বঙ্গ-নিউজঃ
এক
বিধি বাম!
গেল পহেলা বৈশাখ আনন্দের দিনটা আমার নিরতিশয় নিষ্প্রভ ও নিরানন্দে কেটেছে। নতুন বছরকে বরণ করার পূর্ণ মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম, ছোটে মেয়ে ও নবজাতক নাতীর সাথে বাইরে নৈশভোজ গ্রহণের চিন্তাটাও মাথায় ছিল। কিন্তু ওই যে কথায় বলে ম্যান এপোজেস, গড ডিসপোসেজ (মানুষ চায়, বিধাতা দেয়)। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খাওয়ার পর থেকে অব্যাহত বুকজ্বালা-পোড়া। পেটে গ্যাসের চাপ চিন্তা করে কিছুক্ষণ হাতুড়ে চিকিৎসা চলল। এক পর্যায়ে, উপায়ন্তর না দেখে, ডাক্তার বন্ধুদের পরামর্শে এ্যাপোলো হাসপাতালের ইমারজেনসিতে যাবার পথ বেছে নিতে বাধ্য হলাম। এ্যাপোলো হাসপাতালটি আমার বাসা থেকে পায়ে হাঁটার পথ বিধায় বাড়তি সুবিধা ছিল; নয়তো যানজটে পড়ে জানটাই হয়তো খতম হয়ে যেত। হাসপাতালে ঢুকে দেখি ঝকঝক তকতক করছে। চট করে বোঝা যায়না হোটেল না হসপিটাল। হসপিটাল-মার্কা ওষুধ-ওষুধ গন্ধও নেই। গিন্নীর হাত ধরে ইমারজেনসীতে পা ফেলা মাত্রই পুরোলেন্সধারী শশ্রুমন্ডিত এক তরুন ডাক্তার পিলে চমকানো খবর দিলেন, ‘সম্ভবত একটা মাইলড এ্যাটাক হয়েছে। এনজিওগ্রাম করতে হবে, এক্ষণি ভর্তি নিশ্চিত করুন।’ যেই কথা সেই কাজ। হুইল চেয়ারে বসে গেলাম আইসিইউতে। হাতে কেনোলা, মনিটরের সাথে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সংযোগ, ইসিজি পরীক্ষা সব মিলিয়ে একটা ভীতিকর পরিবেশ যেন না ফেরার দেশে যাচ্ছি।
দুই
আগেকার দিনে, অর্থাৎ দু দশক পূর্বে্ কালে-ভদ্রে হৃদরোগের কথা শুনেছি। অনেকটা অতিথি পাখির মতো নির্দ্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রেও আগমন। অনেকে আবার বলত ‘বড়লোকী রোগ’ অর্থাৎ হৃদরোগ মানে ধনী শ্রেণির রোগ। অথচ গেল দু’দশকে এক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন লক্ষণীয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে ২০১৭ সালে হৃদরোগের ফলে মৃত্যুর সংখ্যা এক লাখের কিছুটা উপর অর্থাৎ, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ১৪ ভাগ মৃত্যু ঘটে হৃদরোগের কারণে। এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশীরা পশ্চিমাদের তুলনায় কমপক্ষে ১০ বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের গড়পড়তা বয়স ৫২ বছর এবং ৪০ শতাংশের বয়স ৫০ বছরের নিচে। খাদ্যাভাস, ধূমপান, মানসিক চাপ ইত্যাদি এই রোগের প্রধান কারণ। দ্বিতীয়ত, তখনকার দিনে এই রোগের চিকিৎসা মানে দেশের বাইরে চিকিৎসা; দেশের ভেতর ব্যবস্থাপনা ছিল খুবই দুর্বল। হাতেগোনা দু’একটা সরকারি হাসপাতালে সীমিত সুযোগ সুবিধা নিয়ে হৃদরোগের চিকিৎসা চলত। ব্যক্তিখাতে হাসপাতাল তখনও তেমন গড়ে উঠেনি আর বিশেষত হৃদরোগের চিকিৎসায় তো কথাই নেই ।। মোট কথা, হৃদরোগ থেকে বাঁচতে চাইলে ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়া নচেৎ দেশীয় চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরা, এই ছিল নিয়তি। এর বিপরীতে, গেল দু’দশক ধরে ব্যক্তিখাতে হৃদরোগ চিকিৎসায় যুগান্তকারী পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এ্যাপোলো, ইউনাইটেড, ল্যাবএইড, শিকদার মেডিক্যাল , স্কয়ার হাসপাতালে স্থাপিত হার্ট সেন্টারে বিশেষত উচ্চবিত্তের জন্য ব্যয়বহুল চিকিৎসার ব্যবস্থা রেখেছে। অনুমান করি, এর ফলে অন্তত হৃদরোগ চিকিৎসার জন্য ভারত বা অন্যান্য দেশে যাবার প্রবণতা নিম্নগামী হয়েছে।
তিন
এ্যাপোলো হাসপাতালে আইসিইউতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, সিদ্ধান্তটা কি ঠিক হল? তার চেয়ে ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুর আর তা না হোক অন্ততে ভারতে যেতে পারতাম। দেবতা দেবী শেঠির কথাও মনে পড়ল। পরক্ষণেই ভাবলাম, সহকর্মী মাহবুব হোসেন থাইল্যান্ড আমেরিকা করেও জীবন বাঁচাতে পারেন নি। মাত্র কদিন আগে সিমীন মাহমুদ আমেরিকাতে ডাক্তার দেখাতে না দেখাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। সুতরাং, মৃত্যু নির্দ্ধারিত এবং অবধারিত। বাকী সব উছিলা।
কম খরচে সরকারি হাসপাতালে যেতে পারতাম কিন্তু মাথায় নিলাম না । নিলেই বা কি হত? রাধা নাগ লিখিত ‘হসপিটাল’ গল্পে দরিদ্র গৃহবধু স্বামীকে মোটা খরচে চিকিৎসা করাতে নিয়ে আসে। ‘সরকারি হাসপাতালে গেলেন না কেন, খরচ কম হত’- এ প্রশ্নের জবাবে বধুটি বলল, “গিয়েছিলাম তো। তিনমাস ফেলে রাখল। ওষুধ, পায়ের ফটো তোলা-এসবে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা লাগল। সারল না।”
চার
বসুন্ধরায় অ্যাপোলো হাসপাতালের আইসিইউতে বাতিগুলো নিভে আসলেও জোনাকির আলোর মতো দু’একটা জ্বলছে। চারিদিকে একটা ভুতুড়ে ভাব। কারও নাকে অক্সিজেনের নল, চোখ দুটো বোজা , মুখটা হা হয়ে আছে। একটা ভয়ের অনুভূতি শিরদাঁড়া বেয়ে সরীসৃপের মতো উঠে আসতে লাগলো। মনে মনে ভাবছি আমার জীবন বাতিও কি ধীরে ধীরে নিভে আসছে? হাসপাতালের বেডে শায়িত আমার মাথায় অনেক চিন্তা ভর করছে। মৃত্যু চিন্তা তো আছেই। ‘মরিতে চাহিনা আমি এই সুন্দর ভূবনে’ বলেও কবিগুরু মৃত্যুবরণ করেছেন। মনে পড়ে বিখ্যাত গানটি, ‘ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময় চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়’। মৃত্যু ভাবনা ছাড়াও একে একে অনেক কথা মনে পড়তে থাকল। শক্ত নার্ভের কথাই বলি। আমাদের কলাবাগান বাসার তিনতলায় এক ইঞ্জিনিয়ার থাকতেন। তার ভগ্নীপতি দারোগা সাহেব বেড়াতে এসে হার্ট এ্যাটাক হয়। এটা নাকি তার তৃতীয় এ্যাটাক। তড়িঘরি করে সহরোওয়ার্দী হাসপাতালে কোন বেড না পেয়ে মেঝেতে শুইয়ে রাখা হল। একটা ছেলেকে দেখভাল করার জন্য হাসপাতালে রেখে সবাই বাড়ি ফিরে আসেন। গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে দারোগা সাহেব ছেলেটিকে বললেন, ‘চুপ, কাউকে বলবি না। যা হোটেল থেকে আমার জন্য কয়েক পিস গরুর মাংস নিয়ে আয়।’ হুমায়ুন আহমেদের ‘সুখ অসুখ’ গল্পে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত রহমান সাহেব মশারির নিচে গোপনে সিগারেট ফুঁকেন- ‘বালিশের নিচ থেকে তিনি সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। হাত দুটি সচল আছে। সিগারেট ধরাতে কোনো অসুবিধা হয় না। ভাগ্যিস কোমরের নিচ থেকে প্যারালাইসিস হয়েছে।”
পাঁচ
‘আপনার বিপি ও ইসিজি দেখতে হবে’- নার্সের মমতাময়ী কন্ঠে আমার চিন্তায় ছেদ ঘটে। ষোড়শী নার্সের বাড়ি পটুয়াখালী। সরকারি এক প্রতিষ্ঠান থেকে নার্সিং-এ ডিপ্লোমা করে এ্যাপোলেতে জয়েন করেছেন। এই হাসপাতালে প্রায় ৫০০ নার্স কর্মরত তারমধ্যে বিদেশী নার্স- ৬০ জনের মতো। নার্সদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা অত্যন্ত ভাল। দেশী নার্সদের শুরুতে বেতন গড়পড়তা ২৫,০০০ টাকার মতো। প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশে অন্যান্য বিপ্লবের মতো নীরবে একটা নার্স বিপ্লব ঘটে চলেছে তা বোধ হয় সবার জানা নেই। সাড়াদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে (অবশ্য মোটা দাগে সরকারি) প্রতিবছর শত শত নার্স বেড়িয়ে আসছে। তারা বেশিরভাগ দেশে কাজ করছে কিন্তু কিছু বিদেশেও যাচ্ছে। পৃথিবীর বেশ কটা দেশ নার্স রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। আমরাও যে সে পথে পা বাড়াচ্ছি তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এর জন্য চাই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান যেখানে মানসম্পন্ন নার্স তৈরি হবে।
কথায় বলে তুমি যাবে বঙ্গে, কপাল যাবে সঙ্গে। ডাক্তারের অভিমত এনজিওগ্রাম করাতে হবে। ভয়ে পিলে চমকে উঠল। দুয়েক দশক পূর্বেও যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে এনজিও গ্রাম করা হতো তার ভয়াবহতা অনুধাবন করে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। পাশে থাকা হার্টের রিং পরিহিত অভিজ্ঞ স্ত্রী চোখের ইশারায় জানান দিলেন কোনো ব্যাপারই নয়। আসলে তাই। সর্বসাকুল্যে আধঘন্টা এনজিওতে দুটো ব্লক চিহ্নিত এবং দুটো রিং ঠেসে দেয়া। ধন্যবাদ ডাঃ শাহাবুদ্দিন ও তার দলকে বাংলাদেশে বসে অত্যাধুনিক চিকিৎসা দেবার জন্য।
পাদটীকা:
মালয়েশিয়ায় বাসরত আমার শ্যালকের শিশুপুত্র ইব্রাহীম আমার অসুখ ও চিকিৎসা শেষে মন্তব্য করেছে, “দোয়া করছি ভালই হইছে, ফুফাজি মরে নাই।” আমি আপনাদের সবার দোয়ায় বাসায় ফিরেছি, মরি নাই।
কিন্তু মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন, আমার মতো ভাগ্যবান ক’জন এদেশে যারা এমনতরো ব্যয়বহুল সুচিকিৎসা নিতে পারে? গরিব-ধনী জীবন তো একই তা হলে কেন কেউ সেবা পাবে, কেউ সেবা পাবে না? চিন্তাটা একান্তই আমার, আর কর্তব্যটা একান্তই রাষ্ট্রের।
অধ্যাপক আব্দুল বায়েস, প্রাক্তন উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৮:৩৪:৪২ ৩১৮২ বার পঠিত #abdul bayes #bangla news #bd news #breaking news #daily online news #hot news