আল-আমিন আহমেদ ,বঙ্গ-নিউজ:-
সুনামগঞ্জের মোট ৫টি সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার প্রতিটিতে জনসংখ্যা ও ভোটার সংখ্যার পরিমাণ ও অনুপাত মোটামুটিভাবে সমান থাকলেও (অর্থাৎ প্রতিটিতে যথাক্রমে প্রায় ৫ লক্ষ জনসংখ্যা ও ৩ লক্ষ ভোটার সংখ্যা), এর মোট ১১টি উপজেলার ৩টি, ১২টি থানার ৪টি , ৮৭টি ইউনিয়নের ২৩টি এবং প্রায় ৩৭৪৭ বর্গ কি.মি. এলাকার ১২০৬ বর্গ কি.মি. সুনামগঞ্জ-১ এর আওতায়। ধর্মপাশা, মধ্যনগর, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ – তিনটি উপজেলা কিন্তু চারটি থানা নিয়ে গঠিত এই সংসদীয় আসনটি। খুব শীঘ্রই মধ্যনগর থানা উপজেলায় রূপান্তরিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে মোট চারটি উপজেলা থাকবে এই আসনে।
এটি একটি বিস্তীর্ণ, নান্দনিক ও সম্পদশালী হাওড় অঞ্চল, কিন্তু অত্যন্ত অবহেলিত জনপদ। অনেক রাস্তাঘাট যান চলাচলের অনুপযোগী, হাওড় অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবে জন চলাচলের কোন পথ নেই বলেই চলে। শিক্ষার হার ও মান নিম্ন এবং স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ অপ্রতুল ও এর মান আরও নিম্ন। মানুষের জীবনমান অত্যন্ত নিম্ন, জীবিকার সুযোগ সীমিত এবং এর মান জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ প্রতিকুলতার ঝুঁকিতে আবদ্ধ। প্রাকৃতিক ও হাওড় সম্পদের উপর প্রকৃতপক্ষে গণমানুষের অধিকার নেই বললেই চলে। সামাজিক ন্যায়-বিচারের প্রত্যাশা কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিরবে কাঁধে। মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমেও মানুষ যথেষ্ট হয়রানির শিকার হয়। অধিকন্ত, প্রতি বছরের হাওড়-বাঁধ দুর্নীতি ইস্যু হাওড় অঞ্চলের কৃষকদের অসহায়ত্ব বাড়িয়ে তুলছে।
স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও এটি কেন এত অবহেলিত? স্বাধীনতার প্রথম দিকে সরকারি সম্পদের সীমাবব্ধতা বা অপ্রতুলতার কারণে জাতীয় সরকার থেকে তেমন সহায়তা পাওয়া যায়নি, কিন্তু ১৯৯৬ পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে ২০০৮ সাল থেকে এই এলাকার উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ নজর দেন ও অপরিমেয় সাহায্য সহযোগিতা করেন। কিন্তু নির্বাচিত সাংসদের অদক্ষতা ও নেতৃত্ব দুর্বলতার কারণে, এবং এলাকাবাসীর মতে তার দুর্নীগ্রস্ততার কারণে এলাকায় উন্নয়নের নামে যা হয়েছে সেটি আজাব – অনেক রাস্তাঘাটে সাইকেল বা মোটর সাইকেল দিয়েই চলা যায়না। তবে এটাও সত্যি যে তার চেয়ে অনেক বেশি অভিযোগ পাওয়া যায় বিগত বিএনপির সাংসদের বেলায়। জনপদ আর এর নান্দনিকতাকে বরাবরই অবহেলা এবং/অথবা পদদলিত করা হয়েছে এখানে। পার্থক্যটা হল বর্তমান সাংসদ সরকারের কাছ থেকে অনেক সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন কিন্তু সেগুলোকে পরিকল্পিত, স্থায়িত্বশীল ও মানসম্মত উন্নয়নে রুপ দিতে পারেননি। অধিকন্ত, স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের সাথে দূরত্ব তৈরি করেন এবং তার বিরুদ্ধে জামাত-বিএনপিকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ উঠে। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে উপজেলা পর্যায়ের কিছু রাস্তার মানসম্মত সংস্কার কাজ হয়েছে ও চলছে এবং স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সাথে দূরত্ব কামানোরও চেষ্টা চলছে। কিন্তু বাস্তবে ত্যাগী নেতা- কর্মীদের সাথে দূরত্ব এত বেশি হয়েছে যে, তা আদৌ ঘুচবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
যাহোক, বরাবরই এখানে অধিবাসীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত, সুযোগ্য ও সাংগঠনিক কর্মদক্ষতা সম্পন্ন প্রার্থীর অভাব ছিল। আর একারণেই সবচেয়ে বেশি সম্পদ থাকা সত্ত্বেও দেশের সবচেয়ে অনুন্নত এলাকা হিসেবে রয়ে গেল এটি। এই পরিস্থিতিতে এলাকার লোকজন, বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মী, তরুণ ছাত্রসমাজ ও শিক্ষিত জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে এখানকার সকলস্তরের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্বকে জবাবদিহি করতে। আর এখানে অত্যন্ত দায়িত্বশীল, তরুণ, প্রতিশ্রুতিশীল, আলোকিত ও অধিবাসী নেতৃত্বের খুব বেশী প্রয়োজন। তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ থেকে প্রতিশ্রুতিশীল ও ক্লিন ইমেজের উচ্চশিক্ষিত প্রার্থী ছাড়া এই আসন বিএনপির কব্জায় চলে যেতে পারে।
একটি পত্রিকায় সাম্প্রতিক তুলনামুলক রিপোর্টে ফুটে আসে যে এখানে শিক্ষার হার কম থাকায় ধর্মীয় চেতনা ও পুরষতান্ত্রিকতা ভোটের হিসেবে দু’টি শক্তিশালী নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ প্রায় এক পঞ্চমাংশ রিজার্ভ মাইনরিটি ভোটব্যাঙ্ক থাকার পরও প্রায়ত প্রভাবশালী জাতীয় পর্যায়ের নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এই আসনে পরাজয় বরণ করেন।
এই আসনে ১৯৭৩ সালে প্রয়াত আবদুল হেকিম চৌধুরী আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে বিএনপি থেকে অ্যাডভোকেট সৈয়দ রফিকুল হক সোহেল, ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫-দলীয় ঐক্যজোট থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রয়াত কমরেড বরুণ রায়, ১৯৮৮ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে বদরুদ্দোজা আহমেদ সুজা, ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ঐক্যজোট থেকে নৌকা প্রতীকে নজির হোসেন জয়লাভ করেন। পরে বিএনপিতে যোগদান করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে আবারও নজির হোসেন এমপি হন। এর কিছুদিন পর আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে অ্যাডভোকেট সৈয়দ রফিকুল হক সোহেল, ২০০১ সালে বিএনপি থেকে আবার নজির হোসেন ও ২০০৮ সালে ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে মোয়াজ্জেম হোসেন রতন আবার আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হন।
বর্তমানে সুনামগঞ্জ-১ আসনের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আছেন সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দ রফিকুল হক সোহেল, সুনামগঞ্জ জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের আহ্বায়ক এবং গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. রফিকুল ইসলাম তালুকদার, ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বর্তমান এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও জামালগঞ্জের সাচনা বাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম শামীম, কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামীমা শাহরিয়ার, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিগত নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সাবেক যুগ্ম সচিব বিনয় ভূষণ তালুকদার ভানু, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রনজিত সরকার, ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রফিকুল হক চৌধুরী এবং সাবেক জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আকতারুজামান সেলিম এবং সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন এস.পি. রায় ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক যুক্তরাষ্ট্র যুবলীগ নেতা শক্তি রায়।
সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে সাবেক সাংসদ অ্যাডভোকেট সৈয়দ রফিকুল হক এবং জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের আহ্বায়ক ড. রফিকুল ইসলাম তালুকদার জনসমক্ষে (সোসাল এবং/অথবা অনলাইন ও প্রেস মিডিয়ায়) তাদের পূর্ণাঙ্গ জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশ করেছেন। অধিকন্ত, বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রতীয়মান হয় যে সুনামগঞ্জ-১এ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে এই দু’জনই সবচেয়ে বেশি উচ্চশিক্ষিত, সুযোগ্য ও ক্লিন ইমেজের সাংগঠনিক কর্মদক্ষতা সম্পন্ন অধিবাসী প্রার্থী। তবে ধারণা করা হয় বর্তমান সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতনও একজন শিক্তিশালী প্রার্থীতা প্রত্যাশী।
তিনজনেরই কেন্দ্রেও শক্তিশালী অবস্থান আছে। এখন শিক্তিশালী তিনজন প্রার্থীর মধ্যে অধিক বয়সের কারণে সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দ রফিকুল হক সোহেল বাদ পরতে পারেন। সেক্ষেত্রে কৌশলগত রাজনীতিতে এই প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব কাকে সমর্থন করবেন এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এটিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বর্তমান সাংসদ যদি বুঝতে পারেন যে তিনি কোন কারণে নমিনেশন পাবেননা, তবে নিরাপদ এক্সিট স্ট্রাটেজি হিসেবে তিনি কাকে সমর্থন করবেন।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার এই আসন সম্পর্কে কৌশলগত দৃষ্টভঙ্গী। তবে ধারণা করা হয়, যেহেতু জননেত্রী দৃঢ়ভাবে এই হাওড় জনপদের স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন চান, সেহেতু ক্লিন ইমেজের সাংগঠনিক কর্মদক্ষতা সম্পন্ন উচ্চশিক্ষিত অধিবাসী তরুণ প্রার্থী ড. রফিকুল ইসলাম তালুকদার এগিয়ে যেতে পারেন। তাছাড়া সাবেক সাংসদ প্রবীণ রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট সৈয়দ রফিকুল হক সোহেলও তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। এমনকি বর্তমান সাংসদও কোন কারণে মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে গেলে তার ভবিষ্যৎ সম্মান ও কৌশলগত কারণ বিবেচনায় ক্লিন ইমজের প্রার্থীকেই সমর্থন করবেন বলে মনে করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৬:০৩:৫১ ৩০১৩ বার পঠিত