বঙ্গ-নিউজঃ রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের যে চুক্তি হয়েছে তা আশু বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব হয়েছে মিয়ানমারে, তাই এর সমাধানও হতে হবে মিয়ানমারেই। আমরা দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে মিয়ানমারের ভূমিকায় হতাশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্থায়ী ও টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু সম্ভব হয়নি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথ ধরে প্রতিবছরের মতো এবারো জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯ মিনিট স্থায়ী ভাষণে রোহিঙ্গা সঙ্কট, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি, বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা, নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণসহ বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও শোষণমুক্ত সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের কথা বিশ্বসভায় তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র সরকার প্রধান, যিনি ১৫ বার সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেওয়ার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত ও অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশার স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে গত বছর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আমি পাঁচ-দফা প্রস্তাব পেশ করেছিলাম। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে মিয়ানমার মৌখিকভাবে সবসময়ই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে বলে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তারা কোনো কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অবস্থানরত এগার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী জন্য আমরা সাধ্যমত খাদ্য, বস্ত্র, চিকিত্সা, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসি-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা সহানুভূতি দেখিয়েছেন এবং সাহায্য ও সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এজন্য আমি তাদের সকলের প্রতি জানাই কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে ১০টি মিশনে ১৪৪ জন নারী শান্তিরক্ষীসহ বাংলাদেশের মোট সাত হাজারের অধিক শান্তিরক্ষী নিযুক্ত রয়েছেন। আমাদের শান্তিরক্ষীগণ তাদের পেশাদারিত্ব, সাহস ও সাফল্যের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদসহ সকল সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থবিরোধী কোনো কার্যক্রম বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমরা পরিচালিত হতে দিব না। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের নানা সাফল্যের কথা তুলে ধরে বলেন, বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালে আমাদের নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মোট দেশজ উত্পাদনের বিবেচনায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৪৩তম বৃহত্ অর্থনীতির দেশ। আমাদের মাথাপিছু আয় ২০১৮ সালে ১ হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গত অর্থবছরে ছিল শতকরা ৭ দশমিক ৮৬ ভাগ। মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ৫ দশমিক ৪ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের শতকরা ৪১ দশমিক ৫ ভাগ থেকে শতকরা ২১ দশমিক ৮ ভাগে হ্রাস পেয়েছে। একই সময়ে হতদরিদ্রের হার ২৪ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের বৈশ্বিক মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
শেখ হাসিনা বিশ্বসভায় বলেন, আমরা স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যাত্রা শুরু করেছি। বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ স্যানিটেশন এবং ৮৮ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সুবিধা পাচ্ছেন। আমি বৈশ্বিক নেতৃবৃন্দের কাছে পানির যথাযথ মূল্যায়ন, ব্যবস্থাপনা এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাই।
নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের সংসদই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র সংসদ, যেখানে সংসদ নেতা, সংসদ উপনেতা, স্পিকার এবং বিরোধী দলীয় নেতা নারী। বর্তমান সংসদে ৭২ জন নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন। প্রতিটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৩৩ শতাংশ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা জাতিসংঘের মহাসচিব কর্তৃক ‘হাইলেভেল প্যানেল অব ডিজিটাল কো-অপারেশন’ প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানাই। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণার মূল দর্শন হলো জনগণের কল্যাণ। ইন্টারনেটভিত্তিক সেবার ব্যাপক প্রচলনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবরূপ ধারণ করেছে। বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ মহাকাশে উেক্ষপণের মধ্য দিয়ে আমরা মহাকাশ প্রযুক্তির জগতেও প্রবেশ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সর্বাধিক ঝুঁকির সম্মুখীন পৃথিবীর প্রথম দশটি দেশের একটি। আমরা প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমাদের উন্নয়ন কার্যক্রম এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সক্ষমতা সৃষ্টিতে গৃহীত পদক্ষেপসমূহকে একীভূত করে আমরা বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ শীর্ষক মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ভ্রাতৃপ্রতীম ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন আজও অব্যাহত রয়েছে যা আমাদের মর্মাহত করে। এ সমস্যার আশু নিষ্পত্তি প্রয়োজন। তিনি বলেন, মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে তিনটি মৌলিক উপাদান বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, তা হলো— শান্তি, মানবতা ও উন্নয়ন। তাই মানবসমাজের কল্যাণে আমাদের মানবতার পক্ষে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। জনগণকে সেবা প্রদান এবং তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
জাতিসংঘের ৭৩ বছরের ইতিহাসে চতুর্থ নারী হিসেবে সাধারণ পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী অধিবেশনের সভাপতি মারিয়া ফারনান্দাকে অভিনন্দন জানান। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকবার স্মরণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এসময় তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ রাখার বিষয়টিও বিশ্বসভায় তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:০৩:০৮ ৪১৫ বার পঠিত