আজ স্বাধীনতা দিবস,বাংলাদেশের জন্মদিন!
দিনটি সেলিব্রেট করতেই আজ খুব ভোরে উঠেছি।
এবারের শাড়ির আঁচলটা লাল,বডি’তে সবুজ,চিকন লালপাড়।
সবাই বলল,বড় লাল টিপের সঙ্গে আমাকে নাকি খুব মানাবে।
মানিয়েছিলও,টকটকে লাল লিপিস্টিক,টিপ,খোপায় রক্তরঙা গোলাপ।
এতো ভোরে সাজগোজ,তবু বিরক্ত লাগছিল না,কেমন যেন একটা উত্তেজনা-
একেই কি তাহলে দেশপ্রেম বলে?
বাইরে বেরিয়ে দেখি আবছা অন্ধকার,তবু সবাই সাজগোজ করে চলে এসেছে।
বার্থডে সেলিব্রেশন বলে কথা,তাও আবার বাংলাদেশের!
এফবি’র প্রোপি’তে গতকালই লোগো লাগিয়েছি-
‘এ প্রাণ আমার বাংলাদেশ’।
যাহোক,এখন একটা রিক্সা পেলেই হয়।
কিন্তু,রিক্সা সহজে পাওয়া গেল না।
রিক্সাওয়ালাগুলো যে কী!জানেনা আজ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডে?
সকাল সকাল না উঠে কী করে এই ছোটলোকগুলা?
হাঁটতেই শুরু করলাম,সবাই হয়তো এতক্ষণে চলে এসেছে।
কিছুদূর যেতেই পা ফসকে খেলাম হোঁচট।
আজকের দিনটাই,খারাপ বলি কি করে,আজ যে বাংলাদেশের জন্মদিন!
হয়তো আমার জন্য খারাপ,হয়তো ভালোও।
কেননা কাছেই পেয়ে গেলাম জুতা সেলাইয়ের ব্যবস্থা,সেই সাথে বসারও।
লোকটা বেশ স্মার্ট,নইলে একটুখানি ঝুপড়ি ঘর তাতে আবার বসার ব্যবস্থা!
আমার সাজগোজ দেখে জুতা সেলাই করতে করতে বলল,
”এতো সকালে কোনে যাবেন গো মামনি?”
প্রশ্ন শুনে খেয়াল করলাম লোকটার দিকে-
বয়স সত্তরের কোঠায়,চোখে মোটা কাচের কমদামি ফ্রেমের চশমা,
দাঁতগুলো পড়া,কুঁচকে যাওয়া চামড়াওয়ালা গায়ে পাতলা ছেঁড়া চাদর।
বললাম,”আজ ছাব্বিশে মার্চ,এই দিনে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল।
সেজন্য সারা দিনব্যাপী জেলা প্রশাসনসহ সকল প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে
নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে,
সেখানেই যাচ্ছিলাম।”
লোকটি নিশ্চুপ দেখে তার দিকে তাকিয়ে দেখি,
কমদামি ফ্রেমের মোটা গ্লাসের চশমার নিচে টপটপ করে পানি ঝরছে।
বললাম,”এ কি?আপনি কাঁদছেন কেন?”
রুদ্ধকণ্ঠে বললেন,”ও কিচু না মামনি,
হটাত করে যাগার সাতে যুদ্দো করিলাম তাগার কথা মনে পড়ে গেল,
মণি,প্রকাশ,বক্কর,তহুরুল…”
বলতে বলতে তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
আমি তো হতবাক!
বললাম,”তার মানে আপনি মুক্তিযোদ্ধা?”
উত্তর না দিয়ে চুপচাপ চোখের পানি ঝরাতে লাগলো লোকটা।
বললাম,”তবে আপনার এমন দশা কেন?বাংলাদেশ সরকার তো
মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভাতা দেয় তাতে…।”
লোকটি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,”আমি যে কোনো দল করিনে মামনি,”
তারপর একটু অভিমান মিশ্রিত অহংকারের সুরে বলল,”জীবন বাজি রাকে যুদ্দো করিচি,ভিটে-মাটিকে নিজির করে পাবো বলে,
একটা পতাকা পাবো বলে,এই যে আজ তুমরা,আমাগের ছেলেমেয়েরা,
স্বাধীন হয়ে চলতি-ফিরতি পারচো,তার জন্যি।
আর আমাগের কিচু দরকার নেই…দরকার নেই…!
তবে কী মামনি,যকন এই মুচির ঝুপড়ি দুকানের সামনে দিয়ে
যে রাজাকার আমি যুদ্দে গিইলাম বলে আমার বাড়ি জ্বালিয়ে দিইলো,
আমার বৌটা ধরে দিয়াইল পাকিস্তানি ক্যাম্পে,
যার জন্যি বৌ আমার গলায় কলসি বান্দে পুকোরি ডুবে মরিল।
সে আমার সামনে দিয়ে মুকতিযুদ্ধা সাজে যখন ফুল নিয়ে বুক ফুলিয়ে বাড়ি ফেরে এই স্বাধীনতা দিবসে,
মনে হয় আবার যুদ্দো করি,রাজাকার মুক্তির যুদ্দো!
কিন্তু,বুকি বল থাকলিও শরীলির বল…”
কণ্ঠ জড়িয়ে আসায় হয়ত থেমে গিয়েছিল লোকটি।
কিন্তু তার জ্বলন্ত চোখদুটি চশমার মোটা কাচ ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে আসতে চায়!
দুটি লালগোলাপ নিয়েছিলাম হাতে,
স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেব বলে।
রাখলাম তার পায়ের কাছে,
মনে হলো,এই তো জীবন্ত স্মৃতিসৌধ যার মূল্য অপ্রতিম কিন্তু,নেই মূল্যায়ণ!