আনোয়ার ইউনুস বঙ্গ-নিউজঃ পয়লা ফাল্গুন বা পহেলা ফাল্গুন বাংলা পঞ্জিকার একাদশতম মাস ফাল্গুনের প্রথম দিন ও বসন্তের প্রথম দিন। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৩ই ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন পালিত হয়। বসন্তকে বরণ করে নেয়ার জন্য বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশায় সহ অন্যান্য রাজ্যে দিনটি বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। বাংলাদেশে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ এই দিনকে বরণ করতে চারুকলার বকুলতলায় এবং ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতিবছর জাতীয় বসন্ত উৎসব আয়োজন করে। বাতাসে শীতের তীব্রতা নেই। নেই কুয়াশার ধূসর আচ্ছাদন। স্নিগ্ধ কোমল পরশ জানান দিচ্ছে আজ বসন্ত। গাছে গাছে সবুজ কিশলয়। ডালে ডালে মঞ্জরিত নতুন ফুলদল। শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার বর্ণিল আভা রাঙিয়ে দিচ্ছে বিরহ ক্লান্ত মন। দূরের দিগন্ত থেকে ভেসে আসছে কোকিলের কুহুকুহু কলতান। মৌ-মৌ গন্ধ ছড়িয়ে ডালে ডালে অঙ্কুরিত আম্র্রমুকুল। রঙিন ডানায় ফুলের পরাগ মেখে হাওয়ায় হাওয়ায় দোল দিচ্ছে বর্ণিল প্রজাপতি। প্রতিটি ঋতুর শেষে প্রকৃতি তার পুরনো অবয়ব থেকে এভাবেই বাঁক নেয় নতুন আবাহনে। ষড়ঋতুর লীলা চাতুর্য ভরা এটিই বাংলার চিরন্তন রূপ। এই রূপ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষও বদলে যায়। বদলে যায় তাদের জীবন। ফিরে পায় নতুন চঞ্চলতা।
মাঘের শেষে ফাল্গুনের প্রথম প্রহরে বাঙালি মেতে উঠে ‘বসন্ত’ উৎসবে। তাতে প্রাণে প্রাণ যোগ করে প্রকৃতি ও মানুষ। সহজাতভাবে পরিস্ফুটিত হয় ফুল, পাখি ও নারী। সুরে ও ছন্দে আনন্দের রিনিক-ঝিনিক মাদল বাজায় বসন্ত। বসন্তের রঙ হলুদ। তার সঙ্গে লাল ও কমলার নিবিড় বন্ধন। মাঘের শীত ঘুম পাড়িয়ে রাখলেও ফাল্গুনের প্রথম দিনের ভোরে ঘরের বাইরে পা দিলেই বাসন্তী হাওয়া এসে জানিয়ে দিয়ে যায় মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে…। চারপাশে বাসন্তী রঙের ছড়াছড়ি। মেয়েদের পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি। কপালে লাল টিপ। ম্যাচিং করে হাত ভর্তি কাচের চুড়ি, গলায় পুঁতির মালা। চোখে, ঠোঁটে, মুখে এমনকি হাতের ব্যাগেও রঙের প্রলেপ। হারিয়ে যেতে বসা খোঁপায় বা বিনুনিতে গাঁদা ফুলের মালা। তবে একদম বাসন্তী সাজে সাজা সম্ভব না হলেও হলুদের কাছাকাছি বসন কিংবা শরীরের কোথাও না কোথাও এক টুকরো হলুদ নিশানা থাকেই। সে শাড়ি হোক কিংবা সালোয়ার-কামিজ। হালে ফ্যাশন সচেতন বাঙালির বসন্তের পোশাক-আশাকে লেগেছে নানা নকশা ও আলপনার বাহার। কারো কারো হাতে থাকে ফুল। সে সঙ্গে অবয়বজুড়ে লেগে থাকে বাঁধনহারা হাসি। বসন্তের সৌরভ নিয়ে বর্ণিল সাজে মোহনীয় বাঙালি নারীর পাশাপাশি তরুণরাও নানা রঙের পাঞ্জাবি, ফতুয়া ও কাঁধে নানাবর্ণের চাদর ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ হাতে জড়িয়ে নেয় বেলি কিংবা গাঁদা ফুলের মালা। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বসন্তের রঙে সবাই নিজেকে রাঙিয়ে নেয়। প্রাণে প্রাণে দোলা দেয় নতুন আবেশ। হৃদয়ের ব্যাকুল তন্ত্রিতে তখন আপনিতে বেজে উঠে- আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়… । বসন্ত উৎসব বাঙালির প্রাণের উৎসব। বর্ষবরণ, নবান্ন উৎসব, পৌষমেলা-এসবের মতো বসন্ত উৎসবও বাঙালি চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহনশীলতা। দৃঢ়তর হয় মৈত্রীর বন্ধন। শুধু রাজধানীতে নয়, দেশজুড়ে বসন্তের আবাহনে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠান। প্রকৃতি আর মানুষের এই মিলনমেলা গোটা দেশকে মাতিয়ে তোলে আনন্দ হিল্লোলে। ইথারে ইথারে তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে বাংলার ঘরে ঘরে।
রাজধানীতে চারুকলার সামনে বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা বসন্ত উৎসবে আগত দর্শনার্থীদের কপোলে এঁকে দেয় বসন্তের আলপনা। যার মাধ্যমে তৈরি হয় অনন্য মেলবন্ধন। পাবলিক লাইব্রেরি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনাপার্ক, টিএসসি থেকে শুরু করে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা; ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর, চন্দ্রিমা উদ্যান, ক্রিসেন্ট লেক, বলদা গার্ডেনসহ গোটা সংসদ এলাকা মুখরিত হয়ে উঠে অফুরান প্রাণের বন্যায়। পথে পথে পশরা সাজিয়ে বসে বিক্রেতারা। ডুগডুগি, ঢোল বাঁশিসহ নানারকম খেলনা শোভা পায় কিশোর-কিশোরীদের হাতে। তরুণ-তরুণীদের হাতে লাল গোলাপ কিংবা রজনীগন্ধা। অপরূপ এ দৃশ্য শুধু এখানেই নয়, সারাদেশকে মাতিয়ে তুলে। বসন্ত বরণ উৎসবকে ঘিরে আয়োজিত হয় নানা অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি মোবাইল ও ব্যাংক-বীমা কোম্পানিগুলো ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। দল-মত নির্বিশেষে উদ্দীপ্ত তরুণ-তরুণীরা সারাদিনই মেতে থাকে প্রাণের উৎসবে।বাঙালির বসন্তে যোগ হয়েছে একুশ। এই ফাল্গুন মাসে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে বাঙালি। থোকা থোকা ফুল হয়ে ফুটে আছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিক। সেই বায়ান্ন থেকে প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে একুশে গ্রন্থমেলা। স্বাধীনতার পর প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজিত গ্রন্থমেলা বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে। গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে মানুষের যে ঢল নামে তাতেও পাওয়া যায় প্রাণের ছোঁয়া।
বসন্তে সংযোজন ঘটেছে ভ্যালেন্টাইনস ডে অর্থাৎ ভালোবাসা দিবস। বসন্তকালে হওয়ায় বাঙালি এই দিনটিকে লুফে নিয়েছে। মন কেমন করা ঝিরিঝিরি উদাসী হাওয়া, পাখপাখালির কুজন ও হাজারও রঙের খেলা নিয়ে প্রকৃতির যে আনন্দ বিহার; তাতে ভালোবাসা থাকবে না, তা কী করে হয়? ভ্যালেন্টাইনস ডে না থাকলেও আমাদের বসন্তই তো ভালোবাসা দিবস।বাঙালির বসন্ত উৎসব প্রথম শুরু হয় শান্তি নিকেতনে। স্বাধীনতার আগে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও এ অঞ্চলে বসন্ত উৎসব পালিত হতো। তবে বাঙালি সংস্কৃতি বিরোধী পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ও তাদের এদেশীয় দোসররা বসন্ত উৎসবকে কখনো সুনজরে দেখেননি। সবসময়ই নানা অপ্রচার চালিয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে কোণঠাসা করে রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। একাত্তরে স্বাধীনতার পর বর্ষবরণের মতো বসন্ত উৎসবও ব্যাপকভাবে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বসন্ত উৎসব প্রথম পালিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলাভবনের পাশের মাঠে এ উৎসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি পরে আসতো। পঞ্চাশের দশকে পহেলা ফাল্গুনে ইডেন কলেজের ছাত্রীরা ক্লাসে আসতো লালপাড়ের শাড়ি পরে। আজ সময় বদলেছে। পাল্টে গেছে প্রেক্ষাপট। যা একদিন ছিল অবগুণ্ঠনে। তা আজ উন্মোচিত, উচ্চকিত প্রাণের আবেগে। সেই আবেগে গুঞ্জরিত হতে থাকে ‘বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে/সই গো, বসন্ত বাতাসে’।
বাংলাদেশ সময়: ১২:৩৬:৪৪ ৩৫৮৪ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bangladesh news #bd news #daily newspaper #World News