মুর্শিদা আখতার রজনীর লেখা গল্প ‘পথের সাথী’

Home Page » সাহিত্য » মুর্শিদা আখতার রজনীর লেখা গল্প ‘পথের সাথী’
বুধবার, ২৫ জুলাই ২০১৮



 পথের সাথী-

চৌধুরী স্যারের ক্লাসশেষে দুইটার গাড়িতে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে ক্লাসরুম থেকে যখন বের হয়েছি শ্রাবণের মুষলধারা তখন বাঁধ ভেঙে পড়ছে।গাড়ির অপেক্ষায় অনুষদের নিচে শিক্ষক-ছাত্র মিলেমিশে একাকার।মাঝে মাঝে মৃদু-দমকা হাওয়ায় হালকা পানির ঝাপটা বয়ে যাচ্ছে সবার উপর।সামনের রাস্তায় যে গতিতে স্রোত বয়ে যাচ্ছে তাতে একটি শক্ত কাগজের নৌকা দুমড়ে-মুচড়ে যেতে স্বল্পতম সময়ই যথেষ্ট।চারিদিকে কোলাহলে কেউ কেউ বাড়িতে থাকলে খুব ভিজতো কেউবা বাবার বকুনির ভয়ে লুকিয়ে ভিজতো এমনই আশা পোষণ করছে।আমার কিন্তু ইচ্ছা করছিল রাস্তার পানির স্রোতের মাঝখান দিয়ে পানি ছড়িয়ে হাঁটতে।কিন্তু সব আশা পূরণ হবার নয়।এক এক করে গাড়ি আসতে আসতে আমাদের গাড়িও এসে পড়লো।গাড়িতে ওঠার সময় বৃষ্টির পানিতে পা ইচ্ছা করে ডুবিয়ে উঠে দুধের সাধ ঘোলে মিটালাম।
গাড়িতে উঠে সবার পিছনের ছিটে দরজার পাশে বসলাম আমি আর তামান্না।হঠাৎ দেখি তামান্নার বামপার্শ্বস্থ জানালা সংলগ্ন সিটে বসে একটি মেয়ে।কলেজ লাইফ থেকে ওকে চিনি।ইউনিভার্সিটিতেও প্রথম বর্ষ থেকেই দেখেছি ওকে।কিন্তু আজ দেখলাম অন্য এক রূপে।
মেয়েটির নাম আসমা।ওকে দেখেই ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল।কিন্তু ও কথা বলবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে ছিলাম।তামান্না সাহস দিল একসময় শিশু সাংবাদিক ছিলাম সেইসূত্রে চেষ্টা করে দেখার জন্য।
আসন পরিবর্তন করে আসমার পাশে গিয়ে বসলাম।কিছুক্ষণ পর শুরু করলাম আলাপ।ওর কোলের ফুটফুটে শিশুটিকে দিয়েই শিশু সাংবাদিকের সাহসিকতার পরিচয় দিলাম।
-এটা কি ছেলে?না মেয়ে?
-মেয়ে।
-ওর নাম কি?
-সাথী।
চলতে থাকলো আমাদের আলাপচারিতা।আলাপচারিতা বলতে আমার প্রশ্ন আর আসমার উত্তর।কিন্তু তাতে বেরিয়ে আসলো একটি মর্মস্পর্শী জীবনোপাখ্যান।নিষ্পাপ,ফুটফুটে সাথী বড় আপন মায়ের কোলে সারাপথ ঘুমিয়ে তার কিছুই জানতে পারলো না।জেগে থাকলেও পারতো না।কারণ সে জানতে শেখেনি।ক্যাম্পাসে অনেকদিন ধরেই ওর মায়ের সাথে দেখছি ওকে,কখনো প্রচন্ড রোদে ঝলসে যাচ্ছে ওর কোমল তনু,কখনো বৃষ্টির জলে ভিজে একাকার হচ্ছে মা-মেয়ে।তবু ওইটুকু একরত্তি মেয়ে,আট মাস মাত্র বয়স যার কখনও ওর কান্না শুনিনি।জীবনকে যেন এখন থেকেই বুঝে নেওয়ার,সহ্য করে নেওয়া ওর কর্তব্য।
যাহোক,আসমার সাথে কথা বলে যা জানতে পারলাম-
ওর বিয়ে হয়েছে দু’বছর হল।
আসমা যখন হামড় হাঁটা(হামাগুড়ি দেয়া) শেখে তখন তার বাবা টি.বি. রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়।চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় সে।বাবার মৃত্যুর সময় তার ছোট ভাইটি মাতৃগর্ভে ছিল।তখন তাদের আশ্রয় মেলে ভূমিহীনদের জন্য তৈরি সরকারি আবাসন প্রকল্পে।আশ্রয় মিললেও আহার মেলা ভার।তাই আবাসন প্রকল্পের স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও সেখানেই ইতি টেনে নেমে পড়ে চিরাচরিত সহজ পেশাতে।
কলেজে থাকতেই দেখেছি ওকে দেখলেই সবাই ভয়ে সরে পড়তো।কেননা সামান্য একটি-দুটি টাকার জন্য যার-তার হাত ধরে,কাপড় ধরে টানাটানি করতো।সকলের সামনে এমন বিড়ম্বনায় কেই বা পড়তে চায়?ক্যাম্পাসে এসেও দেখেছি একই চরিত্র।ফ্রক পরা ছোট্ট এই মেয়েটি অনেকেরই আতঙ্কের কারণ ছিল,আমিও তার বাইরে নই।
একদিন প্রশাসন ভবনের পার্শ্বস্থ আম বাগানে একজন কর্মকর্তাকে এমনভাবে আক্রমণ করেছিল ও লোকটি না পেরে একটা চড় কষে দিয়েছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।লোকটি অত্যন্ত বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল।আসলে লোকটির তেমন দোষ ছিলনা,যে কেউ সেই দৃশ্য দেখলে লোকটিকেই সমর্থন করবে,চড়টিও তিনি আস্তে মেরেছিলেন,জ্ঞান হারানোটাও কতটুকু সত্য ছিল বোঝা মুশকিল।কেননা তার পর পরই দশটি টাকার নোট বের করে দেয়া হয় তখনই ওর জ্ঞান ফিরে আসে।
সেই ছোট্ট মেয়েটিকে হঠাৎ একটি ছোট্ট মেয়ে কোলে দেখা গেল।তখন তার স্বভাবে সম্পূর্ণ পরিবর্তন।শান্ত,মনমরা মুখশ্রী,চুপচাপ সবার কাছে হাত পাতে,কেউ কিছু দিলে নেয়,না দিলে নীরবে সরে পড়ে।
একদিন আমাদের এক কৌতূহলী বান্ধবী ওর বাচ্চা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছিল ওর কাছ থেকে।কিন্তু সেখান থেকে ওর দ্রুত প্রস্থানে সে ব্যর্থ হয়। আজ আমি সেই চেষ্টাই আরেকবার করেছিলাম।
দু’বছর আগে এক রিকশা চালকের সাথে ওর বিয়ে দেয় ওর মা।এখন ওর বয়স পনেরো।স্বামীর আগে দুইটি স্ত্রী ছিল,তারা স্বামীকে ত্যাগ করে গেছে।রিকশা চালিয়ে আসমার স্বামী যা আয় করে তা নাকি নিজেই খেয়ে ফেলে।কীভাবে তা সম্ভব জানতে চাইলাম,কিন্তু ও বলতে পারলো না।
ভিক্ষার টাকা দিয়ে মেয়ের জন্য দুধের কৌটা কেনে,বিয়ের আগে দিত মা কে।
জিজ্ঞাসা করলাম,তুমি এখন এমন মনমরা হয়ে থাকো কেন?
-সব সময় কি মানুষ এক রকম থাকে?
আসলেই তাই।কিন্তু আসমাদের মতন এমন হাজার শিশু রয়েছে যারা নিজেরাই শিশু আবার শিশুর মা,যাদের স্বভাবের পরিবর্তন হয়,কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না।তাদের হামাগুড়ি দেয়া হাত দাঁড়াতে শেখার সাথে সাথে মানুষের সামনে ধরতে শেখে,জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে একমুঠো খাবারের জন্য ওদের স্কুলে যাওয়ার বয়সে রপ্ত করতে হয় ভিক্ষা আদায়ের কৌশল,নিতে হয় ছলনার আশ্রয়।
আসমার মেয়ে সাথী,নিষ্পাপ,নিষ্কলঙ্ক,অবুঝ শিশু,কী যে ফুটফুটে দেখতে!
ওর ভবিষ্যৎ কী হবে ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরলাম।দেখি আম্মু গেটে দাঁড়িয়ে আছেন।বৃষ্টির কারণে গাড়ি পৌঁছতে সামান্য দেরি হয়েছিল।

বাংলাদেশ সময়: ১৮:৪১:১০   ১৫৬৭ বার পঠিত   #  #  #




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ