বঙ্গ-নিউজঃ এনি নিউজ পেপার, স্যার?’ ‒ সুশ্রী বিমানবালার সুললিত কন্ঠে যেন সম্বিত ফিরে পাই। তুলে নেয়া পত্রিকার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে চোখ থেমে গেলো একটা খবরের ওপর - “সংসারী হতে জাপানী ছেলেমেয়েদের অনীহা”। দেশটিতে বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিবাহিতদের অনুপাত ক্রমে কমে আসছে। বলা যায় এরা বিয়ে- বৈরি । চকিতে ভাবলাম পারিবারিক দায়িত্ববোধ, শারীরীক অক্ষমতা, বেকারত্ব ইত্যাদি উপাদান বুঝিবা বিয়ে করে সংসারি হবার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক। আবার হতে পারে, জাপানেও ‘দেবদাস’ আছে যারা পার্বতীর প্রেম না পেয়ে ‘পানীয়’তে আকন্ঠ নিমজ্জ্বিত, চন্দ্রমুখীর ভালবাসা পায়ে ঠেলে মৃত্যুমুখী হতে কসুর নেই। কিন্তু এদের সংখ্যাই বা কত। সংসারি না হবার মূলে অসকার ওয়াইলডের সেই কথাও তো সত্যি হতে পারে- ‘যদি শুধু ভালবাসায় কেউ থাকতে চায়, তার বিয়ে করা উচিত নয়।‘ সবশেষে, পশ্চিমা জগতে বিবাহ-বিচ্ছেদ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতও সংসারি হবার পথ আগলে রাখছে হয়তো।
এসবের কিছুই না। আমার প্রারম্ভিক ধারণা অমূলক প্রমাণ করে পত্রিকার বিশ্লেষণ বলছে, সংসারবিমুখ হবার মূলে রয়েছে ক্রমবর্ধিষ্ণু ভোগবাদী চিন্তা-চেতনা। আজকাল ছেলেমেয়েরা প্রচুর উপার্জন করছে কিন্তু থাকছে বাবা-মার ‘হোটেলে’। এমনকি কাপড়চোপড়ের খরচ বহন করেন অভিভাবক তথা ‘গৌরীসেন’। বিপুল আয় দিয়ে তারা বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে দেশ-বিদেশে ডেটিং আর মাস্তি করে বেড়ায়; বিপুল উপার্জনের সিংহভাগ ব্যয় করে লেটেস্ট মডেলের গাড়ী, ঘড়ি কিংবা প্রযুক্তিগত ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে।
অনুমান করলাম , যৌন ক্ষুধা মেটানোর ক্ষেত্রে তারা বিয়ের পথ না ধরে অর্থনীতির বিখ্যাত সূত্র অনুসরণ করে চলেছে: বাজারে দুধ সস্তা হলে গাভী কেনা শুধু নিরর্থকই নয়, নিবুর্দ্ধিতারও পরিচায়ক। এমনকি আমাদের দেশেও অনেকে মনে করে বিয়ের পাত্র বা পাত্রী ক্রয় করা যন্ত্রের মতো – কপাল ভাল থাকলে ভাল সেবা আর কপাল মন্দ হলে যন্ত্র যন্ত্রণাদায়ক। একলা থাকার ‘মজা বহুমুখীকরণ করা যায়; দোকলা হলে সেই মজায় অন্য একজন ভাগ বসায়। তারপর সন্তান, নাতী-নাতনী এসে কেকটাকে এত ছোট করে ফেলে যে নিজের অংশ দূরবীণ দিয়েও দেখা যায় না।
তা ছাড়া, কপালের ফেরে যদি ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছায়াছবির মতো জল্লাদি বউ ঘরে আসে তা হলে তো রক্ষা নেই । চুপিচুপি ছাদে বসে হারমোনিয়ামে গান ধরতে হবে, “এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে , এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে…“। এমনিভাবে, বিয়ে বিরোধীদের বক্তব্য হচ্ছে, বিয়ে মানে বশ্যতা । অপর দিকে, ব্যাচেলর মানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে মজা লুফে নেয়ার অবারিত অবকাশ –‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা মনে মনে/মেলে দিলাম গানের সুরের এই ডানা মনে মনে’। ব্যাচেলর মানে সারাক্ষণ মজাতে মজে যাওয়া। সুতরাং, নো সংসার ডু ফুর্তি!
‘মজা’ শব্দটা যখন মগজে এসেই পড়ল তখন মজার একটা ঘটনা না বললেই নয়। ১৯৮১ সালে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় গ্রাজুয়েট হাউসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক দম্পতির সাথে আলাপ করছি। হঠাৎ বন্ধু-পত্নী আংগুল তাক করে বন্ধুটিকে বললেন, ‘ ওই দ্যাখো, দ্যাখো । একটা ছেলে ও একটা মেয়ে কী সুন্দর পরস্পরের কোমরে ধরে হাঁটাহাঁটি করছে। এরি নাম প্রেম, এরি নাম ভালবাসা, বুঝলে? দেখে বুক ভরে যায়’। ভেবেছিলাম অতটুকুই কথা, কিন্তু না। ভেঙ্গচি কেটে বন্ধু-পত্নী যোগ করলেন, ‘আর তুমি? তোমার ভালবাসা শুধু মুখে; বিরস-বদন, হুতুম প্যাচার মতো মুখ করে দশ হাত দূর দিয়ে হাঁট’। এতক্ষণ ধৈর্য্য ধরে স্ত্রীর অভিযোগ শুনে বন্ধুবর শুধালেন, ‘গিন্নী , ওরা ব্যাচেলর। এসব দেশে প্রায়ই কোমর বদল হয়। আমি তো ইহ জীবনে এক কোমর ধরে সমস্যায় কোমর পানিতে পড়ে শুধু নাক ডোবার অপেক্ষায় আছি । রোমান্স আসবে কোত্থেকে- ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধি বলে একটা কথা আছে না’? বন্ধুটির কথা শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার অবস্থা।
কথায় বলে, কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ। এমনতরো অবিবাহিতদের যখন পৌষমাস, অর্থনীতির তখন সর্বনাশ। জাপানের সেই দিনের খবর বলছে, বিয়ের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের জন্য ফার্নিচার, তেজসপত্র ও আবাসন খাতে চাহিদা সংকুচিত। এতে করে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ, বিয়ে-শাদী নেই ছেলেমেয়েদের, অথচ ঘুম নেই ব্যবসা-বণিজ্যের। একে বলে লিংকেজ বা গুণক প্রভাব। চুল না কাটালে নাপিতের আয় হয় না। আয় না হলে সে চাল কিনতে পারে না যার ফলে চাষীর আয় হ্রাস পায়। চাষীর আয় কমে গেলে অন্যান্য পণ্যের চাহিদা হ্রাস হয়ে বেকারত্ব বাড়ে। অথচ বিয়ে-শাদী হলে প্রভাব হতো ইতিবাচক কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি। এতো গেল ফাস্ট রাউ-। দ্বিতীয় রাউন্ডে সন্তান এসে অন্যজাতীয় দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি করে এবং তার ঘরের সন্তান অর্থাৎ নাতি-পুতি অর্থনীতিতে চাহিদা সম্প্রসারণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। এসব সংবাদ অর্থনীতির স্বাস্থ্যের জন্য স্বস্তিদায়ক ও সুখকর।
মানুষ কেন বিয়ে করে সংসারি হয়? নোবেলজয়ী গ্যারি বেকার বলেছেন, যে কারণে মানুষ একে অপরের সাথে বাণিজ্য করে, ঠিক সেই কারণে বিয়ে করে। পুরুষ যদি শ্রমবাজার উপার্জনে পারদর্শী হয় আর মেয়েরা পারিবারিক ও শিশু পরিচর্যায়, তা হলে আপেক্ষিক সুবিধার ভিত্তিতে বিয়ে দুজনের মঙ্গল বৃদ্ধিতে সহায়ক। তাছাড়া, ধর্মীয়, সামাজিক ও অন্য কারণেও মানুষ বিয়ে করে সংসার পাতে- যেমন ভালবাসা, সেক্স, বংশবৃদ্ধি এবং প্রয়োজনে অধিকতর আয়। তা ছাড়া, পৃথিবীর অনেক দেশে বিবাহিতদের জন্য কিছু বিশেষ সুবিধা দেওয়া থাকে। “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে” যুক্তিযুক্ত হতে পারে, তবে এ সমস্ত সুবিধাদি বিবেচনায় নিয়ে পাত্রী পেয়েও পাত্রস্থ না হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয় না।
বেশ কিছু গবেষণা বলছে, যারা বিবাহিত তারা ব্যাচেলরের চেয়ে বেশি সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করে বিশেষত শিশু পরিচর্যা, ফার্ণিচার, আবাসন ইত্যাদি খাতে। বিবাহিত বলে অনেক খরচ শেয়ার করা যায় যেমন একই গাড়ি, একই বাড়ি। একলাদের চেয়ে দোকলাদের আয়ু নাকি অপেক্ষাকৃত বেশি প্রধানত এই কারণে যে দোকলা স্ট্রেস শেয়ার করতে পারে। সংসার পাতলে খুনসুটি, এমনকি মারামারি, হবে এসব চিন্তা করে একাকী ও নিঃসঙ্গ জীবন সমেত একলা চলা কাম্য নয়। দাম্পত্য জীবনকে নেসেসারি ইভিল বা প্রয়োজনীয় শয়তান হিসাবে বিবেচনা করেও সংসারি হওয়া যায়। তবে হ্যাঁ, দাম্পত্য জীবনের বিরহ-বিবাদ বা অসুখ-বিসুখ যদি দূরারোগ্য হয় তা হলে তা ক্যান্সারের মতোই ব্যয়বহুল এবং কেটে ফেলতে হয়। দাম্পত্য জীবন কেটে ফেলা মানে বিবাহ-বিচ্ছেদ অথবা আলাদা বাস করা। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, গেল এক দশকে বাংলাদেশে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বেড়ে প্রায় দ্বিগুন হয়েছে; সেপারেশন বেড়েছে তিনগুণ। গ্রামাঞ্চলে বিচ্ছেদের অনুপাত অপেক্ষাকৃত বেশি। বিবাহ-বিচ্ছেদ বৃদ্ধি পাবার অন্যতম প্রধান কারণ শিক্ষা ও স্বাধীনতা, শিথিল পারিবারিক মূল্যবোধ ও বন্ধন, বিয়ের বাইরে সম্পর্ক ইত্যাদি।
বাংলাদেশের মতো বহু দেশে বিবাহ বিচ্ছেদ খুব একটা ব্যয়বহুল নয় বিধায় ঝটপট বিয়ের বিদায় ঘন্টা বাজে। সংসার ভেঙ্গে যায়। তবে কোথাও কোথাও বিবাহ বিচ্ছেদ অনেক সময় জীবনকাড়া ব্যয়বহুল হতে পারে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ফরাসী দেশের বিখ্যাত ব্যবসায়ী এলেক ইউলডেনস্টেন ও তার স্ত্রী জেসিলিনের বিয়ে ভেঙ্গে গেলে এলেককে কড়ায় গ-ায় আড়াই বিলিয়ন ডলার গুনতে হয়েছিল। তালাকের ক্ষেত্রে এটা সর্বোচ্চ পরিশোধিত অর্থ এবং এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে পুরো একটা পদ্মা ব্রীজ না হলেও অন্তত পদ্মাব্রীজের ৭০-৮০ ভাগ সম্পন্ন করা সম্ভব। বিখ্যাত ব্যবসায়ী রপার্ট মুরডক ও এনা মুরডকের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ত্যাগ’ গল্প শত সমস্যা সত্বেও অবিচ্ছেদ্য বা সংসারি হবার সাহস জোগায়। চুটিয়ে প্রেম করে কুসুমকে যখন ঘরে তোলা হয়, ব্রাহ্মণ গোত্রীয় হেমন্ত জানতনা যে কুসুম শূদ্র বংশীয়। জানাজানির পর সে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলে বিয়েটা ভেঙ্গে যাবার অবস্থা দাঁড়ায়। এরপর রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ধারা বিবরণী শুনুন:
হরিহর মুখুজ্জে বলিলেন, “অনেক হইয়া গিয়াছে, আর সময় দিতে পারিবনা। মেয়েটাাকে ঘর হইতে দূর করিয়া দাও।”
হেমন্ত উঠিয়া গিয়া পিতাকে বলিল, “আমি স্ত্রী ত্যাগ করিবনা।”
হরিহর গর্জিয়া উঠিয়া কহিল, “জাত খোয়াবি?”
হেমন্ত কহিল, “আমি জাত মানি না”
“তবে তুইসুদ্ধ দূর হইয়া যা।”
অধ্যাপক আব্দুল বায়েস, প্রাক্তন উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৪:১৬:৫৮ ১৪৩১ বার পঠিত