একাদশ কিস্তি
তালোড়া শাখায় 11 মাস- 5ম পর্ব।
হাইস্কুলে পড়ার সময় পাড়ার সমবয়সী ছেলেদের সাথে নদীর পাড়ে কখনও কখনও তাস খেলা রপ্ত করতাম। জীবনে পরে আর কখনই এ খেলা হয়ে উঠেনি। ওটাকে আমাদের ওখানে বলতো 29। একজন একটা সংখ্যা ডাকলে অন্যজন তারচেয়ে উপরের সংখ্যা ডাকতো। আমি এ ব্যাংক -শাখায় দেখতাম প্রত্যহ বিকেলে ঐ রূপ ডাকাডাকি শুরু হয়। ক্যাশিয়ার গোলাপ সাহেব ষ্ট্রং রুমের ভিতর থেকে ভল্ট খুলে একটা সংখ্যা চিৎকার করে বলে আর ম্যানেজার ও তার টেবিলে বসে একটা রেজিষ্টারে টিক দেয় আর ঐ সংখ্যাটা প্রায় চিৎকার করে বলে। নিত্য দিন বিকেলে এই ডাকাডাকি চলে। আর আমি শুনে শুনে পুলকিত হই। কিন্তু কারণ বুঝতে পারিনা। ভাবি ,গোলাপ সাহেবকে একদিন জিজ্ঞাসা করার সুযোগ খুঁজছিলাম। একদিন দুপুরে খাবার পর হোটেলে আটকা পড়েছি। আকাশ ভেঙ্গে ঢল নেমেছে। টিনের চালে তার কি ঐক্যতান ! চারদিকে দিনের আলো নেই অথচ রাতের আঁধারও নামেনি -এমন আলোহীন ছায়াহীন সচরাচর অচেনা মিষ্টি জগৎ। ধুলির ধরার বদলে জলেসিক্ত দুনিয়া ।গোলাপ সাহেব সুযোগ পেলেই তার নানার গল্প শুরু করে দিত। মনে হয় আজও তার ব্যতিক্রম হবেনা ।আজন্ম সে নানা বাড়ীতে লালিত। আমার নানার দবেজ এমন একখান কাঁসার থালা ছিল যে- সে আজও শুরু করতে যাচ্ছিল , আমি থামায়ে দিলাম। বললাম –আমার এটা জরুরী বিষয় জানার আছে। এমন দিনে রবীন্দ্রনাথ কি বলতেন জানিনা । তবে এমন দিনে আমি গোলাপ সাহেবকে প্রত্যহ বিকেলের রহস্যময় ঐ ডাকাডাকির গোপন রহস্য জিজ্ঞাসা করলাম-
- ”গোলাপ সাহেব ডেইলী বিকেলে আপনি ভল্ট খুলে একটা সংখ্যা বলেন ম্যানেজারও রেজিষ্টার দেখে আবার ঐ একই সংখ্যা বলে। এর কারণ কি?”
- ”কারণ আবার কি? আপনার আরো কিছুদিন চাকুরির বয়স হোক তখন এমনিই বুঝবেন।”
বুঝলাম গোলাপ সাহেবের দিল যতই দরিয়ার মত হোক জ্ঞান বিতরণে তিনি আদৌ আগ্রহী না। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি। বের হওয়ার উপায় নেই। গোলাপ সাহেবও বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকার মানুষ নয়। কিছুক্ষন নানার গল্প করলেন । তার নানা যে কত বড় লম্বা ছিলেন তা তুলনা করে বোঝানোর জন্য আশে পাশে কাউকে খুঁজলেন, কিন্তু পেলেন না। অবশেষে মুখ খুললেন জানালেন ডাকাডাকির রহস্য।
ম্যানেজারদের একটা কর্তব্য হলো দিন শেষে ক্যাশিয়ারের নগদ জমা ও নগদ প্রদান রেজিষ্টার মিলিয়ে যোগ-বিয়োগ করে ভল্টে নগদ ক্যাশ এর সঠিকতা চেক করা ।এ ম্যানেজার সাহেব রেজিষ্টারের যোগ গুলো খুব ভাল করে চেয়ারে বসে বসে হিসাব করতেন। কিন্তু নগদ টাকা ভল্টে ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য কষ্ট করে আর ভল্ট রুমে ক্যাশিয়ারের সাথে ঢুকতেন না। ক্যাশিয়ার সাহেব ভোল্টের টাকা দেখে যা বলতেন ম্যানেজার রেজিষ্টারে দেখতেন তা লেখা আছে কিনা। যেহেতু ভল্ট একটু দুরে তাই উভয়কে চিৎকার করে বলতে হতো। সবই বুঝলাম কিন্তু গোয়ালার তো উচিৎ গরুর হিসাব খাতা দেখে ঠিক না করে গোয়ালে যেয়ে গুনে দেখা। একথা শুনে গোলাপ সাহেব তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন ম্যানেজার সাহেব ভাল বংশের লোক। উনার বাবা উমুক ষ্টেশনের ষ্টেশন মাস্টার, ওনারা মানুষকে বিশ্বাস করতে জানে। ওরে বাবা ! আজ যে তিনি সরাসরি ম্যানেজ্যারের রীতিমত সুখ্যাতি শুরু করে দিলেন। কারনটা অবশ্য বুঝলাম না। বি সি এস পরীক্ষা দেবার আশা তখনও ছাড়ি নাই। কাল পলাশীর যুদ্ধ অংশ পড়েছি । হঠাৎ মনে হল-নবাব সিরাজউদদৌলাও এমনি ভাল বংশের লোক ছিলেন। তবে ভাগ্যটা হয়তো বিরুপ ছিল। একজন মীর জাফর ছিল। অবশ্য সে যুগে ব্যাংকাররা একে অপরকে বিশ্বাস করতোও। দোকানে যেমন অনেক পণ্য থাকে ক্যাশিয়াররা নগদ টাকাকে সে রকম পণ্যই মনে করত। কতদিন দেখেছি ,সারাদিন লক্ষ লক্ষ টাকা নাড়াচাড়া করে গোলাপ সাহেব দিন শেষে দোকান থেকে বাঁকি সদাই কিনে বাড়ী ফিরছেন। মাঝে মধ্যে তাকে বলতে শুনেছি- সমুদ্রের অনেক পানি কিন্তু খাওয়া যায় না তেমনি ব্যাংকের অনেক টাকা তেমনি নেওয়া যায় না।
যা হোক আমরা সামনে বসা ম্যানেজার সাহেব সেদিন একটু তাড়াতাড়ি চা খাওয়া শেষ করলেন। বললেন বাস ধরার তাড়া আছে। আমি মিনমিন করে জানতে চাইলাম “পেনশনের টাকা তুলতে কোনও সমস্যা হয়নি তো। আমার কোন হেল্প লাগবে কিনা?”
না না হেল্প আর লাগবেনা। হিসাব নিকাশ সব কমপ্লিট। দু’তিন দিনের মধেই তিনি চেক পাবেন। শুনে আমার খুব ভাল লাগলো। সেটা তার ঝামেলা ছাড়াই টাকা প্রাপ্তির জন্য নাকি আমার ঘাড়ে তদবীর করার উটকো ঝামেলা চাপলো না এ ভেবে তা আজ আর আমার মনে নেই। তবে আমার মনের জনমত তখন মত পাল্টালো। তিনি একটু উদাসীন বা অন্য প্রকৃতির ছিলেন বটে তবে জেনেশুনে তো কোনও অন্যায় করেন নাই। ব্যাংকের টাকাও লোপট করেন নাই। তাই হয়ত তার তরী কুলে ভিড়েছে। অনেক ব্যাংকারেরই অবসর পাওনা পেতে যে ঝুট ঝামেলা হয় তার তা হয়নি। অনেকের তো বিনা কারনেও ঝামেলা হয়।
যাহোক, ম্যানেজার সাহেব তাড়াহুড়োর অযুহাত দেখিয়ে আমার চেম্বার থেকে বিদায় নিলেন। আমি সে দিন বাসায় ফিরে তালোড়ার ব্যাংকিং জীবন নিয়ে জাবর কাটতে শুরু করলাম। তিন দশক আগের কথা তবু মনে হতে লাগলো এইতো এইতো সেদিনের কথা।
চরম ক্ষমতাশালী স্বৈরাচারের মত ম্যানেজার সাহেব অফিসে এসে নির্দেশ দিচ্ছেন, গার্ড পিওনেরা ব্যাংকের ল্যাট্রিন ব্যবহার করতে পারবে না। প্রয়োজনে তারা যেন কাছেই রেলষ্টেশনে যায় । আসলে বেচারার তো আলাদা রুম ছিলই না বরং তার বসার চেয়ার ঘেষেই ছিল বাথরুম। আচ্ছা এজনই কি উনি বেশী বেশী বাহিরে থাকতেন। জানিনা। তবে চেয়ারে বসেই বলতেন “বাথরুমে ফিনাইল ঢাল। ”তখন কর্ম পরিবেশের কথা অন্ততঃ মফস্বলে কেউ চিন্তাই করতো না। আমি ব্যবহার করতাম একটা ভাংগা প্রায় পরিত্যক্ত ডাইনিং টেবিল। আগের শাখাতে তাও ছিলনা। মজার ব্যাপার হলো এ বাথরুম নিয়েই আমার এখনকার পরিবেশনা ‘বাথরুমে নাটক’। (ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ২২:৪৬:৪১ ১০৩৯ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম