জীবন কৃষ্ণ সরকারঃ
“মানুষ মরে যায় থাকে তাঁর স্মৃতি,কর্ম গুণে শ্রেষ্ঠ যে জন, সেতো থাকবেই সবার অন্তরে গাঁথি।”
ঠিক তাই।বৈচিত্রময় এই পৃথিবীতে চিরদিন কেহই বেঁচে থাকেনা।আসা যাওয়া যেনো প্রকৃতিরই অমোঘ নিয়ম।সকল জীবের জন্যই মৃত্যু অবধারিত।আদম,ইব্রাহিম,ঈসা,মূসা,
প্লেটো,নিউটন,যাদেরই বলুন না কেনো কেহই মৃত্যুকে উপেক্ষা করতে পারে নি,পারবেও না।সম্ভবত বাস্তবতা বুঝেই মরমী সাধক আব্দুল করিম লিখেছিলেন-”বাউল আব্দুল করিম বলে বুঝে ওঠা দায়,কোথায় হতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়”।এভাবেই সময় হলে আব্দুল করিমের নৌকার মতই চলে যেতে হবে আমাদেরকে।মৃত্যু নিয়ে কবি,বিজ্ঞানী,গবেষকদের কৌতুহলের অন্ত নেই।কিন্তু ফলাফল মৃত্যুই চিরন্তন সত্য।তবে মৃত্যু সম্পর্কে মহা কবি মিল্টন একটু ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করে লিখেছেন-”Death is the golden key that opens palace eternity”- মৃত্যু হলো চিরস্থায়ী প্রাসাদের জন্য সোনার চাবি।তাই মৃত্যু সকলের জন্য অপরিহার্যও বটে।তবু ও ক্ষণস্থায়ী জীবনে কেহ কেহ আবার চিরস্থায়ী হয়ে যান আমাদের মাঝে।কথাটির পুরুপুরি বাস্তবায়ন কেবল কর্মের মাধ্যমেই সম্ভব।একমাত্র কর্মই পারে মানুষকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখতে পৃথিবীতে। পৃথিবীতে কর্মে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরাই মানুষের মণিকোঠায় অমর স্মৃতি হয়ে থাকেন সারাজনম।তা প্রমাণিত সত্য।যুগ যুগ ধরে মানুষ তাঁদেরই অনুকরণ,অনুসরণ করে পথ চলে।
প্রিয় লিখি বন্ধুগন,
আজ আমরা তেমনই একজন গুণীজনের কথা স্মৃতিচারণ করছি যার কথা আমরা দিনে,মাসে প্রায় সময়ই বলে থাকি,শুনে থাকি।যাকে বলা হয় বংশীকুণ্ডার সাহিত্যের পথ প্রদর্শক,আলোক বর্তিকা।তিনি আর কেউ নন।তিনি হলেন তিন তিনটি সামাজিক উপন্যাসের লেখক ডাঃ মিরাজ উদ্দিন।পেশায় তিনি একজন ডাক্তার হলেও আজীবন কাটিয়েছেন তিনি সাহিত্যিক,সাহিত্যকে ভালোবেসে।যার প্রমাণ তাঁর তিন তিনটি উপন্যাস এবং অপ্রকাশিত আরো ২২টি উপন্যাস।যে সময়ে সাহিত্য কি জিনিস বংশীকুণ্ডাবাসী কেউ বুঝতোনা বা বুঝার চেষ্টাও করতো না, ঠিক সেই সময়েই সকল অবুঝদের পাশ কাটিয়ে, শত বঞ্চনা,উপহাস সহ্য করে ধরে রেখেছিলেন তাঁর লেখনির ধারাবাহিকতাকে।আজ তাঁর কর্ম জীবনের সমস্ত বর্ণনা হয়তো দিতে পারবো না। তবে বিভিন্ন মাধ্যম হতে আমি যতটুকু জানতে পেরেছি তা আপনাদের মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।কোন দিন আরো বিস্তারিত জানতে পারলে অবশ্যই তা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
জানা যায় ঔপন্যাসিক মিরাজ উদ্দিন ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার দক্ষিণ বংশীকুণ্ডা ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
পারিবারিক ডাকনাম মিরাজ উদ্দিন হলেও গ্রামীন চিকিৎসা প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত হওয়ার পর থেকে অল্প দিনেই তিনি ডাঃ মিরাজ উদ্দিন নামে সমধিক পরিচিতি পান।শুরুতে তিনি বংশীকুণ্ডা বাজার,বিশরপাশাবাজার,কলাগাও বাজার,মধ্যনগর বাজার সহ পার্শবর্তী সকল বাজার, গ্রামে তিনি চিকিৎসা সেবা দিতে থাকেন।সেসময় তিনি গরীব,দুখী সকল মানুষের সান্নিধ্যেই কাটিয়ে দিতেন দিনের অধিকাংশ সময়য়।তবে জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ কাটিয়েছেন তিনি সিলেটের বিশ্বনাথে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত থেকে।যেখান থেকে তাঁর উপন্যাসগুলো প্রকাশিত হয়েছে।সেখানে অনেক বিজ্ঞ সাহিত্য মনস্ক মানুষের সান্নিধ্য তিনি পেয়েছিলে।তবে সাহিত্য সাধনা তিনি অনেক আগে থেকেই শুরু করেছিলেন।তাঁর বড় ভাই লায়েছ ভূঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ সিরাজ উদ্দিন বলেন-”ডাক্তারি প্রশিক্ষণ শেষ করে চিকিৎসা সেবায় মনোনিবেশ করার পর পরই তাঁর মাঝে ঔদাসীন্যতা ব্যাপক ভাবে লক্ষ করা যায় এবং তখন থেকেই সে সমাজ নিয়ে,সমাজের সুখ,দুঃখ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি শুরু করে।ব্যক্তি জীবনে লাভ লসের হিসেবটা তাঁর কাছে প্রায় অপ্রয়োজনীয়ই মনে হতো।মানব সেবাটাকেই সে বেশি গুরুত্ব দিত। আর শখের মাঝে তাঁর খাবার প্রিয়তা এবং বই পড়াটাই আমার কাছে বেশি পরিলক্ষিত হতো।” পিতা মরহুম ওসমান গণি ও মাতা মরহুমা তোতার মা’র পাঁচ ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ।বংশীকুণ্ডা মমিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করার পর বিভিন্ন কারণে পড়ালেখাটা আর হয়ে ওঠেনি।এমতাবস্থায় ১৯৮৪ সালে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বাগোয়া গ্রাম নিবাসী মোঃ আব্দুল খালিক তালুকদার’র মেয়ে মোছাম্মত মাহমুদা খানমের সাথে পারিবারিক ভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বিবাহিত জীবনে তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।তাঁর বড় ছেলে মামুন আহমেদ জগন্নাথপুর উপজেলার কলকলিয়া ইউনিয়নের সফাত উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক(গণিত) হিসেবে শিক্ষতার মহান পেশায় নিয়োজিত।ছোট ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান গোবিন্দগঞ্জ ডিগ্রী কলেজে স্নাতক শ্রেণীতে অধ্যয়নরত।তাঁর দুই মেয়ে মাহিনা আক্তার ও সাদিয়া সুলতানা।দুজনই অবিবাহিত।পিতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর বড় ছেলে মামুন আহমেদ বলেন-”আব্বার মাঝে ত্যাগশীলতা,দানশীলতাটাকেই আমি প্রাধান্য হিসেবে দেখেছি।অর্থাৎ কারো সাথে কোন বিষয়ে কথা কাটাকাটি বা সমস্যা হলে তিনি নিজেকে ছাড় দিয়ে সাথে সাথে তা মীমাংসা করে দিতেন।” তিনি সবসময় একটি কোটেশন বলতেন-
” বাঁচিলেই লাভ কি যদি লোকে দোষে
মরিলেই দোষ কি যদি লোকে ঘোষে।”
সত্য বলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।মানবতার সেবাটাকে দোরগুরায় পৌছে দিতেই সম্ভবত তিনি ২০০৩ সালে চেয়ারম্যান পদে নিজভূমে ইউপি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু জনসাধারণ তা বুঝতে ব্যর্থ হওয়ার দরুণ সেবার তিনি জয়ের মালা পরতে পারেন নি।তবে আশা রাখি সাহিত্য জগতে তিনি চিরদিনই বিজয়ের মালা পরে রবেন আমাদের মাঝে উজ্জ্বল রবির ন্যায়।
সাহিত্য জগতের সাথে ডাঃ মিরাজ উদ্দিন’র পদচারনা অনেকদিনের হলেও দীর্ঘ দিন তাঁর লেখাগুলো প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি তেমন আগ্রহ বোধ করেননি।তবে পাঠক সমাজের ব্যপক চাপে শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশোর্ধ বয়সে তিনি হাত দেন প্রকাশের কাজে।বের করেন তিনটি উপন্যাস -স্বপ্নই বাস্তব(২০০৯),এই সেই দিন(২০০৯) ও বিক্ষত হৃদয়(২০১৪)।তাঁর লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বাসিয়া প্রকাশক মোহাম্মদ নওয়াব আলী বলেন - লেখকের চিন্তা চেতনা এ দেশের মাটি ও মানুষকে নিয়ে।এ দেশের সাধারণ মানুষের জীবন -যাত্রা, অভাব অনটন, শ্রেণী বৈষম্য তাঁর কলমের উপজীব্য খাদ্য।আজকাল উপন্যাসের দিকে চোখ রাখলেই প্রেমের নামে নগ্নতা পরিলক্ষিত হয়। সেদিক থেকে ডাঃ মিরাজ উদ্দিন’র উপন্যাস গুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন।হে বন্ধুরা, আমরা তাঁর লিখা উপন্যাস তিনটি পাঠ করলেই বুঝতে পারি নগ্নতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে বরং সাবলীল ভাষায় চিরন্তন প্রেমের আবেদনকে সার্থক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি।
মিরাজ উদ্দিন’র উপন্যাসে উপমার ব্যবহার অতুলনীয়। উপমার বিন্যাস বড়ো চমৎকার।সহজেই নজর কাঁড়ে পাঠকদের।যেমনটি হয়েছিল আমার।পাঠকদের স্বার্থে কিছু উপমা তুলে ধরছি-
বিক্ষত হৃদয়ে কবির উদৃতি দিয়ে তিনি লিখেছেন-
“কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর
মানুষের মাঝেই স্বর্গ নরক
মানুষেতেই সুরাসুর।”
বাহ! কি চমৎকার উপমা।
একই উপন্যাসে কবির উদৃতি দিয়ে তিনি লিখেছেন-
” ভুলে ভুলে ভরা ভুবন
ভুলিতে মানব জীবন
একটুখানি ভুলের জন্য
কাঁদে মানব সারা জনম।”
মুহুর্তেই উপমাটি মানুষের বিবেক কে নাড়া দিতে সক্ষম।
এই সেই দিন উপন্যাসে তিনি লিখেছেন-
” স্বার্থের শৃঙ্খলে বাঁধা অখিল সংসার
স্বার্থ বিনা কেবা কার কার্য করে তার।”
স্বপ্নই বাস্তব উপন্যাসে কবির উদৃতি দিয়ে তিনি লিখেছেন-
“এমন জীবন তুমি করিবে গঠন
মরিলে হাসিবে তুমি
কাঁদিবে ভুবন।”
বাস্তব জীবনে হয়তো এই উপমাগুলো আমরা সচরাচর শুনে থাকি।তবে উপন্যাসে প্রেক্ষিত বিবেচনায় ব্যবহার অবশ্যই লেখকের বিচক্ষনতারই বহিপ্রকাশ।
বন্ধুগণ, সময় স্বল্পতার দরুন ডাঃ মিরাজ উদ্দিন’র তিনটি বইয়ের পাঠ আলোচনায় আজ আর যেতে পারলাম না।সময় পেলে কোন একদিন অবশ্য তা তুলে ধরবো।
যাহোক, ডাঃ মিরাজ উদ্দিন সম্পর্কে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির বাণী আপনাদের সামনে স্মৃতিচারণ করছি।
বন্ধুগন,ডাঃ মিরাজ উদ্দিন’র মৃত্যুর পর পরই তাঁর স্মরণে বাসিয়া প্রকাশন থকে এইচ এম আরশ আলী সম্পাদিত “ভাঙন” নামে একটি ম্যগাজিন প্রকাশ করা হয়।সেই ম্যাগাজিন থেকে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির উক্তি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
মাসিক মাকুন্দা সম্পাদক খালেদ মিয়া লিখেছেন-
“আর্ত মানবতার সেবক,সৃজনশীল পুরুষ ডাঃ মিরাজ উদ্দিন’র অনন্য বৈশিষ্ট ছিল বই পড়া।তিনি নিয়মিত বই পড়তেন।”
যুক্তরাজ্য প্রবাসী “জনক”সম্পাদক নূরুল হক ময়না লিখেছেন-
“সৎ,আদর্শবান এবং সমাজ সংস্কারক হিসেবে তিনি আমার কাছে অদ্বতীয়। সিঙেরকাছ বাজারে যত মানুষের সাথে উনি পরিচয় হতেন সবাই উনার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যেতো।”
জয় বাংলা পরিষদ বিশ্বনাথ’র সভাপতি সাইদুর রহমান সাঈদ লিখেছেন-
” ডাঃ মিরাজ উদ্দিন একজন ভদ্র,নম্র ও বিনয়ী মানুষ ছিলেন।তিনি একজন প্রগতিশীল লেখক।ঔপন্যাসিক হিসেবে বোদ্ধা মহলে তাঁর ভালো পরিচিতি রয়েছে।”
বীরমঙ্গল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আবুল হাছান লিখেছেন-
“ডাঃ মিরাজ উদ্দিন সারাটা জীবন মানুষের সেবা করেছেন।মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন।সুন্দর সমাজ গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত।”
বন্ধুগন,বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। সময় কাউকেই ছাড় দেয়না।ব্যাতিক্রম হয়নি আজকের আমাদের আলোচ্য মহান ব্যক্তিটির ক্ষেত্রেও।গত ১লা আষাঢ় ১৪২১ বাংলা, ১৫ জুন ২০১৪ ইংরেজী, ১৬ শাবান ১৪৩৫ হিজরী রোজ রোববার বিকেল ৫ টা ২০ মিনিটে আমাদের সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে তিনি চলে যান পরপারে।
প্রিয় লিখি বন্ধুগন, সাহিত্যের নীলিমায় একজন উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম ডাঃ মিরাজ উদ্দিন। তিনি ছিলেন একাধারে ডাক্তার,মানবতার সেবক,সাহিত্যিক,ঔপন্যাসিক তথা আমাদের প্রেরণার উৎস,সৃজনশীলতার উৎস।তাঁর স্মৃতিচারণ করলে দু একটা কলামে লিখে তা শেষ করা যাবেনা।তাই আজ অবেলায় সবার পক্ষ থেকে প্রভুর কাছে আমার একটাই প্রার্থনা,তাঁর আত্মা যেনো শান্তি লাভ করতে পারেন এবং তিনি যেনো অপারে স্রষ্টার দিদার লাভ করতে পারেন।
লেখকঃকবি ও প্রাবন্ধিক।
শিক্ষক,লায়েছ ভূঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, দাতিয়াপাড়া,ধর্মপাশা,সুনামগঞ্জ।
বাংলাদেশ সময়: ২০:৫০:০৭ ৯৬৯ বার পঠিত