বঙ্গ-নিউজ ডটকম: সাহিত্য কার কথা বলে? এ প্রশ্ন সাম্প্রতিক নয়। আদিকালের। আদিকাল বলতে সাহিত্যের সূচনাকাল থেকেই। যখন থেকে সাহিত্যের যাত্রা শুরু তখনো এমন প্রশ্ন ছিল। আছে আজো। হয়তো যতদিন সাহিত্য থাকবে পৃথিবীর বুকে এ প্রশ্নও থেকে যাবে তার সাথে সাথে। থেকে যাবে কারণ সাহিত্য যাদের কথা বলে তার তো কোনো নির্দিষ্টতা নির্বাচিত হয়নি। হয়নি কোনো সীমাবদ্ধতার সম্পৃক্তি। যেহেতু নির্দিষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা নির্ণয় করা যায়নি অথবা যায় না। সেখানে প্রশ্ন তো থাকবেই। এবং সে কারণেই থাকছে। সাহিত্য কার কথা বলে এটা যেমন প্রশ্ন তেমনি সাহিত্য কার কথা বলে না? এটাও একটি প্রশ্ন। সত্যি তো সাহিত্য কার কথা বলে না! সাহিত্যের বিষয় কি কোনো নির্দিষ্টতায় নিমজ্জিত! এ প্রশ্নের জবাব হবে নিশ্চয়ই না। যদি না হয়ে থাকে তবে অনির্দিষ্টতাকেই হ্যাঁ বলবে। অর্থাৎ সাহিত্য কোনো একটি বিষয়ে অথবা একজনের কথা শুধু নয়। অনেক বিষয়ে এবং অনেকের কথাই বলে। বোধহয় সে কারণেই সাহিত্যে এত বৈচিত্র্য! এত আনন্দ! অথবা এত বেদনার ঘনঘটা।
জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য বলে একটি কথা আছে। অর্থাৎ যে সাহিত্য জীবনের সাথে জড়িত। অথবা জীবন নিয়ে যে সাহিত্য রচিত তা-ই জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য। তাহলে সাহিত্য কার কথা বলে? এ কথার জবাব বলাই তো যায়Ñ সাহিত্য জীবনের কথা বলে। জীবনকে নিয়েই সাহিত্যের ছড়াছড়ি। সাহিত্যের পথ চলা। জীবন ছাড়া সাহিত্যের জীবন পাওয়া হয়তো দুষ্কর। হয়তো বলছি এ কারণে এ নিয়ে যথেষ্ট তর্ক রয়েছে। তর্কটি সাহিত্য জীবনঘনিষ্ঠ হবে নাকি শুধু সাহিত্যের প্রয়োজনে সাহিত্য হবে। পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে এ নিয়ে দেশে দেশে কালে কালে সাহিত্যিকরা বিভক্ত জবাব দিয়েছেন। কেউ এর পক্ষে উক্তি করেছেন। কেউ দাঁড়িয়েছেন বিপক্ষে। বিপক্ষে যারা তাদের বক্তব্য, সাহিত্য কেন শুধু জীবনঘনিষ্ঠতায় জড়িত থাকবে। সাহিত্য তো এর বাইরেও থাকতে পারে। এবং থাকেও। সুতরাং শিল্পের জন্য শিল্প তো হতেই পারে। এমন যুক্তি উড়িয়ে দেয়া যায় না। জীবনঘনিষ্ঠতা ছাড়াও সাহিত্য নির্মাণ করা যায়। সৃষ্টি করা যায়। তবে জীবনঘনিষ্ঠতা না থাকলে সে সাহিত্যের শেষ গন্তব্য হয়তো থাকে নাÑ এমন কথা বলে থাকেন অনেকেই। অর্থাৎ যে সাহিত্য শুধু সাহিত্যের প্রয়োজনেই রচিত হয় তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য কিংবা প্রয়োগের ক্ষেত্র খুব সীমিত হয়ে যায়। সীমিত এ কারণে তার ব্যবহারের ক্ষেত্র সর্বজনীন হতে পারে না। এবং হয়ও না। সর্বজনীন হতে না পারা মানে তাকে সীমাবদ্ধতার জলরাশিতে জমে থাকতে হয়। সীমাবদ্ধতা সাহিত্যের আনন্দ খর্ব করে। তাকে সর্বত্র করে তোলার সামর্থ্য থাকে না। ফলে এ সাহিত্যের প্রয়োজনও সীমিত হয়ে যায়। কখনো কখনো ফুরিয়ে যায় এর আবেদন। যে সাহিত্যের আবেদন ফুরিয়ে যায় তাকে মহাকাল মৃত্যুহীন করার কাজ করে না। কাল তাকে বহন করে না। তবে এটা যে সর্বত্র সত্য এবং সব সময় সত্য এমনও কিন্তু নয়। সময় যেমন পরিবর্তনশীল মানুষের প্রয়োজনও তেমনি বিভিন্ন। একই সাথে মানুষের মনও কিন্তু কখনো এক জায়গায় স্থির থাকতে চায় না। এক স্থানে স্থির থাকে না। সে নিয়ত বিবর্তিত। পরিবর্তিত। এবং সব সময় নতুন সন্ধানে ব্যস্ত। সুতরাং মন যাকে গ্রহণ করে সে তো বেঁচে যায়। মন কখন কাকে কিভাবে গ্রহণ করে বা করবে এ তো আর বলা যায় না। তা মনই বলতে পারে কেবল। মনের ওপর তো আর জোর খাটানো চলে না। মনকে মনের ওপর ছেড়ে দিতে হয়। কেননা মনের সাথে কোনো রশি বা শেকলের যোগ নেই। যা ধরে টান দেয়া চলে। বরং সব বন্ধন মুক্তির গান করে মন।
তবে যারা বলেন সাহিত্য জীবনের কথা বলে তাদের দল অবশ্য ভারী। সাহিত্য তো জীবনের কথাই বলবে। জীবনকে ধরেই চলবে। জীবন সাম্রাজ্যে বিচরণ করবে। জীবন তো কোনো সীমাবদ্ধ বিষয় নয়। নয় কোনো সঙ্কীর্ণ উপত্যকা। জীবন এক সীমাহীন সমুদ্রের মতো। যে সমুদ্রে ঝড়-ঝঞ্জা-ঢেউ সবই রয়েছে। রয়েছে প্রশান্ত নীলয়। এমন সীমাহীন বিষয় সাহিত্য হবে এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। আসলে সাহিত্য যার কথাই বলুক সে তো জীবনের কোনো না কোনো অঙ্গের সাথে জড়িয়ে যাবে। জীবনের কোনো না কোনো বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হবে। এ সম্পৃক্তি যেমন আকস্মিক নয়, নয় তেমনি আরোপিত। বরং নিবিড়তায় জড়িয়ে রয়েছে জীবনের সাথে।
জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য পৃথিবীকে জয় করে রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষ তার জীবনের বাইরের বিষয় নিয়ে খুব মাথা ঘামায় না। ঘামায় না কারণ মানুষের সব চিন্তাভাবনা তার পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে। মানুষ স্বপ্ন দেখে এটা সত্য। আবার স্বপ্নটা তো তার জীবনকে ঘিরেই দেখে। জীবনের আশা-আকাক্সা ঘিরেই থাকে স্বপ্নের জগৎ। সম্ভাবনার সব কিছু সেই জীবনকে নিয়েই। আশা-নিরাশার কাহিনীও জীবনের বাইরের কিছু নয়। পাওয়া না পাওয়ার আনন্দের কথা তাও জীবনভর করেই। সুতরাং জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যের চাহিদা আদি থেকেই বয়ে চলছে।
জীবন মানে এক আশ্চর্য রকম প্রবাহ। যা ছুটে চলে অবাক রহস্যের ভেতর দিয়ে। এ রহস্য এমন এক রহস্য যা ভেদ করার সাধ্য সবার থাকে না। কারো কারো ঘ্রাণেন্দ্রীয় তীèতায় জেগে থাকে। তারা যৎকিঞ্চিত জীবনকে তার রহস্যের ভেতর আবিষ্কার করার আনন্দে মেতে ওঠেন। যারা এ আনন্দ স্পর্শ করে তারা থেকে যান পৃথিবীর উদ্যানে। তারা ফুল ফোটান। তারা সৌরভ ঢালেন বাতাসের শরীরে। বাতাস সে সৌরভ নিয়ে বয়ে যায় পৃথিবীর প্রান্তরে প্রান্তরে। সুতরাং জীবনঘনিষ্ঠতা সাহিত্যের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। জীবনের ফুল ফোটানোর আকাক্সা প্রতিটি মানুষের গভীরে লুকিয়ে থাকে। কেউ জানে। কেউ জানে না এ খবর। যারা জেনে যায় তাদের কর্মের পরিধি দীর্ঘ হয়ে ওঠে। তারা জীবনকে অন্য অর্থে নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতিতে পথ মাড়ায়। তারা নিজের দিকে ফেরে বারবার। তারা জানে জীবন একটাই। এই এক জীবনে অর্থপূর্ণ আনন্দ তাকে নির্মাণ করতেই হবে। এ আনন্দ হতে হবে সবার। হতে হবে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের। নিজেকে আবিষ্কার করার মাহাত্ম লুকিয়ে আছে এখানেই।
একজন কবি একজন লেখক তিনি জানেন জীবনই মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। জীবনের চেয়ে দামি আর কোনো বিষয় মানুষের জীবনে নেই। সেই জীবনকে উদ্ধার করার আবিষ্কার করার নেশা প্রতিটি মানুষের থাকে। কেউ কেউ একে আবিষ্কার করে ভীষণ গৌরবের সাথে। এ গৌরব ধারণ করে কেবল সাহিত্য। সাহিত্যের এই যে ধারণক্ষমতা এর সাথে আর কিসের তুলনা চলে। যদি জীবনকে ধারণ করা না যায় সাহিত্যের ভেতর তবে তাকে আর কোথায় থিতু করা যাবে।
মানুষ সাহিত্যের ভেতর স্বপ্ন খুঁজে বেড়ায়। খোঁজে আশা ও আনন্দের নুড়ি। মানুষ জানে সাহিত্যই তার আনন্দ জোগাবে। তার বেদনার ভার বহন করবে। বেদনার উপশমও খুঁজে পাবে সাহিত্যের ভেতর। যদি সাহিত্য জীবনঘনিষ্ঠ না হয় সে কী করে জীবনের স্বপ্ন তুলে ধরতে সক্ষম হবে। প্রেমই জীবনের মূল কথা। প্রেমের বাইরে জীবনের যে অস্তিত্ব তার সৌন্দর্য থাকে না। তার গাম্ভীর্য থাকে না। তার মুক্তিও থাকে না। প্রেম ছাড়া জীবনে কোনো মুক্তি নেই। এ প্রেম শুধু নারী-পুরুষে হবে তা কিন্তু নয়। কাজের সাথেও প্রেমের বন্ধন চিরন্তন। যে কাজে প্রেমের স্পর্শ নেই।, প্রেমের ছোঁয়া নেই। সেই কাজের সৌন্দর্যও নির্মিত হতে পারে না। প্রেমের সৌন্দর্য জীবনকে মহিমান্বিত করে। জীবনকে উদ্বোধিত করে।
অর্থপূর্ণ করে জীবনের সব আনন্দকে। সাহিত্যে এসব ধারণ করতেই হবে। প্রেমের কথা ভালোবাসার কথা সাহিত্য কেন বলবে না। কেন বলবে না জীবনের ব্যর্থতা ও সাফল্যের কাহিনী। কেন জীবনের সৌহার্দ্যকে সম্পূর্ণতার সুখে ভরে দেবে না।
সাহিত্যের জন্য সাহিত্য হতেই পারে। হয়ও। হয়ে আসছে সাহিত্যের সূচনাকাল থেকে। সাহিত্যের জন্য সাহিত্য যা হয় তা চিরকালীন হতে ব্যর্থ হয়। কেননা মানুষের সমসাময়িক আবেদন ক্ষণস্থায়ী। আর জীবনাবেদন চিরস্থায়ী। ফলে ক্ষণস্থায়ী বিষয়-আসয় চিরস্থায়ী হবে কেমন করে। আবার জীবন যেহেতু চিরস্থায়ী আবেদনের দিকে ঝুঁকে থাকে, তাই তার ব্যবহারও চিরস্থায়ী হয়ে থাকে। জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যের আবেদনও তাই চিরকালীন।
জীবনকে যে যেভাবে দেখে জীবন হয়তো সেভাবেই জেগে থাকে তার কাছে। জেগে থাকার সত্যতা মানুষকে স্বীকার করতেই হয়। কেননা জীবন নিজেই সত্যের পক্ষে জেগে থাকে। জীবনের সত্য জীবন দিয়েই বুঝতে হয়। জীবন দিয়েই উপলব্ধি করতে হয় জীবনের দাম। এখানেই জীবনের রহস্য। এখানেই জীবন এক অন্য আঙ্গিকে নির্মিত। এর সাদা অর্থ জীবনবাদী মানুষেরা কখনো জীবনকে অস্বীকার করার দায় নেয় না। বরং জীবনকে উপলব্ধির উৎসর্গে আনন্দিত হয়। আপ্লুত হয়। হয় জীবনের আরো কাছাকাছি। জীবনকে যতটা ভেতর থেকে আবিষ্কার করা যায় ততই বোঝা যায় জীবনের গভীরতা। জীবনের এই যে গাম্ভীর্যতা, একে সাহিত্যই ধারণ করতে পারে। আবার সাহিত্যই জীবনকে সহজতার সান্নিধ্যে হাজির করে। জীবন সেখানে আবেগে সৌহার্দ্যে ভরে থাকে। জীবন এ অর্থ উচ্চকিত করার দায়িত্ব তো সাহিত্যেরই। সাহিত্য জীবনঘনিষ্ঠ না হয়ে উপায় কী?
বিনোদন অথবা চটুলতা সেও তো জীবনেরই অংশ। সেও জীবন থেকেই সজীবতায় উৎকীর্ণ। জীবন থেকেই তার ক্ষণিকতার উপস্থিতি। জীবনই তাকে উপভোগের বিষয় করে তোলে। জীবনের এই যে ক্ষণস্থায়ী এবং দীর্ঘস্থায়ী আয়োজনÑ একে সাহিত্যে ধারণ করতেই হবে, নইলে সাহিত্য হারাবে তার প্রাণ। তার বৈশিষ্ট্য। সাহিত্যের এ ধারণা কিন্তু নতুন কিছু নয়। এটিও এক ধরনের চিরন্তনতার দেহে ভর করে আছে। এ ভর কোনো দুর্বল ভর নয়। এর রয়েছে দৃঢ়তা। এর রয়েছে স্থিরতা। রয়েছে চিরকালীন গ্রহণযোগ্যতা।
জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যের মূল্য সব সময়ই ছিল বেশি। আজো তা বহমান। এর আবেদন কমবে না কখনো। বরং বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষতায় মানুষ জীবনকে আরো তীব্রভাবে উপলব্ধি করার আবকাশ হবে। যান্ত্রিকতা কতটা নির্মোহ তা বোঝার ক্ষেত্রে আর কারো সন্দেহ নেই। কখনো কখনো যান্ত্রিক বিষয়াদি নির্মমতায় পর্যবসিত হয়। এ নির্মমতা কখনো জীবনকে স্নিগ্ধতায় জাগিয়ে দিতে পারে না। পারে না বলেই জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যের এত মূল্য।
(অনলাইন কালেকশন)
বাংলাদেশ সময়: ২৩:১৫:১৯ ৮০০ বার পঠিত