
আমি লেখক নই। আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা আমি সবার মধ্যে বিলিয়ে দিতে চাই। জানিনা আমার কলমে আমি ঠিক যেমন ভাবে বলতে চাই তেমন চিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে পারবো কিনা। আমার লিখনশক্তি এখনো সাবালকত্ব প্রাপ্ত হয়নি। আশাকরি পাঠক মহোদয় এ কথাটি মনে রাখবেন।
সূর্য উঠতে তখনো খানিকটা দেরী আছে, চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন, শুধু পূব দিকে আকাশে অন্ধকার ধীরে ধীরে দূরীভূত হচ্ছে। তখন ঘড়িতে সোয়া চারটে। সেটা ছিল ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। আমি ও আমার ব্যাচের অন্যান্যরা একটি মস্ত বড় মাঠে দাঁড়িয়ে আছি ‘স্বাস্থ্যের জন্য দৌড়ের’ অপেক্ষায়। ব্যাঙ্গালরে সেটাই ছিল আমার ভারতীয় বিমান বাহিনীতে যোগদানের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা। আমরা আমাদের ‘ফ্লাইট’ অনুসারী দাঁড়িয়ে। আমাদের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টার সার্জেন্ট চাওলা এসে নিজের পরিচয় দিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। ভাষণটি নিম্নরূপ- ‘ আপনারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ, প্রোফেসার বা কৃষক, কার ছেলে, হিন্দু, মুস্লিম, শিখ, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ কোন ধর্মাবলম্বী সেসব পরিচয় আপাতত ভুলে যান। আজ থেকে আপনাদের শুধু একটাই পরিচয়। আপনারা ভারতীয়’। এরপরে তিনি আমাদের ফাইল অনুসারী তাঁকে অনুসরণ করতে বলে নিজে দৌড় শুরু করলেন। সামনে সার্জেন্ট চাওলা আর পেছনে আমরা। সেই বিশাল মাঠে অনেক বড় বড় গাছ। আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম যে তিনি যখনই কোন একটি গাছকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তখন সেই গাছটিকে ‘গুড মর্নিং, স্যার’ বলে সম্বোধন করছেন এবং আমাদেরও এটা করতে বলছেন। আমার বয়স তখন সবে সতেরো। তখন আমি বুঝিনি তিনি একটি গাছকে কেন এভাবে সম্মান দিচ্ছেন। দৌড় শেষে আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে তাঁকে জিজ্ঞেস করি যে, গাছকে এভাবে সম্মান দেয়ার কারন কি? তিনি একটু হেসে বললেন, ‘ আমারা আমাদের অমুকের পুত্র, তমুকের ছেলে এসব আত্মাভিমান ছেড়ে দিয়ে একজন সৈনিক হিসেবেই নিজেদের পরিচয় দেবো এবং আমাদের নতুন পরিচয় হলো আমরা ভারত মাতার দুঃসাহসী সন্তান’। এরই প্রথম পদক্ষেপ এই গাছ সহ ভারতের সকল সম্পদকে সম্মাননা। প্রথম দিনের প্রথমার্ধ নতুন নতুন ধারনায় ভরে উঠলো। তখনো জানিনা দ্বিতীয়ার্ধে কি
অপেক্ষা করছে।
বিকেল পৌনে চারটেয় আর একটি অন্য মাঠে জমায়েত হওয়া। বিকেলের শরীর চর্চার জন্য সবাই হাজির। এবারে ইন্সট্রাক্টার সার্জেন্ট কে সিং। ইয়া চওড়া ও ঘন তাঁর গোঁফ জোড়া। চেহারায় একটু কঠোরতার ছাপ। নিজের পরিচয় দিয়ে আমাদের আদেশ করলেন- ওই বিশাল মাঠের দুপাশের শেষ প্রান্তের দেয়াল ছুঁয়ে আসতে হবে। প্রথম তিনজনকে তিনি চান। (সত্যি কথা বলতে কি আমি তখন শারীরিক ভাবে আমার ব্যাচের অন্যান্যদের হারাবার মতো সক্ষম ছিলাম না)।
সবাই প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকতে চাইলেও আমি জানতাম যে এটা তখন আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি এসে পৌঁছলাম একেবারে শেষে। সার্জেন্ট সিং যেমন বলেছিলেন, তেমনি প্রথম তিনজনকে বেছে নিয়ে বাকিদের আবার দৌড়তে বললেন, সেই একই সর্তে। আমি তখন যথেষ্ট শ্রান্ত, তাই ভাবলাম যে এভাবে বারবার দৌড়ন সম্ভব নয়, তাই প্রথম তিনজনের মধ্যে আসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম। এবারে প্রথম দিকে প্রথম তিনজনের সঙ্গে আমার দূরত্ব কমই ছিল। কিন্তু এই দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে লাগলো। ফেরার সময় আমি মাঠে আছার খেয়ে পড়ে গেলাম। আমার হাঁটু ও কনুইয়ে খুব লেগেছিল, রক্তপাত হচ্ছিল। খুব যন্ত্রণা বোধ করলেও মনে মনে একটু খুশীও হলাম যে, এবার সেই যন্ত্রণাদায়ক দৌড়ের হাত থেকে মুক্তি পাবো। এবারেও আমি পৌঁছেছি একেবারে শেষে। আমি আমার ক্ষত ও রক্তপাতের কথা বলতেই উনি কালক্ষয় না করে যথাশীঘ্র চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন এবং দশ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা হয়ে গেল। এতক্ষণ দৌড় বন্ধ। এবার আবার দৌড় শুরু। আমি প্রবল আশ্চর্যান্বিত হলাম যে, উনি আমাকেও দৌড়ে যোগ দিতে বললেন। তিনি বললেন, ‘ডোন্ট ওয়ারী বয়, কাম অন, জয়েন’। আমি আমার জীবনের সেই অবিস্মরণীয় দৌড়ে যোগ দিতে বাধ্য হলাম। তখন আমি ভাবছি লোকটি কি নিষ্ঠুর!
সেদিন না বুঝলেও পরে বুঝেছি যে, ভারতীয় বিমান বাহিনীর এই কঠোর প্রশিক্ষণ ব্যাবস্থাই আমার ভবিষ্যৎ কর্মযজ্ঞের দিশারী। আমি আজো ভারতীয় বিমান বাহিনীর সেই অসম সাহসী বীর প্রশিক্ষদের ও আমার সহযোদ্ধাদের মনে মনে শ্রদ্ধা জানাই। সেই শিক্ষা আজও আমার পাথেয়।

(লেখক ভারতীয় বিমান বাহিনীর ভূতপূর্ব আধিকারিক। বর্তমানে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ও অন্যান্য প্রশাসনিক বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক)।
বাংলাদেশ সময়: ২০:০৭:৪৮ ১৬৮০ বার পঠিত # #বিমান #ভারতীয় বিমান বাহিনী