বঙ্গ-নিউজ প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “গল্পের বিষয়বস্তু পাওয়া যায় নিজের জীবনের নানান অভিজ্ঞতা থেকে। কখনও-কখনও কোনও দৃশ্য , কোনও নাম কিংবা একটিমাত্র শব্দ থেকেও ঝলসে ওঠে কাহিনি। জীবনের সর্বত্রই তো ছড়িয়ে আছে গল্প, কিন্তু ঠিক কোন মুহূর্ত থেকে শুরু করতে হবে, সেটাই রচনার মূল সূত্র ।“
খুব সম্ভবত চুরানব্বই কিংবা পঁচানব্বইর কথা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) নতুন কলাভবন নিয়ে একটা মজার ইতিহাস, একটা উপভোগ্য গল্প কিংবা নাটক রচিত হয়। সমাজ বিজ্ঞান আর প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিষয়ে আলাদা ভবন নির্মাণের বেশ কিছু দিন পর কলা ভবনের চিন্তা কর্তৃপক্ষের মাথায় আসে। কলা ভবনের সদস্যরা আপাতদৃষ্ট এই ‘অবজ্ঞা। মোটেও মেনে নিতে পারছিলেন না। কলা কম কিসে? এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন তিনজন উপাচার্য ছিলেন কলা অনুষদ-কেন্দ্রিক সাহিত্যের দিকপাল – সৈয়দ আলি আহসান, এনামুল হক ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকি। কলাভবনের লোকেরা ভাবতে শুরু করল, কর্তৃপক্ষ কলাভবন নিয়ে ছলাকলা করছে এবং তাদের অবস্থা অনেকটা শায়েস্তা খাঁর বংশধরদের মত – আন হার্ড, আন সাঙ্গ ।
কিন্তু মিলিওয়ন ডলার প্রশ্ন দাঁড়ালো কোথায় হবে ভবন? এ নিয়ে জাবি সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে অনেকটা বিবাদে জড়িয়ে পড়লো । কলা অনুষদের শিক্ষকদের বৃহৎ অংশ চেয়েছিল বর্তমান অবস্থানে ভবনটি নির্মিত হোক - অর্থাৎ শহীদ মিনার লাগোয়া উত্তর দিকে লেকের তীর ঘেঁসে বনজঙ্গলে আবৃত ত্রিভুজাকার জায়গাটি । অপরদিকে, গোটা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ ও সিন্ডিকেটের মত ছিল ভবনটি হবে সালাম-বরকত হলে যাবার ডান দিকে কবির সরণির কোণায় বর্তমানে যেখানটায় সম্প্রসারিত প্রশাসনিক ভবন দাঁড়িয়ে আছে । সিন্ডিকেট এমনতর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শুধুমাত্র পরিবেশ ও নৈসর্গিক শোভা সংরক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকে।
যাই হোক, ইউজিছি থেকে অর্থ আসা শুরু হয়ে গেছে, এবং ইউজিছি জানে নতুন কলা ভবনের নির্মাণ কাজ জোর কদমে এগিয়ে চলেছে। একদিন সিন্ডিকেট সদস্য, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, সউদা আক্তার সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার জন্য আবারও শিক্ষকদের মতামতের গুরুত্ব তুলে ধরলেন। একমাত্র মহিলা সদস্যের অনুরধ সিন্ডিকেট গ্রহণ করল। ভিসি তখন আমিরুল ইসলাম চৌধুরী ।
বস্তুত ওটা ছিল আগায় গলদ। এই সুযোগে ইতিহাসের প্রফেসর আতাউর রহমান খানের নেতৃতে কলা অনুষদের শিক্ষকগণ যেন ‘জেহাদি’ চেতনায় জাগ্রত হলেন – লড়কে লেঙ্গে নতুন কলাভবন! বাদানুবাদে আটকে গেল প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। প্রফেসর চৌধুরীর পর ভিসি আলাউদ্দিন আহমেদ গিয়ে প্রায় তিন বছর পর আমি ভিসি হলাম। দেখলাম, কাগজেকলমে নতুন কলা ভবন , বাস্তবে বনজঙ্গল।ঐ যে কথায় আছে, কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই সেইরকম অবস্থা আর কি। নতুন কলাভবনের জন্য আনা অর্থ দিয়ে বেতন ভাতাদি ও অন্যান্য খরচ চলল বেশ কিছুদিন।
ভিসির চেয়ারে বসার পর প্রথম লাল সঙ্কেত বা রেড এলারট দিল নিরমিতব্য কলাভবন। আমিও মাঝি, গাঙ্গও বাঁকা ।ইউজিছি স্পষ্ট জানিয়ে দিল, আগামি কমাসের মধ্যে অগ্রগতি না দেখাতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কিস্তি স্থগিত করা হবে। সেই সময়টিতে আমি যখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছিলাম তখন সখ্যতার সুত্র ধরে ডাক্তার আব্দুল হান্নান ও স্নেহভাজন ছাত্র আইনজীবী বসির আহমেদের মাধ্যমে ঠিকাদার এবাদুল কারিম বুলবুলকে ডেকে পাঠালাম।
ঠিকাদার ঠায় জানিয়ে দিলেন যে তিনি প্রায় তিন বছরের পুরনো কাজ করবেননা কারণ ইতিমধ্যে উপকরণের মুল্য বৃদ্ধি ঘটেছে। কথা শুনে আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো। জনাব এবাদুল কারিম ঠিকাদার ছিলেন তবে সাধারণ শ্রেণীর নন; শিক্ষিত, উচ্চ বংশীয় এবং মার্জিত । বললাম, আমার মান-সন্মানের দিকে তাকিয়ে মুনাফায় মন না দিলে বাধিত হব। প্রথমে গাঁইগুই করলেও পরে রাজি হলেন। বললাম আরও যে, অমুক মাসের অমুক দিনের অমুক সময়ে নতুন কলা ভবনে বসে চা খেতে চাই।
যেই কথা সেই কাজ। মাঝখানে অবশ্য কিছু সহকর্মী পরিবেশ ধ্বংসের প্রতিবাদ স্বরূপ গাছের ডালে ডালে লাল নীল ফিতা ঝুলিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ করেছিলেন। তবে কোন হৈচৈ নয় , নয় ঘেরাও বা অবরোধ । ভাল গিন্নির মত ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান শেষে স্বামীর সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া ।
গুনেগুনে মাহেন্দ্রক্ষণের দিন উপস্থিত হলে আমরা সবাই নির্ধারিত দিনে ও সময়ে নতুন কলা ভবনে বসে চা খেয়েছিলাম – সেটা ছিল অন্তত আমার জীবনের সেরা চা । যুক্ত হয়েছিল শায়েস্তা খাঁর অস্তায়মান বংশধরদের আনন্দ মিছিল।
ইদানিং আমি হৃদ রোগে আক্রান্ত । ডাক্তারের পরামর্শে পূর্ণ বিশ্রামে আছি কিন্তু অতীত যে পিছু টেনে নিল। তাই জাবি নতুন কলা ভবন নিয়ে গল্প ফাঁদা যদিও , “আমি হৃদয়ের কথা কহিতে ব্যাকুল শুধাইলনা কেহ।“
অধ্যাপক আব্দুল বায়েস, প্রাক্তন উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৫:০৮:০৩ ৫৪১৪ বার পঠিত #abdul bayes #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #breaking news #jahangirnagar university #World News #আব্দুল বায়েস