বঙ্গ-নিউজঃ ‘যখন পাঞ্জাবি আর পাজামা চাপিয়ে শরীরে, সকালে কিংবা বিকেলে একলা হেঁটে যান- প্রায় প্রতিদিন দীর্ঘকায় সবুজ গাছের তলা দিয়ে তাঁকে বাস্তবিক সাধারণ মনে হয়। …এখনও সিদ্ধির পরে, খ্যাতির শিখরে পদার্পণ করেও সাধনা তাঁর থামেনি, বরং মাঝে মাঝে এখনও গভীর রাতে ঘুমন্ত জীবনসঙ্গিনীর পাশে শুয়ে অথবা টেবিলে ঝুঁকে থিসিসের ভাবনায় কাটান প্রহর।’ কবিতায় প্রিয় বন্ধু আনিসুজ্জামানকে এভাবেই ব্যক্ত করেছিলেন কবি শামসুর রাহমান। আজ রোববার সেই সাধক, মনীষী, বাংলার অসাম্প্রদায়িক মুক্তচিন্তার অন্যতম অগ্রদূত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ৮২তম জন্মদিন। আজও তিনি নিজ কর্মে নিষ্ঠাবান, একান্ত ব্রতী; আজও তার সাধনা থামেনি। শুভ জন্মদিন, প্রিয় শিক্ষক। প্রিয় অভিভাবক।
আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী পাঁচ দশকে এ দেশের মানুষের প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অকুতোভয় ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম অধ্যাপক; একাধারে অতুলনীয় গবেষক, চিন্তক ও অসামান্য লেখক। তিনি শিক্ষাবিদ, কিন্তু তার শিক্ষার অহঙ্কার নেই। তিনি বিনয়ী, নিরহঙ্কারী। তার জীবনযাপন সাদাসিধে। অপরিসীম মানসিক ধৈর্যশক্তি এবং বয়স ও শ্রেণি-পেশার পার্থক্য ভুলে সবার সঙ্গে তার মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। তিনি লিখে চলেছেন অবিরাম। তিনি মুক্তবুদ্ধি, সুরুচি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নিঃশঙ্কচিত্ত। কয়েক প্রজন্মের শিক্ষক হিসেবে জাতির অন্যতম অভিভাবকও তিনি।
১৯৩৭ সালের এই দিনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা এটিএম মোয়াজ্জেম ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। মা ছিলেন গৃহিণী। দু’জনই ছিলেন সাহিত্যমনস্ক। পরিবারের অন্য সদস্যরাও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৫২ সালে মাত্র পনেরো বছর বয়সে ‘রাষ্ট্রভাষা কী ও কেন?’ শিরোনামের একটি পুস্তিকা রচনা করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ওপর এটিই ছিল প্রথম পুস্তিকা। ১৯৬১ সালের রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এ ছাড়া ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামেও তিনি কার্যকর ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ভারতে চলে যান। সেখানে তিনি প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বক্তৃতা লেখার কাজে যুক্ত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, তেমনি বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে কাজ করে গেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকারের গৌরব নিয়ে। ১৯৫৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এর মাঝে এবং ১৯৬৫ সালে ‘উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস :ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল’ বিষয়ে আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর শিক্ষকতার পর ২০০৩ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
বর্তমানে তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। জন্মদিন উপলক্ষে এই প্রাজ্ঞজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে একইরকম কর্মব্যস্তই পাওয়া গেল। ৮১ বছরের জীবন পেরিয়েও তিনি যেন এখনও একইরকম প্রাণচঞ্চল। জন্মদিন উপলক্ষে সমকাল পাঠক এবং দেশের মানুষের প্রতি জানিয়েছেন প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
বর্ণিল কর্মজীবনে শিক্ষকতার পাশাপাশি বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও গবেষণার কাজে সর্বদা ব্রতী এই প্রাজ্ঞজন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে তার রচিত ও সম্পাদিত বাংলা ও ইংরেজি গ্রন্থগুলো উজ্জ্বল আলোকরেখা হয়ে বর্তমান প্রজন্মকে পথ দেখাচ্ছে। তার প্রবন্ধ-গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’, ‘মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র’, ‘মুনীর চৌধুরী’, ‘স্বরূপের সন্ধানে’,Social Aspects of Endogenous Intellectual Creativity ‘আঠারো শতকের বাংলা চিঠি’, ‘মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’, ‘পুরনো বাংলা গদ্য’, ‘মোতাহার হোসেন চৌধুরী’, Creativity, Reality and Identity; Cultural Pluralism; Identity, Religion and Recent History অন্যতম।
মৌলিক সাহিত্য ও গবেষণার পাশাপাশি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একক ও যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন বহু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে অনেক বই।
শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংগঠনিক কাজে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। ১৯৫৬ সালে নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক, ১৯৫৮ সালে স্ট্যানলি ম্যারন রচনা পুরস্কার, ১৯৬৫ সালে দাউদ পুরস্কার, ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে অলক্ত পুরস্কার, ১৯৮৫ সালে একুশে পদক, ১৯৮৬ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার ও বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার, ১৯৯০ সালে বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট, ১৯৯৩ সালে দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক, ১৯৯৪ সালে অশোককুমার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার, ২০১১ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বর্ণপদক, ২০১২ সালে ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ও ২০১৪ সালে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পদকসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন কালজয়ী এই বিজ্ঞজন। এ ছাড়াও ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি. লিট ডিগ্রি প্রদান করে।
দীর্ঘ কর্মময় জীবনে হাজারো ঘটনা এবং বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সংস্পর্শে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ধীরে ধীরে নিজেকে পরিণত করেছেন এক মহামহীরুহ হিসেবে। সদ্যপ্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার বন্ধু আনিসুজ্জামান’ শীর্ষক কবিতার শেষাংশ পাঠে সকলের ‘প্রিয় স্যার’ অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জীবন ও কাজের একটি রেখাচিত্র পাওয়া যায়। ‘মানুষ জন্ম নেয় এবং মানুষ বড় হয়-/বয়সে বড় হয় সকলে, কর্মে কতিপয়।/ এক জীবনের অর্জন কি এক কথাতে বলা যায়?/ প্রতিদিনের চিত্রলেখা দিনের শেষে মুছে যায়।/ সবটাই কি মুছতে পারে কালের হাত চলমান?/ অমোচ্য যে নামগুলো তার একটি আনিসুজ্জামান’।
সুত্রঃ সমকাল
বাংলাদেশ সময়: ৯:২৯:২৫ ৯২১ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #breaking news #World News