সময়টা ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাস। আমি তখন কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ইস্টার্ন এয়ার কম্যান্ডের আডভান্স হেড কোয়ার্টারসের অধীন ৬ নং প্রভোস্ট ও সিকিউরিটি ইউনিটে কর্মরত। সেদিন সকাল এগারোটা নাগাদ অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রভোস্ট মার্শাল উইং কম্যান্ডার এম শাহ্ আমাকে তাঁর চেম্বারে ডেকে পাঠিয়ে বললেন যে, আমাকে ও আমার অধীনস্ত কর্পোরেল আশিস দাসকে দুটো মারুতি জিপসি গাড়ি নিয়ে বেলা সাড়ে তিনটের মধ্যে দমদম বিমান বন্দরে উপস্থিত হতে হবে। ঐ সময়ে পাঞ্জাবের চণ্ডীগড় থেকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি এ এন ৩২ বিমান দমদম বিমান বন্দরে এসে পৌছবে। ওই মারুতি জিপসি দুটো ঐ বিমানে তুলে নিয়ে আমাদের ব্যাঙ্গালোর যেতে হবে। সেখানে আন্তর্জাতিক বিমান প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছে। সেখানে প্রদর্শিত হবে বিভিন্ন ধরনের বহু বিমান ও সে সংক্রান্ত না না সামগ্রী। আসবেন দেশ অ বিদেশের বহু দর্শক ও বিশিস্ট অতিথিবর্গ। সেখানকার নিরাপত্তা ও বিশিষ্ট জনেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেখানে সারা ভারতের বিভিন্ন ইউনিট থেকে আসছে ৪৩ জনের একটি নিরাপত্তা রক্ষকদল। আমাকে সেই দলের নেতৃত্ব দিতে হবে। এটা যে একটা গুরু দায়িত্ব সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এনিয়ে ভাবার সময় মোটেই নেই, ঘড়িতে চোখ বোলাতেই উইং কম্যান্ডার বললেন, “সময় সত্যিই খুব কম। তোমাকে মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যে চট জলদি সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তে হবে । এটা একটা চ্যালেঞ্জ।” আমি এ পি এমের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে তক্ষুনি কর্পোরেল আশিস দাসকে ফোনে সবকিছু জানাতে সে আমাকে তার ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক কিছু সমস্যার কথা বললেও, আদেশ অবশ্যই পালনীয়।
সামরিক শৃঙ্খলার প্রশ্ন। এখানে হল “সার্ভিস বিফোর সেলফ”। ব্যাক্তিগত সমস্যার যায়গা অনেক পরে। সুতরাং কর্পোরেল আশিস বেলা আড়াইটার মধ্যেই এয়ার পোর্টে পৌঁছে যাবে বলল। আমি দুটো মারুতি জিপসি গাড়ি চেক করে তাতে তেল ভরে নিয়ে একটা গাড়ি আমি নিজেই চালিয়ে আর একটি আমার একজন স্টাফ চালিয়ে নিয়ে আমার বাড়ির উদ্যেশ্যে রওনা হলাম। প্রায় পনেরো দিনের ব্যাপার। ব্যাক্তিগত প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে যাত্রা করলাম। বিমান বন্দরে পৌঁছে দেখি ঘড়িতে তখন বেলা দুটো পয়ত্রিশ। চণ্ডীগড় সোজা উড়ে আসা বিমানটি এ এন ৩২ বিমানটি তখনি এসে পৌছুলো।
বিমানচালকেরা বললেন গাড়ী দুটো বিমানের পেছনে খুলে দেয়া খুব সংকীর্ণ জায়গা দিয়ে গাড়ী দুটো প্লেনে ঢোকাতে হবে। আমি মেপে দেখলাম এই খলা যায়গাটি প্রস্থে মারুতি জিপসির থেকে মোটে দেড় ইঞ্চি বড় অর্থাৎ এর ঠিক মাঝখান দিয়ে গাড়ীটা নিয়ে যেতে গেলে দুধারে মোটে পৌনে এক ইঞ্চি জায়গা খালি থাকবে, যার মানে হল দুপাশে এক ইঞ্চি জায়গাও থাকছে না। পাইলটরা আগেই সাবধান করে দিয়েছেন যে, এই বিমানের গায় কোনভাবে ধাক্কা লেগে বিমানের যদি কিছু ক্ষতি হয় তবে কিন্তু সেই ক্ষত না সারিয়ে বিমান নিয়ে ওড়া যাবেনা, কাজেই সাবধান।
আমি প্রথমবারের প্রচেষ্টায় বিমানের খোলের বাইরে পাতা একটি লোহার পাতের ওপর দিয়ে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে ঢোকাবার মতো কঠিন কাজটি গাড়িটির অগ্রভাগ অর্থাৎ জিপসি গাড়ীর প্রথম চাকা দুটি কোনরকমে বিমানের মধ্যে প্রায় ঢোকাতে পারলেও গাড়ীর রিয়ার-ভিউ মিররে পেছনে দেখে তো আমার চক্ষুস্থির, পেছনের চাকা তো বিমানে আঘাত করবে। সুতরাং পত্রপাঠ গাড়ী ব্যাক গিয়ারে ফেলে সাবধানে নামিয়ে নেয়া ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। অবস্থা দেখে বৈমানিকদের মধ্যে একজন এগিয়ে এলেন। তিনি বলেই দিলেন যে তিনি এটা করতে পারবেন। আমি প্ত্রপাঠ স্টিয়ারিং ছেড়ে নেবে এলাম। তাঁর খুব আত্ম প্রত্যয়ী ভাব। বৈমানিক প্লেনের জয় স্টিক ছেড়ে গাড়ীর স্টিয়ারিং ধরে লোহার পাতের ওপর দিয়ে গাড়িটি গড়গড়িয়ে নিয়ে চললেন। আমি মনেমনে বাহবা দিচ্ছি, কিন্তু একি গাড়ি যেমন গড়গড়িয়ে পেছনে চলে এলো। এঁর ব্যাপারটাও একই। তিনিও রিয়ার-ভিউ মিররে দেখে বুঝলেন যে পেছনে লেগে যাবে তাই ফিরে আসা। আর একবার চেষ্টা করে সেই একই ভাবে নেবে আসতে হল। সুতরাং তিনি এবার ক্ষান্ত হলেন, হাসিমুখে গাড়ির চাবিটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, “আকাশে প্লেন চালানো আর ভুমিতে গাড়ি চালানো এক নয়”।
আমি আর দেরি করতে রাজী নই, ব্যাঙ্গালোরে গুরু দায়িত্ব আমার। তাড়াতাড়ি গিয়ে সেসব বুঝে নিতে হবে। মনে মনে ভগবানকে, ইষ্ট দেবতাকে, কূল গুরুকে স্মরণ করে আবার গাড়ির স্টিয়ারিং ধরলাম। এবার কঠিন পণ, যে করেই হোক বিমানের ক্ষতি না করে গাড়িটা বিমানে তুলতেই হবে। দৃঢ়হস্তে শান্তভাবে স্টিয়ারিং ধরে গাড়িটি এগিয়ে নিয়ে চললাম আর মনে মনে গুরুদেবকে প্রনাম জানাতে লাগলাম। হঠাৎ পেছনে করতালির আওয়াজে সংবিৎ ফিরে পেলাম দেখলাম আমি গাড়ি সহ প্লেনের মধ্যে বসে আছি। বিমান উড়ে চলল ব্যাঙ্গালুরু বিমানবন্দর।
উরন্ত বিমানে বসে ভাবছি ভাগ্যিস তখন এ এন ৩২ বিমান ছিল না, থাকলে অর্জুনকে কুয়োরজলে তাকিয়ে মাথার ওপরে উরন্ত ভাস পাখীর চোখে বান না মেরে যদি এ এন ৩২ বিমানে এরকম পেল্লায় সাইজের একটি মারুতি জিপসি গাড়ি তুলতে বলা হত তাহলে কি মহামুনি ব্যাসদেবকে কি তাঁর অমর কীর্তি মহাভারতের মতো মহামুল্যবান গ্রন্থটি রচনা করতে হতো ?
(লেখক ভারতীয় বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। বর্তমানে কলকাতায় রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ব বিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ও অন্যান্য প্রশাসনিক বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক।)
বাংলাদেশ সময়: ২:৩২:০৪ ৭৬২ বার পঠিত #ঋত্বিক কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় #লক্ষ্যভেদ