বঙ্গ-নিউজ: বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা যে অ্যাপস ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে থাকে, সেই অ্যাপসে অ্যাকাউন্ট আছে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী যুবক ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুল হাসানের। সর্বোচ্চ সুরক্ষায় নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে মূলত ‘টেলিগ্রাম’ নামে ওই অ্যাপস ব্যবহার করে জঙ্গিরা। কঠিন পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে সেখানে ফয়জুরের যুক্ত থাকার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখছেন পুলিশ-র্যাবের তদন্তসংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ ছাড়া বেনামে একাধিক ফেসবুক অ্যাকাউন্টে উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের চর্চা করে আসছিল সে। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিভিন্ন পোস্টের লিংকও পেয়েছেন গোয়েন্দারা। বেনামে একাধিক ফেসবুক অ্যাকাউন্টে জঙ্গি-সংক্রান্ত শত শত পোস্ট পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ছাড়া দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-এবিটি) কিছু লেখা তার ফেসবুকে পাওয়া গেছে। অনলাইনে তার বিচরণ দেখে গোয়েন্দারা নিশ্চিত, ফয়জুর একজন ‘সেলফ রেডিক্যালাইজড উগ্রপন্থি’। এখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে, সে আনসার আল ইসলামের মতাদর্শে বিশ্বাসী। সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এসব তথ্য জানান।
জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড নিয়ে সাত বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন এমন এক কর্মকর্তা জানান, ফয়জুরের হামলার ধরন ও আলামত দেখে এটা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়- সে একজন রিমোট কন্ট্রোল জিহাদি। এর অর্থ হচ্ছে, অনলাইনে হয়তো কেউ তাকে এ হামলার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছে।
এমনও হতে পারে, পেছন থেকে কোনো গ্রুপ তাকে হামলার জন্য তৈরি করে তুলেছে, যাদের অনেকের সঙ্গে হয়তো অনলাইনে তার যোগাযোগ ছিল। ২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট পান্থপথের ‘ওলিও ইন্টারন্যাশনালে’র হামলায় জড়িত যুবকও তার মতো একই ধরনের রিমোট কন্ট্রোল জিহাদি ছিল। এ ধরনের জঙ্গিদের ক্ষেত্রে হামলার আগে তাদের কাছে সব ধরনের সরঞ্জাম চলে যায়। তবে হামলায় ব্যবহূত ছুরিটি কোথা থেকে পাওয়া গেছে, সে ব্যাপারে নিরুত্তর ছিল ফয়জুর।
সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, যারা সাধারণত ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহার না করে ছুরি-চাপাতির মতো অস্ত্র ব্যবহার করে জঙ্গি হামলায় অংশ নেয়, তাদের বলা হয় ‘কোল্ড আর্মস ব্যবহারী জিহাদি’। এদের আরেক নাম ‘ফুট সোলজার’। এটার অর্থ, এ ধরনের জঙ্গিরা সাধারণত টার্গেট করা ব্যক্তির কাছে হেঁটে যাবে। ধরা পড়ার আশঙ্কা থাকায় এরা অস্ত্র বহন এবং কেনা থেকে বিরত থাকে। এরা পরিবারের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন না থেকেই চরম উগ্রপন্থি হয়ে ওঠে। একসময় নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করেই হামলার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়। ফয়জুর ঠিক সে ধরনের উগ্রপন্থি বলে মনে করা হচ্ছে।
দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, এর আগে বিভিন্ন সময় জঙ্গি হামলার পরপরই যে কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে ‘দায়’ স্বীকার করে বিবৃতি দেওয়া হতো। তবে জাফর ইকবালের ওপর হামলার পর কোনো সংগঠন এখন পর্যন্ত বিবৃতি দেয়নি। যারা জঙ্গি হামলার পরপরই দায় স্বীকারের বিষয়টি নিয়ে কাজ করত, তাদের অনেকে এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে পড়েছে। তাই দায় স্বীকার প্রক্রিয়াটি আপাতত বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে জঙ্গিরা। এমনও হতে পারে, দায় স্বীকারের কৌশল থেকে সরে এসেছে জঙ্গিরা।
পুলিশের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, অভিজিৎ রায় হত্যা, হলি আর্টিসান হামলাসহ বিভিন্ন জঙ্গি অপারেশনের আগে উগ্রপন্থিরা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের টেলিগ্রাম অ্যাপসে যোগাযোগ করত। ফয়জুরও টেলিগ্রাম অ্যাপসে অ্যাকাউন্ট খুলেছে। সাধারণত মগজ ধোলাই করে কাউকে জঙ্গি দলে ভেড়ানোর পরপরই টেলিগ্রাম অ্যাপস ব্যবহারের কৌশল শেখায় তাদের উগ্রপন্থি ‘বড় ভাই’রা। এখন গোয়েন্দারা বের করার চেষ্টা করছেন, সে কার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল। তার ‘বড় ভাই’ কারা তা বের করা।
যদিও জিজ্ঞাসাবাদে সে দাবি করেছে, জাফর ইকবালের সঙ্গে হামলার ঘটনায় সে একাই জড়িত ছিল। তবে মনে করা হচ্ছে, ফয়জুর জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য লুকানোর চেষ্টা করছে।
উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলছেন, তারা বেশ কিছু বিষয় বিচার-বিশ্নেষণ করে দেখছেন। এখন পর্যন্ত ফয়জুর একাই হামলা করেছে বলে দাবি করলেও তার সঙ্গে ঘটনার দিন কেউ ক্যাম্পাসে ‘ব্যাকআপ’ পার্টি হিসেবে গিয়েছে কি-না। দুই, ঘটনার দিন সকালে এক দফায় লাল শার্ট পরে সাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসে গিয়ে ঘুরে এসেছে ফয়জুর।
ধারণা করা হচ্ছে, রেকি করতেই সে ক্যাম্পাসে গিয়েছিল। এর আগে ২০১৩ সালে মিরপুরে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার আগে হামলাকারী এবিটির জঙ্গিরা সাইকেল নিয়ে তাকে অনুসরণ করছিল। ফয়জুরের ক্ষেত্রেও সাইকেল নিয়ে আগেই ঘটনাস্থলে যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে। এ ছাড়া জাফর ইকবালের ওপর হামলার আগে কালো টি-শার্ট পরে ঘটনাস্থলে যায় ফয়জুর। কেন সে কালো টি-শার্ট পরল, এখন পর্যন্ত তার দুটি ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। এক, এর আগের বিভিন্ন সময় জঙ্গিরা অপারেশনে যাওয়ার আগে কালো ড্রেস পরে ছবি তুলে রেখেছিল। অনেকে কালো ড্রেস পরে অপারেশনে অংশও নিয়েছিল। তাদের অনুসরণ করতে পারে ফয়জুর।
দুই, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আয়োজনে ‘ইইই ফেস্টিভ্যালে’ অংশগ্রহণকারীদের কালো টি-শার্ট দেওয়া হয়েছিল। অছাত্র হওয়ায় নিজেদের পরিচয় লুকাতে কালো টি-শার্ট পরতে পারে সে।
অভিজিৎসহ এর আগে এবিটির বিভিন্ন অপারেশনে দেখা গেছে, জঙ্গিদের স্লিপার সেলের সদস্যরা আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেয়। কেউ হামলার পর ধরা পড়লে তাকে ছাড়িয়ে নিতে বোমা হামলাও করেছিল জঙ্গিরা। তবে ফয়জুরের ঘটনায় এ ধরনের কোনো আলামত দেখা যায়নি। এটা দেখা না গেলেও হামলাটি এবিটির নয়, তা পুরোপুরি উড়িয়ে দিচ্ছেন না গোয়েন্দারা। কারণ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) এবং আশপাশের এলাকায় রয়েছে এবিটির শক্ত অবস্থান। গত এক বছরে এবিটির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে শাবিপ্রবির ১২ ছাত্রকে গ্রেফতার করে পুলিশ, যাদের মধ্যে অনেকে এখন জামিনে রয়েছে।
এরই মধ্যে পুলিশ-র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে ফয়জুর দাবি করেছে, বিভিন্ন সময় ক্যাম্পাসের মাঠে ফুটবল খেলত সে। তবে কাদের সঙ্গে ফুটবল খেলত সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো তথ্য দেয়নি। ফয়জুরের ভাষায়- ‘জাফর ইকবাল নাস্তিক ও ইসলামের শত্রু।’ তবে সে কখনও জাফর ইকবালের বই পড়েনি। পত্রিকায়-টেলিভিশনে তাকে দেখেছে আর অন্যদের কাছে তার ব্যাপারে শুনেছে। তবে জাফর ইকবালের ‘ভূতের বাচ্চা সোলায়মান’ বইয়ের কথা শুনেছে। জাফর ইকবাল ইসলামকে কটাক্ষ করেছেন- এ রকম কোনো লেখা তার জানা না থাকলেও কীভাবে তাকে ‘ইসলামের শত্রু’ মনে করা হচ্ছে, এর কোনো স্পষ্ট জবাব নেই ফয়জুরের কাছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফয়জুর যে পরিবেশে বড় হয়েছে সেখানে যে কারও উগ্রবাদে জড়ানোর ঝুঁকি থাকে। ফয়জুরের বাবা স্থানীয় একটি মাদ্রাসার সদ্য সাবেক শিক্ষক। ফয়জুর নিজে লা-মাজহাবি (মাজহাববিরোধী বলে পরিচিত)। প্রবাসী দুই চাচাকে অনুসরণ করে সে সালাফি মতাদর্শে বিশ্বাসী। এই মতাদর্শের কারণে ফয়জুর ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে স্থানীয়দের একাধিকবার বিরোধও হয়েছিল।
তবে ফয়জুরের মা-বাবা অবশ্য পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, ছেলের আচরণের কারণে তারা ক্ষুব্ধ ছিলেন। ছেলের সঙ্গে তাদের মতাদর্শগত বিরোধ ছিল।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (গোপনীয়) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ফয়জুর রেডিক্যালাইজড। তবে তার পেছনে কেউ রয়েছে কি-না, তা বের করার চেষ্টা চলছে। এবিটির হামলার যে চরিত্র, তার সঙ্গে ফয়জুরের ঘটনার কিছু মিল আছে। আবার কিছু অমিলও রয়েছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের ডিসি মুহিবুল ইসলাম খান বলেন, নামে-বেনামে ফয়জুরের বেশ কিছু ফেসবুক অ্যাকাউন্টে জঙ্গিবাদী কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। তার ব্যাপারে আরও বিশদ অনুসন্ধান চলছে। ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করা হচ্ছে।
গোয়েন্দারা বলছেন, এর আগে মালয়েশিয়ায় বসেও জঙ্গিরা জাফর ইকবালকে হত্যার ছক কষেছিল। এ পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল এবিটির দুই জঙ্গি রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও মোস্তাক। এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ায় তারা মোবাইল ফোনে বিশেষ অ্যাপসের মাধ্যমে খুদেবার্তা আদান-প্রদান করে। মালয়েশিয়ায় আটকের পর রানা ও মোস্তাককে ২০১৭ সালে ঢাকায় ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এরপর তাদের মোবাইল ফোনসেট পরীক্ষা করে জাফর ইকবালকে হত্যার পরিকল্পনা-সংক্রান্ত এ খুদেবার্তা পাওয়া যায়।
গত শনিবারের হামলার সঙ্গে রানা বা তার অন্য কোনো সহযোগী নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে কি-না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দেশে ব্লগার হত্যার সূচনাকারী এবিটির অন্যতম সংগঠক রানা। আহমেদ রাজীব হায়দার ছাড়াও একাধিক ব্লগার হত্যা ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় রানার সংশ্নিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে।
ওই সময় জিজ্ঞাসাবাদে রানা জানিয়েছিল, মোস্তাকের বাড়ি সিলেটে। দীর্ঘদিন সে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করেছে। জাফর ইকবালকে হত্যার পরিকল্পনা করার কারণ হিসেবে রানা জানিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে তার দেওয়া বক্তব্যে জঙ্গি সংগঠনগুলো ক্ষুব্ধ ছিল। এ কারণেই তাকে টার্গেট করা হয়। যেহেতু জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর সিলেটের বাসিন্দা তাই রানা ও মোস্তাকের সঙ্গে এর যোগসূত্র খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর আগেও বিভিন্ন সময় ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
২০১৬ সালের অক্টোবরে এবিটির নাম ব্যবহার করে খুদে বার্তা পাঠিয়ে জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমীন হককে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ ১০ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দিয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলাটিম-১৩ নামের একটি সংগঠন। বিভিন্ন সময় ড. জাফর ইকবালকে পাঠানো হয় কাফনের কাপড়ও। সমকাল
বাংলাদেশ সময়: ১০:৪২:১৬ ৫৮৮ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #জাতীয় #শিরোনাম