বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বলেছিলেন “তপ্ত বালুকা সূর্যের মতো তাপ দেয়”। কথাটা যে কতোটা সত্যি তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম ভারতীয় বিমান বাহিনীতে থাকাকালীন রাজস্থানের যোধপুরে পোস্টেড হয়ে। সময়টা ছিল গরমকাল, জুন মাসের মাঝামাঝি, ভীষণ গরম, খুব শুষ্ক আবহাওয়া, দিনের বেলা ঘরে থাকাও অসহ্য। সেখানে আমার একটি বিরল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেই বিষয়ে কিছু বলছি। আমি অবশ্য মনে করি আমি ভাগ্যবান যে এমন বিরল অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। তবে এমন অভিজ্ঞতা আর কারো না হলেই হয়তো ভালো। এই ব্যাপারটি আমার মনে এতোটাই গেঁথে গ্যাছে যে আজো তা মন থেকে মুছে যায়নি।
কার্যোপলক্ষ্যে (প্রশিক্ষণ) আমাদের ইউনিটকে পাঠানো হয়েছিল “থর” মরুভূমির ভারতীয় অংশের গভীরে জনপ্রানীহীন একটি প্রত্যন্ত মরু প্রান্তরে। অনেকেই পর্যটক হিসেবে জয়সলমীরের স্যাম মরু ভূমিতে বেড়াতে গ্যাছেন, সেখানে উটের পিঠে চড়ে অনেক আনন্দ উপভোগ করেছেন। সোনার কেল্লা দেখে আপনাদের কারো কারো হয়তো বিশ্ববরেণ্য চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের “সোনার কেল্লা” সিনেমার কথা, জাতিস্মর ছোট্ট মুকুলের কথা, দুঁদে গোয়েন্দা ফেলুদা ও তাঁর সূযোগ্য সহকারী তপসের কথাও মনে পড়ে গিয়েছিল। আমারও মরুভূমিতে যাবার পথে দূর থেকে সোনার কেল্লা দেখে এসব কথাই মনে পড়ছিল। কিন্তু আমাদের যেতে হয়েছিল ওখান থেকে মরুভুমির অনেক গভীরে একেবারে জনপ্রানীহীন প্রান্তরে।
আমাদের তেরটি গাড়ীর কনভয় যাত্রা শুরু করলো আমাদের যোধপুরের বিমান বাহিনীর বেস থেকে। সৌভাগ্যবশত আমি ছিলাম কনভয় কম্যান্ডার। প্রথমে একটি জিপে আমি কনভয় কম্যান্ডার আর পেছনে তেরটি বড় মিলিটারি ট্রাকের একটি বিশাল কনভয়। আড়াই দিনের এই ক্লান্তিকর মরুভূমি পথ যাত্রায় ক্লান্ত আমরা দিনে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে সারারাত অবিরাম চলা। এই বন্ধুর যাত্রাপথে এক ধরনের রোমাঞ্চও ছিল। অবশেষে আমরা আমাদের গন্তব্য স্থলে পৌঁছে গেলাম, ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে। জয়সলমীর থেকে যতোই আমরা আমাদের গন্তব্যের দিকে এগোচ্ছিলাম ততোই জনপ্রাণী, ঘর বাড়ী, গাছপালা ঝোপঝাড় প্রায় বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। এখানে চারিদিকে শুধুই ধু ধু মরু বালু রাশি।
আমরা সেখানে পৌঁছনো মাত্রই আমাদের সঙ্গী নন-কম্ব্যাট্যান্ট এস্টাব্লিশমেন্টের লোকেরা (এরাও ভারতীয় বিমান বাহিনীর কর্মী, সহায়ক সংস্থা) গাড়ি গুলো থেকে মালপত্র নামাতে ও একের পর এক তাঁবু খাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সেখানে আমাদের দীর্ঘ চোদ্দ দিন কাটাতে হবে। কম্যান্ডিং অফিসার, অ্যডজুটেন্ট, টেকনিক্যাল অফিসার প্রত্যেকে একটি করে তিনটি এবং অন্যান্যরা দুজন করে একটি তাঁবুতে ষোল জনের জন্য আটটি ও একটি রান্না খাওয়ার খুব বড় তাবু। এই বড় তাঁবুটিই হল সহায়ক বাহিনীর সদস্যদের আস্তানাও। এটা আমার জীবনে তাঁবুতে কাটানোর প্রথম অভিজ্ঞতা। তাঁবুগুলো খাটানো হয়ে গেলে কয়েকজন সহায়ক কোদাল নিয়ে তাঁবুর চারিপাশে ট্রেঞ্চ খুঁড়তে লেগে গেল। আমি কৌতূহলী হয়ে এই তাঁবুর চারিপাশে ট্রেঞ্চ খোঁড়ার কারন কি তাকে জিজ্ঞেস করলাম? লোকটি কিছু না বলে একটু হাসল। আমি আবার প্রশ্নটি করতে এবারে সে বলল যে, উত্তরটি আপনি কাল সকালেই পেয়ে যাবেন। আমি আর পরিশ্রান্ত লোকটিকে ঘাঁটালাম না। তারা সবকটি তাঁবুর চারিপাশে অনুরূপ ট্রেঞ্চ কেটে দিয়ে অন্যান্য কাজে চলে গেল। আমরাও যথেষ্ট ক্লান্ত থাকায় রাতের খাওয়া সেড়ে যে যার তাঁবুতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে বাইরে বেড়িয়ে আমার চক্ষুস্থির। দেখি তাঁবুর পাশে ট্রেঞ্চে পড়ে রয়েছে সারি সারি বিভিন্ন মাপের, রঙ্গের ও চেহারার সাপ ইত্যাদি।
আমি আমার রুমমেটকে ডেকে তুলে দেখালাম। দেখে তার চোখ চড়কগাছ। আমি তৎক্ষণাৎ আমার রুম মেটকে ডেকে তাকে দেখালাম যে কি ভয়ংকর বিপদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করে ছিল। ঐ ট্রেঞ্চে পরে থাকা প্রত্যেকটি সাপই ভীষণ বিষধর এবং যতোগুলো কাঁকড়াবিছে তার সবগুলোই ভয়ঙ্কর বিষধর, হুল ফোটালে নির্ঘাত মৃত্যু, অর্থাৎ এমন জন মানবহীন যায়গায় তো মৃত্যু প্রায় অবধারিত। এ তো বিদেশী শ্ত্রু বাহিনীর চেয়েও ভয়ঙ্কর! রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত অবস্থায় নিঃশব্দে আক্রমণের এই সুক্ষ পরিকল্পনাটি বাঞ্চাল করে দিয়েছিল আমাদের নন- নন-কম্ব্যাট্যান্ট এস্টাব্লিশমেন্টের লোকেরা! তারা এসব জানে তাই আমার প্রশ্নের জবাবে বলেছিল এই ট্রেঞ্চ কাটা হচ্ছে কেন তা কাল সকালেই বুঝবেন । তাদের ধন্যবাদ দিলাম। আর একটি কথা ঐ বাহিনীর লকেরা বলেছিল তা হল সাপ বা কাঁকড়াবিছে কোনটাই ট্রেঞ্চের দেয়াল বেয়ে উঠে আসতে পারে না। প্রায় পনের দিন এই আদিগন্ত বালুরাশি ও ভয়ঙ্কর বিষধর জীবেদের পাশে কাটিয়ে এ স্ত্যটা যে স্ত্যি তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।
সকালে চা টা খেয়ে আরেক গুরুতর সমাচার পেলাম। তবে কি আর কন আক্রমনের খবর। না সেসব নয়। তাছাড়া সেসব কে ভারতীয় বিমান বাহিনী তথা ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কোন যোদ্ধাই ভয় পায় না। সমাচারটি ছিল মরু ভূমিতে আর একটি অতি বিরল বস্তু হল জল। আমাদের প্রত্যেকের দৈনিক জলের প্রাপ্তি হল আধ বালতি। এই আধ বালতি জলেই চান সহ যাবতীয় প্রাত্যহিক কাজ সারতে হবে। একশো দেড়শ মাইল দূর থেকে একটি জলের গাড়ী রোজ গিয়ে জল আনবে, এর বেশী একজনকে দেয়া সম্ভব নয়। অগত্যা আর কি করা। রোদে পুড়ে, আদিগন্ত বালুরাশির মাঝে কটাদিন কেটেও গেল। এবার ফেরার পালা। আবার সেই গরমে কষ্টকর বিশাল যাত্রাপথের শুরু। এমন একটি বিরল অভিজ্ঞতা লাভের জন্য মনে মনে ভারতীয় বিমান বাহিনীকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। এবারো আমি কনভয় কম্যান্ডার, আমার জন্য একটি আলাদা জীপ, অর্থাৎ একটু হাত পা ছড়ানোর যায়গা পাওয়া গেলো আর কি। এই আড়াই দিনের যাত্রা পথে সেটা কম প্রাপ্তি নয়। সকালে রওনা হয়েছি, বেলা গড়িয়ে বিকেল, ক্লান্তিকর একঘেয়ে চলা, পথ আর শেষ হয়না। হঠাৎ দেখলাম অর্কদেব আদিগন্ত বালুরাশির মধ্যে কোথায় একটা যেন অন্তর্হিত হয়ে গেলেন। পৃথিবীর আলো চলে গেল, আমাদের বিরামহীন পথ চলা চলতে লাগলো।
লেখক ভারতীয় বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। বর্তমানে কলকাতায় রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ও অন্যান্য বহু বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক।
বাংলাদেশ সময়: ১:৩৫:০২ ১৭৪০ বার পঠিত #আদিগন্ত বালু-রাশি ও অগণিত ভুজঙ্গ মাঝে #ঋত্বিক কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় #বাংলায় চিন্তা #স্মৃতি কথা