“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন’- জালাল উদদীন মাহমুদ
Home Page » ফিচার » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন’- জালাল উদদীন মাহমুদ
দশম কিস্তি- তালোড়া শাখায় 11 মাস- 4র্থ পর্ব।
ম্যানেজার সাহেব ক্যাশিয়ার কাম ক্লার্ক হিসাবে যোগদান করে তখন সিনিয়র অফিসার। স্থানীয়। ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজের বিষয়ে সর্বদাই শাখার দক্ষ দ্বিতীয় কর্মকর্তার উপর নির্ভরশীল । প্রায় সময়ই শাখার বাহিরে থাকতেন। ব্যাংকে ফিরে রফিক সাহেবকে উদ্দেশ্যে করে কাজের যে ফিরিস্তি দিতেন তাতে বোঝা যেত ব্যাংকের ব্যবসা উন্নয়নমূলক কাজেই তিনি শাখার বাহিরে থাকতেন আর এ ব্যবসা উন্নয়নই তার ধ্যান ও জ্ঞান। তাই দুষ্ট লোকেরা যখন বলত স্থানীয় লেডী টেলিফোন অপারেটরের সামনে তাকে বসে থাকতে দেখে এসেছেন আমরা কখনই সে সব কথা আমলে নিতাম না। পানিতে বাস করে কুমীরের সাথে ঝগড়া করার প্রবৃত্তিও অবশ্য শাখার কারো মাঝে তখন দেখি নাই।
আগে শুনতাম বিশ্বাসের মা মারা গেছে, পরে শুনলাম বিশ্বাসের বাবা- মা দু’জনেই মারা গেছে। এখন শুনি বিশ্বাসের তিনকুলে কেউ নাই। তবে এ ম্যানেজার সাহেব বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দুর -এ নীতিতে বিশ্বাস করতেন। বড় অংকের ভাউচারে ম্যানেজারের স্বাক্ষর লাগতো। তিনি মাঝে মধ্যে শাখায় উদয় হয়ে একের পর একের সব গুলোতে স্বাক্ষর করতেন। কোন কিছু দেখতেন না ,চেক করার তো প্রশ্নই আসেনা। নয়ন তারা ফুলের পাপড়িগুলোর মত তার সে স্বাক্ষর আজো আমি মনে করতে পারি। সদ্য ট্রেনিং ফেরত আমি। ট্রেনিং এ শুনেছিলাম ব্যাংক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অর্থ নিয়েই এর কাজ। বিষাক্ত সাপ প্রয়োজন মনে না করলে নাও ছোবল মারতে পারে। কিন্তু অর্থ এমন একটা সম্পদ যা দেখে মরা মানুয়েরও জিহ্বা নড়ে। অতএব সাবধান। সব কিছু চেক করে তার পর স্বাক্ষর দিতে হবে। কিন্তু তার মধ্যে চেক করার কোন বালাই ছিলনা। সামনে যা দেয়া হতো তাতেই স্বাক্ষর করতেন। সদ্য প্রাপ্ত ট্রেনিং এর শিক্ষা তো দেখি অচল। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করতে হলে নাকি ৩ চোখ লাগে। অর্থাৎ পিছনেও একটা। প্রশিক্ষক বলতেন আপনাদের হতে হবে প্রুডেন্ট ব্যাংকার। বিশ্বাস করবেন কিন্তু বাকী দিবেন না। ব্যাংকে রিক্স নিতেই হয় বাস্তব প্রয়োজনে । তবে তা হবে ক্যালকুলেটিভ । এ সব নীতি বাক্যকে তিনি থোড়াই কেয়ার করতেন।
আমার সাথে তার সর্বশেষ দেখা হয়েছিল কয়েক বছর আগে ,তার চাকুরীর একদম বিদায় বেলায়। চেনাই যাচ্ছিলনা। মুখে দাঁড়ি, মাথায় টুপি ,গায়ে সফেদ পাঞ্জাবী। বললেন অবসরে গিয়েছেন। পেনশন সংক্রান্ত বিষয়াদি চুড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য ঢাকায় এসেছেন। আমার চেম্বারে শুধুই দেখা করতে এসেছেন। শুধুই দেখা ?বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হয় কোনও তদবীর আছে টাকা পাওনার ব্যাপারে। সারা জীবন তো হাল্কাভাবে চাকুরী করেছেন , ম্যানেজারীও করেছেন অনেকদিন। ব্যাংক পেনশনের টাকার পুরা নিষ্পত্তির আগে সব খতিয়ে দেখে । যে সব শাখায় চাকুরী করেছেন সে সব স্থানের নো অবজেশন সার্টিফিকেট লাগে। ভাবলাম, ম্যানেজার সাহেব যেমন উদাসীন ছিলেন হয়তো কোথাও কোনও ভুল- ভাল করেছেন। বা ভুল ভাল লোন দিয়েছেন, আটকে গেছেন ,এখন আমার কাছে এসেছেন তদবীর করতে। কি আশ্চার্য্য ! তদবীর তো করলেনই না বরং বারবার আমাকে দোয়া করতে লাগলেন। জানালেন হাতে একদম সময় নাই ,বগুড়া ফিরতে হবে ,টিকেট কাটা আছে। তাছাড়া আমার সামনে আরো একটু সময় বসতেন। যা হোক চা- সিঙ্গাড়া অফার করলাম। তিনি খাচ্ছিলেন আর আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে 30 বছর আগের স্মৃতি হাতড়াতে থাকি।
তখন আমার বয়স কম ছিল। চিরসত্য। আগে বয়স তো কম থাকবেই। তবে তথ্যটা আগেই স্মরণ করালাম এ জন্য যে ইনার সাথে একটা অপকর্ম করেছিলাম। পাঠকেরা যেন তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন। এ প্রসঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে রাখি। সরা জীবন মজার পিছনে ছুটেছি। এখন ছুটছি। মজা না থাকলেও শুণ্যস্থান পূর্ণ করে করে মজা বানিয়ে নিয়েছি। সারা জীবনের খোঁজা- নির্দোষ মজা।
লক্ষ্য করতাম ম্যানেজার সাহেবের সামনে যত বড় অংকের চেক বা ভাউচারই দেয়া হোক না কেন উনি ঘাড় ও গালের চাপে ফোনের রিসিভার চেপে রেখে ফিস ফিস করে কথা বলতে বলতে বাম হাত দিয়ে ভাউচার চেপে রেখে ডান হাতে টেবিল জমিয়ে থাকা কাগজপত্রাদি স্বাক্ষর করতেন। এগুলো সাথে সাথেই ম্যানেজারের স্বাক্ষর করার নিয়ম। কিন্তু উনি অফিসে কম থাকতেন বিধায় অনেক চেক/ভাউচার স্বাক্ষরের জন্য টেবিলে জমা থাকতো। তিনি একের পর এক সেই ট্রেড মার্ক ফুল মার্কা স্বাক্ষর করতেন দ্রুততার সাথে।
একদিন আমাদের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপে গেল। আমাদের বলতে আমার আর সেকেন্ড অফিসার রফিক সাহেবের। এই রফিক সাহেব কে নিয়ে বিশাল একটি অধ্যায় পরে এক সময় শুরু করবো। এখন যা বলছিলাম আমার দু’জন মিলে (রফিক সাহেবের প্রত্যক্ষ মদদে ও পরিকল্পনায়)একটা প্রত্যয়নপত্র রমিজ সাহেবকে দিয়ে তৈরী করে নেয়া হল। “আমি জনাব ———– (ম্যানেজারের নাম), পিতা- ————————-(ম্যানেজারের পিতার নাম)- ম্যানেজার, অগ্রণী ব্যাংক, তালোড়া শাখা এ মর্মে প্রত্যয়ন করিতেছি যে আমি অদ্য সকাল 9.00 ঘটিাকার সময় স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে বিনা প্ররোচনায় 3 জন সাক্ষী-সাবুদের সামনে ইন্তেকাল করিয়াছি।”
তার টেবিলে অন্যান্য স্বাক্ষরতব্য চেক, ভাউচার, কাগজপত্রের সাথে এটাও রেখে দেয়া হল। আমার ভয় ভয় করছিলো। রফিক সাহেবকে বললাম দরকার নাই এ নাটকের ওটা বরং ছিঁড়ে ফেলেন। দেখা যাক কি হয় -বলে রফিক সাহেব সান্তনা দিলেন। এমন সময় ঘর্মাক্ত দেহে ম্যানেজার সাহেব এসে চেয়ারে বসেই দমাদম স্বাক্ষর করতে লাগলেন। আমরা আড়চোখে পর্যবেক্ষণরত। উনি প্রত্যয়নপত্রে স্বাক্ষর করলেন বটে কিন্তু টেবিলে তা উল্টিয়ে পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে রাখলেন। নির্ঘাৎ ধরা। ভাবছি কি ভাবে পার পাব। রফিক সাহেব বললেন চিন্তুা করেন না। আমি ম্যানেজার সাহেবকে বাহিরে নিয়ে যাচ্ছি আপনি সে সময় প্রত্যয়ন পত্রটি ছিঁড়ে বাহিরে ফেলে দিবেন। রফিক সাহেব উঠলেন ম্যানেজার সাহেবও তার কথায় উঠলেন। কিন্তু উঠার সময় কাগজটি নিলেন। সরাসরি আমার কাছে এসে তা আমার হাতে দিয়ে বললেন ’এটি বোধ হয় কারো একটি প্রত্যয়নপত্র। সীল লাগবে। আপনি সীল দিয়ে দিবেন।’ তারপর হঠাৎ রেগে গিয়ে বললেন ’এ সব প্রত্যয়ন পত্র- টত্র আপনারা দিতে পারেন না ,খামাখা আমার কাছ থেকে স্বাক্ষর করে নেন। স্বাক্ষর করতে যদি এত ভয় লাগে তবে ব্যাংকের চাকুরীতে ঢুকেছেন কেন? ”আমি হাঁ করে আছি দেখে উনি ধমকের সুরে বললেন ”নেন আপনি না পারেন পিয়নকে দিয়ে আমার নামের সিলটা মারিয়ে নিয়েন।” কথা হয়ত আরো বাড়ত কিন্তু রফিক সাহেব সে সুযোগ না দিয়ে তাকে নিয়ে তিনি দ্রুত নিস্ক্রান্ত হলেন।
আমি প্রত্যয়নপত্রটি হাতে নিলাম। কম্পিত হস্তে রমিজ সাহেবের হাতে দিলাম। বললাম ,ছিঁড়ে ফেলুন। সে সময় আমার চাকুরীর বয়স সবে ছয় মাস পেরিয়েছে। এখন ভাবি ,রফিক সাহেবের প্রযোজনা ও নির্দেশনায় সংঘটিত এ নাটকে রফিক সাহেবের কি স্বার্থ ছিল ? স্রেফ মজা। মজা করার জন্য আমরা দুজনেই সে সময় সবকিছু করতে রাজী ছিলাম । এ কমন বিষয়টা পরবর্তীতে আমাদেরকে একে অপরের কাছি কাছি নিয়ে এসেছিল । আজ হিসাব করছি পান্ডুলিপি ছাড়া ,এত বড় বড় নাটকের মঞ্চায়ন আমার জীবনে আর কতবার ঘটেছিল। অনেক ঘটেছিল, বহুবার ঘটেছিল । আসলে রফিক সাহেবের মত ইন্দ্র থাকলে শ্রীকান্তের জীবনে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। রফিক সাহেব কর্তৃক সৃষ্ট নাটকে পান্ডুলিপি লাগেনা । হর হামেশা অন দ্যা স্পট তিনি পান্ডুলিপি রেডী করে ফেলেন। তবে একটি উদ্দেশ্য থাকে তা হল নিজের সৃষ্ট মজা থেকে মজা কুড়ানো ও অন্যদের তার ভাগীদার বানানো। যেমন রাঁধুনী স্বয়ং তার রান্না করা খাবার খেয়ে তৃপ্ত হয় ,অন্যদেরও তৃপ্ত করে। কিন্তু রফিক সাহেবকে নিয়ে আবর্তিত অন্য অধ্যায়গুলো শুরু করবো একটু পরে। এখন তালোড়ার ম্যানেজারের অধ্যায়টাই চলুক। (ক্রমশঃ)
বাংলাদেশ সময়: ৭:২৮:৪৪ ৬২৬ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম
পাঠকের মন্তব্য
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)ফিচার’র আরও খবর
অ্যানেন্সেফ্লাই কী? - রুমা আক্তার
শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নের অগ্রদূত : স্পিকার ; ১০০০ নারী উদ্যোক্তা’র মধ্যে ৫ কোটি টাকার অনুদান প্রদান
“ম্রো’ আদিবাসীর গো হত্যা’ অনুষ্ঠাণ ” - তানিয়া শারমিন
আলোকিত স্বপ্ন নিয়ে তৃতীয় বর্ষে রবিকর ফাউন্ডেশন
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন রক্ষায় প্রয়োজন জেন্ডার সংবেদনশীল নীতির পর্যালোচনা
জিনগত ত্রুটির অপর নাম “ডাউন সিনড্রোম”- রুমা আক্তার
মোহাম্মদ শাহ আলমের জীবন ও কর্ম
ইসফাহান নেসফে জাহান
সিলেটে গ্রুপ ফেডারেশনের কর্মশালায় বির্তকিত মুরাদ- আয়োজকদের দুঃখ প্রকাশ
ডলারের দাম যেভাবে বাড়ছে, টাকার দাম কেন কমছে
-
সালাম, আমান, রিজভী, খোকন, শিমুল ও এ্যানিসহ গ্রেফতার শতাধিক
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
ভারতকে হারিয়ে টাইগারদের সিরিজ জয় নিশ্চিত
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ,নিহত ১
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারে ভূষিত ওসমানীনগরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিক
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
বিয়েবর্হিভূত যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ: প্রতিবাদে বিক্ষােভ ইন্দোনেশিয়ায়
মঙ্গলবার ● ৬ ডিসেম্বর ২০২২ -
আড়াইহাজারে অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
মঙ্গলবার ● ৬ ডিসেম্বর ২০২২
আর্কাইভ
Head of Program: Dr. Bongoshia
News Room: +8801996534724, Email: [email protected] , [email protected]