বঙ্গ-নিউজঃ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেন প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের সময় বলা হয়েছিল, দুই দশক আগে সড়কপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে সময় লাগত ৪-৫ ঘণ্টা। তখন এ মহাসড়কে দৈনিক ১০ হাজার যানবাহন চলাচল করত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দৈনিক গড়ে ৫০ হাজার যানবাহন চলছে। এত অধিকসংখ্যক যানবাহন চলায় দুই লেনের এ মহাসড়কটিতে যানজট বাড়ছে। এছাড়া মহাসড়কের পাশে বাজারের কারণেও যানজট হচ্ছে। এতে ৫ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে ৮-১০ ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। কখনো আবার লাগছে আরো বেশি সময়।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়ছেই। সে সময় সওজের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটের কারণে আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনে বিলম্ব হচ্ছে। শিপমেন্ট ঠিক রাখতে বাধ্য হয়ে অনেক সময় আকাশপথে পণ্য পাঠাতে হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। আর যাতায়াতে সময় অপচয়ের কারণে যাত্রীদের ক্ষতি ১ হাজার কোটি টাকা। দুর্ঘটনা ও ভাঙাচোরা সড়কের কারণে যানবাহনের ক্ষতি ৫৭০ কোটি টাকা। এছাড়া যানজটে জ্বালানী অপচয় হয় ২ হাজার কোটি টাকার, পরিবেশগত ক্ষতি ১ হাজার কোটি, স্বাস্থ্যগত ক্ষতি ৩০০ কোটি ও অন্যান্য ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মোট ক্ষতি ৯ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। ২০০৫ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ১৬৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। পরে তা চার দফা বাড়ানো হয়। এতে চার লেনের এই মহাসড়ক নির্মাণ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮১৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এতো টাকা খরচের পর চার লেনের এই মহাসড়কে যানজট এখন নিত্যদিনের ঘটনা। মেঘনা ও গোমতী সেতুর টোলপ্লাজায় প্রতিদিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে। তাতে ক্ষতির পরিমান যদি সড়ক ও জনপথ বিভাগের হিসাবেই ধরা হয় তবে তা ১০ হাজার কোটি টাকার কম নয়। এই ক্ষতির বিরুপ প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে। সাধারণ মানুষ এর খেসারত দিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি চার লেন করে কোনোই লাভ হয়নি। মহাসড়কের উপর মেঘনা ও গোমতী সেতুর কারনে এখনও ৭/৮ ঘণ্টা সময় লাগছে। এতে অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে আগের মতোই। তিনি বলেন, মহাসড়কটি চার লেন করার সময়ই এই দুই সেতুর কথা ভাবা উচিত ছিল। ইচ্ছা করলে একই সাথে দুই সেতুও তৈরী করা যেতো। এজন্য টাকা কোনো সমস্যা ছিল বলে আমার মনে হয় না। টাকা যাই লাগুক টোলের মাধ্যমে তা তুলে নেয়া যেতো। বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সড়ক ও জনপথ অথবা সেতু বিভাগের উপর এ ধরনের প্রকল্প ছেড়ে দিলে দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা হতেই থাকবে। সেতুগুলো এবং টোলপ্লাজাকে যদি পাবলিক লিমিটেড করে বাজারে শেয়ার ছাড়া হতো তাহলে টাকার অভাব হতো না। তাতে টোলপ্লাজায় অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনাও থাকতো না। আবু আহমেদ বলেন, আসলে আমরা মুর্খ। এখন সেই মুর্খতার মূল্য দিতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুধুমাত্র অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে-এই কারন দেখিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এই চার লেনের কাজ ২০১২ সালের জুনে সম্পন্ন করার কথা ছিল। পরে তা বাড়িয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর ও সর্বশেষ ২০১৪ সালের ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। তবে ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হয় প্রায় ৫৭ শতাংশ। ওই বছরের ডিসেম্বর নাগাদ সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে প্রকল্পটির মেয়াদ আবারও বাড়ানো হয়। আর বাস্তবায়নে বিলম্বের কারনে এর নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে যায়। ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ সর্বশেষ সংশোধন করা হয় প্রকল্পটি। সে সময় ব্যয় বাড়ানো হয় ৭৮০ কোটি ১২ লাখ টাকা। এতে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৯০ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এর আগে ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রকল্পটি সংশোধন করে ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৪১০ কোটি ১৭ লাখ টাকা, ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ২ হাজার ৩৮২ কোটি ১৭ লাখ ও ২০০৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুমোদনের সময় ২ হাজার ১৬৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। আর এ দফায় ব্যয় বাড়ানো হলে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ব্যয় দাঁড়ায় তিন হাজার ৮১৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। দফায় দফায় ব্যয় বাড়ানোর পরও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারছে না। মহাসড়কের মেঘনা, গোমতী ও কাঁচপুর সেতুর যানজট ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করে দিচ্ছে। এর মধ্যে মেঘনা ও গোমতী সেতুর টোলপ্লাজাই প্রতিদিনের যানজটের প্রধান কারন। তার উপর চার লেন মহাসড়ক ধরে এসে গাড়িগুলো যখন দুই লেনের সেতুতে উঠছে তখনও সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ সারির। ধীর গতিতে চলতে গিয়ে তখনও যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। ভুক্তভোগিদের মতে, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসতে এখনও আগের মতোই ৭/৮ ঘণ্টা সময় লাগছে। এর মধ্যে সাড়ে মূল মহাসড়কে ৩ থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগলেও টোলপ্লাজায় এসে আরও তিন ঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে। এরপর কাঁচপুর সেতুর যানজট পেরিয়ে হানিফ ফ্লাইওভারের যানজট হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে আরও এক দেড় ঘণ্টা সময় লাগছে। তাতে চার লেনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মালবাহী গাড়ি, যাত্রীবাহী গাড়িসহ সব ধরণের যানবাহন। অভিযোগ রয়েছে টোলপ্লাজার অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, পুলিশের গাফিলতি, চালকদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং মহাসড়কের জায়গা বেদখের কারন দিন দিন মহাসড়কের উপর যানজট ভয়াবহ আকার ধারন করছে। তাতে মানুষের ভোগান্তির সাথে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) এর সভাপতি সালাম মুর্শেদী বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটে অর্থনীতির ক্ষতি তো হচ্ছেই। যানজট মানেই সময় নষ্ট, আর সময় মানেই হলো টাকা। তিনি বলেন, চার লেন কেনো- যতো রাস্তাই বাড়ানো হোক না কেন এ যানজট কমানো যাবে না। কারন আমদানি-রপ্তানি দিন দিন বাড়ছেই। বাড়ছে মালামাল পরিবহণ। বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি বলেন, অর্থনীতির ক্ষতি কমানোর জন্য আইসিডি কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দাবি, গাজীপুরে একটা আইসিডি কন্টেইনার টার্মিনাল করা হোক। তাতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কন্টেইনারে করে মালামাল রেলপথে সরাসরি গাজীপুরে আনা সম্ভব হবে। এতে মহাসড়কে কাভার্ডভ্যান বা ট্রাক চলাচলও কমে যাবে। সেক্ষেত্রে মহাসড়কে যানজটও কমবে। বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিপিজিএমইএ) এর পরিচালক শামীম আহম্মেদ বলেন, মহাসড়কে যানজটে আমরা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি এটাই তো সবারই জানা কথা। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের ক্ষতি মানে দেশের ক্ষতি। বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ রুস্তম আলী খান বলেন, মেঘনা-গোমতী সেতুর টোলপ্লাজাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটের প্রধান কারন। এ যানজটে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব পড়ছে। তিনি বলেন, যানজটের কারনে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের জ্বালানী বেশি পুড়ছে। চালক ও হেলপারদের পারিশ্রমিক ও খাওয়া খরচ বেড়েছে। এতে করে মালিকরা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ভাড়া বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছে। রুস্তম আলী খান বলেন, ৬ মাস আগেও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আপডাউনে একটা কাভার্ডভ্যানের ভাড়া ছিল ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে কমপক্ষে ৩০ হাজা টাকা। একইপথে ট্রাক ভাড়া আগের চেয়ে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা বেড়েছে। এতে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। সায়েদাবাস বাস টার্মিনাল পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, মহাসড়কে যানজটের সবচেয়ে বড় মাশুল দিচ্ছি আমরা বাসের মালিকরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকলে একটা বাসের যে জ্বালানী খরচ হয় তা দিয়ে অনায়াসে দুটো ট্রিপ চালানো যায়। তার মানে আমাদের তিন ট্রিপের টাকা যাচ্ছে এক ট্রিপে। এতে করে আর্থিকভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। যানজটের কারনে খরচ বাড়লেও যাত্রীদের ভাড়া তো আর বাড়ানো যাচ্ছে না। এ কারনে দিন দিন পরিবহন ব্যবসায় লোকসানের পরিমান বাড়ছে। অনেকেই পুষিতে উঠতে না পেযে পরিবহন ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশ সময়: ৯:২৯:০৩ ৭৬৩ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bd news #online news #World News