বঙ্গ-নিউজঃ ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর রোড। ২৫ এপ্রিল, বুধবার দুপুর। স্কুলে ছুটির ঘণ্টা বেজেছে সবে। চার লেনের সড়কে স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিতে আসা ছয় ! ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি লেগুনা, রিকশা, মোটরসাইকেল। এক কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কে একটিও বাস নেই। শুধু ধানমণ্ডি নয়, যানজটের ঢাকায় এ দৃশ্য নিত্যদিনের। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঢাকার যানজটের প্রধান কারণ মাত্রাতিরিক্ত প্রাইভেটকার। নিরাপদ গণপরিবহনের অভাবে এ অবস্থা। ঢাকার সড়কে প্রতিদিন গড়ে ৫১টি প্রাইভেটকার বাড়ছে।
প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। পরিবারপ্রতি গাড়ির সংখ্যা সীমাবদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। কিন্তু বাস্তবে উদ্যোগ নেই। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক রাজধানীর দুটি সড়ককে প্রাইভেটকারমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। দুই বছরেও তা কার্যকর হয়নি। মাসের প্রথম শুক্রবার মানিক মিয়া এভিনিউ প্রাইভেটকারমুক্ত রাখার উদ্যোগ গতি হারিয়েছে মাস না ঘুরতেই।
প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনে পরিবারপ্রতি গাড়ির সংখ্যা নির্ধারণের সুপারিশ রয়েছে।
কিন্তু সাত বছর ধরে আইনটি ঘুরছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আগামী অধিবেশনে আইনটি সংসদে উঠতে পারে। সড়ক পরিবহন সচিব নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেছেন, যানজট কমাতে প্রাইভেটকার নির্ভরতা কমাতেই হবে। গণপরিবহনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। আইন পাস হলে প্রাইভেটকারের লাগামহীন বৃদ্ধিতে লাগাম টানা হবে।
প্রাইভেটকার বৃদ্ধির জন্য ‘ভ্রান্তনীতি’ ও গণপরিবহনের দুরবস্থাকে দায়ী করেছেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামছুল হক। তিনি বলেন, গত দুই দশকে ঢাকায় বাসের গতি বাড়াতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। যাতে সুবিধা পেয়েছে প্রাইভেটকার। সাধারণ মানুষ প্রাইভেটকারে ঝুঁকেছেন। গণপরিবহনে স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণের উপায় নেই। ভালো মানের বাসসেবা নেই রাজধানীতে। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুবিধায় মধ্যবিত্তও প্রাইভেটকারে ঝুঁকেছে। গাড়ি বেড়েছে অথচ সড়ক বাড়েনি। তাই যানজটে শহর স্থবির হয়ে গেছে। ঢাকাকে বাঁচাতে প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। কিন্তু তার আগে নিশ্চিত করতে হবে বিকল্প যাত্রীবান্ধব গণপরিবহন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের ফেলোদের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সড়কের ৭৬ ভাগ প্রাইভেটকারের দখলে। কিন্তু প্রাইভেটকারের যাত্রী মাত্র ৬ শতাংশ। বাকি ২৪ ভাগ সড়ক ব্যবহারের সুযোগ ৯৪ ভাগ যাত্রী। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীতে বছর বছর প্রাইভেটকারে ট্রিপ বাড়ছে। ২০১৩ সালে মোট ট্রিপে ৬ দশমিক ৪৩ ভাগ হতো প্রাইভেটকারে। ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ২২। ২০২৫ সাল নাগাদ তা দাঁড়াবে ১১ দশমিক ১২ শতাংশে।
সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত প্রাইভেটকারের সংখ্যা দুই লাখ ৫৪ হাজার ৮৯২টি। জিপ রয়েছে ৩৩ হাজার ৬৪৩টি। ২০১৭ সালে ঢাকায় দৈনিক গড়ে ৫৩টি প্রাইভেটকার নিবন্ধিত হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ৯০ দিনে নিবন্ধিত হয়েছে চার হাজার ৬৪৩টি। ঢাকায় মাইক্রোবাসও বাড়ছে। কিন্তু বিপরীতে মিনিবাস-বাসের সংখ্যা রয়েছে মাত্র সাত হাজার ৮০০।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) যানজটের কারণ চিহ্নিত করে ২০১২ সালে একটি প্রতিবেদন দেয়। তাতে বলা হয়েছিল, ছুটির সময়ে শুধু ধানমণ্ডিতেই ২৬ হাজার প্রাইভেটকার আসে শিক্ষার্থীদের নেওয়ার জন্য। পুরো এলাকায় যানজট সৃষ্টি করে এসব গাড়ি। এ অবস্থার উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে স্কুলে বাস দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। ২০১০ সালে রাজধানীর ১৪টি রুটে দেওয়া হয়েছিল বিআরটিসির স্কুল বাস। যাত্রীর অভাব ও লোকসানের কারণে সেসব স্কুল বাস বন্ধ হয়ে যায় বছর না ঘুরতেই। অভিভাবকরা সন্তানদের বাসে না দেওয়ার কারণেই বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল বলে জানিয়েছেন বিআরটিসির সেই সময়কার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) মেজর কাজী শফিক উদ্দিন।
তেজগাঁও সরকারি বালক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহি রহমানের মা মাকসুদা বেগম জানালেন, অনিরাপদ সড়কের বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের কারণে সন্তানকে বাসে দিতে চান না। এ সমস্যাকে আস্থার সংকট বলছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি সমকালকে বলেন, সারা পৃথিবীতে হলুদ রঙের স্কুল বাস তুমুল জনপ্রিয়। যুক্তরাষ্ট্রে রাস্তায় লাখ লাখ স্কুল বাস চলে। কিন্তু ঢাকায় চলছে না, কারণ অভিভাবকরা বাসকে নিরাপদ মনে করেন না। রাজধানীকে সচল রাখতে স্কুল বাস চালু করতেই হবে এবং সেটাকে নিরাপদও রাখতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ৯:৪৬:০৩ ৬০০ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bangladesh news #bd news #daily newspaper #World News #প্রাইভেটকার