদের শোষণের কাহিনীর পাশাপাশি সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়মিত মুদ্রিত হতো।
অল্প বয়সেই তিনি পিতা-মাতাকে হারিয়েছিলেন। স্থানীয় ইংরেজি স্কুলে শুরু হয় তার পড়ালেখা। তবে অনাথ হয়ে পড়ায় আর্থিক অনটনে লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি তার। তিনি একইসাথে বিদ্যানুরাগী ও সমাজ-সচেতন ছিলেন। নিজ গ্রামে তিনি বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় একটি ভার্নাকুলার স্কুল খুলেছিলেন ১৮৫৫ সালে। সেখানেই অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। পরের বছর তিনি কুমারখালীতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৮ সালে এই বালিকা বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
এ দেশে নারীদের শিক্ষার প্রসারেও হরিনাথের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। পারিবারিক দৈন্যের কারণে বালক বয়সে কুমারখালী বাজারের এক কাপড়ের দোকানে কাঙাল হরিনাথ কাজ নিতে বাধ্য হন দৈনিক দুই পয়সা বেতনে। এরপর ৫১টি কুঠির হেড অফিস কুমারখালীর নীলকুঠিতে শিক্ষানবিস হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু মানবদরদি ও সত্যনিষ্ঠ হরিনাথের পক্ষে সেখানেও বেশিদিন কাজ করা সম্ভব হয়নি। নীলকুঠিরে স্বল্পকালীন কর্মজীবনে হরিনাথ রায়ত-প্রজার ওপর কুঠিয়ালদের অত্যাচার ও শোষণের স্বরূপ নিজ চোখে দেখেন।
অত্যাচারিত, অসহায়, নিষ্পেষিত কৃষক-সম্প্রদায়কে রক্ষার হাতিয়ার স্বরূপ সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন হরিনাথ মজুমদার। অল্পশিক্ষিত নিয়েই তিনি দারিদ্র ও সচেতনতা বিষয়ক লেখনি সংবাদপত্রে প্রকাশ করতেন। প্রথমে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখতেন। প্রাচীণ সংবাদপত্র হিসেবে বিবেচিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাটি এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
এখন তার স্মৃতি বলতে অবশিষ্ট রয়েছে ঐতিহাসিক ছাপার যন্ত্র, এমএন প্রেস, হাত মেশিন, বাংলা টাইপ ও হরিনাথের কিছু পান্ডুলিপি। তাঁর বাড়ির ঐতিহাসিক বাড়িটি আজ ভঙ্গুর প্রায়। ১৯৭১সালে পাক বাহিনীর বোমা হামলায় তার ছাপাখানা ঘরের ছাদ ধবংস হয়ে গেলেও ছাপাখানাটি রক্ষা পায়। বাড়ির এক কোণে পড়ে আছে সেই প্রেস, যাতে রয়েছে কাঙাল হরিনাথ, লালন, মীর মশাররফ ও জলধর সেনের হাতের স্পর্শ। ‘বাংলা মুদ্রণ যন্ত্র’ নামের যে যন্ত্রটিতে তিনি ১৮৭৩ সালে গ্রামবার্ত্তা ছাপিয়ে ছিলেন, সেটি দর্শনার্থীদের জন্য এখনও তাঁর বাড়িতে রাখা আছে।
গণসংগীত শিল্পী কমরেড হেমাঙ্গ বিশ্বাস তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘রবীন্দ্রাথের আগে ঠাকুর পরিবারের যেসব সদস্য জমিদার হিসেবে শিলাইদহে এসেছিলেন, তারা প্রজাবৎসল ছিলেন না। তাদের অত্যাচারের কথা হরিনাথ গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় সাহসের সঙ্গে লিখতেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রিয় বন্ধু কাঙালকে শায়েস্তা করতে পাঞ্জাবি লাঠিয়ালদের কলকাতা জাঁকিয়ে দিয়েছিলেন। গ্রামবার্ত্তা পত্রিকায় হরিনাথ সাহিত্য, দর্শন বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশের পাশাপাশি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী প্রকাশ করেন। একটা পর্যায়ে জমিদারেরা তার ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন। তখন লালন সাঁই অনুসারীদের নিয়ে হরিনাথের বাড়িতে এসে পাহারা দিয়ে তাকে রক্ষা করেন। ফকির লালন সাঁইয়ের সঙ্গে হরিনাথের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল।
এ ছাড়া বিষাদ সিন্ধু ও জমিদার দর্পণ-এর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক জলধর সেন, অক্ষয় কুমার মৈত্র, দীনেন্দ্র কুমার রায়রা ছিলেন তার শিষ্যতুল্য এবং গ্রামবার্ত্তার লেখক। হরিনাথ নিজেও ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক। ‘কাঙাল ফকির চাঁদ বাউল’ নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। বহু গান লিখেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ ১৮টি। এর মধ্যে ‘বিজয় বসন্ত’ নামের উপন্যাসটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। এর ২০টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল তার জীবদ্দশাতেই।
নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করতে পারেননি বলে লোক শিক্ষার প্রতি হরিনাথের বিশেষ আগ্রহ ছিল। কলকাতার বাইরে দূরে মফস্বলে সংস্কৃতিচর্চার একটি অনুকূল আবহাওয়া রচনা করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু উপার্জনের নির্দিষ্ট উৎস না থাকায় আর গ্রামবার্তা প্রকাশিকা প্রকাশের জন্য চরম ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় আক্ষরিক অর্থেই তিনি প্রায় কাঙাল হয়ে পড়েন। তারপরও কৃষক-প্রজা, রায়ত শ্রমজীবী মানুষ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থের অনুকূলে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ২৫ বছর চলেছিল। : কিন্তু মাত্র ৭টাকা ঋনের দায়ে শেষ পর্যন্ত পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৮:৪৪:১৬ ৫৩৮ বার পঠিত