বঙ্গ-নিউজঃ চার বছর ধরে যে গর্ব তিনি করে আসছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সেই সততা ও স্বচ্ছতার মূলে আঘাত হেনে বিরোধীরা জমিয়ে দিয়েছে ভারতের রাজনীতি। ফ্রান্সের যুদ্ধবিমান রাফায়েল আজ দখল করে নিয়েছে ভারতীয় রাজনীতির মূল আঙিনা।
কথায় বলে, ইতিহাস বারবার ঘুরে ঘুরে আসে। ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর সহানুভূতির জোয়ারে ভেসে প্রধানমন্ত্রী হওয়া রাজীব গান্ধীকে দুর্নীতির কালিতে মাখামাখি হয়ে সরে যেতে হয়েছিল। তিরিশ বছর আগে ‘বোফর্স কেলেঙ্কারির’ সেই ইতিহাস সবার জানা। তিরিশ বছর পর ফ্রান্সের রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তিকে বর্তমান শাসক দলের বিরুদ্ধে হাতিয়ার করে কংগ্রেস রাজনৈতিক শোধ তুলতে উঠেপড়ে লেগেছে। মোক্ষম ঘা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ‘ঘুষ খাব না, কাউকে খেতেও দেব না’ প্রতিজ্ঞায়।
দুর্নীতিগ্রস্ত না হওয়া এবং দুর্নীতিকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় না দেওয়ার যে অহংকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নরেন্দ্র মোদি করে আসছেন, রাহুল গান্ধী সেই অহংকারে ধাক্কা দিয়ে বলছেন, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।’ প্রধানমন্ত্রী কীভাবে এর মোকাবিলা করেন, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মুহূর্তের প্রবল রাজনৈতিক আগ্রহ।
বয়স হয়ে যাওয়া রুশ যুদ্ধবিমান মিগ সিরিজের বিকল্প অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান কেনার তাগিদ অনুভব করেছিল কংগ্রেস সরকার, ২০০০ সালে। পরের বছর ঠিক হয়, মোট ১২৬টি বিমান কেনা হবে। এগুলোর মধ্যে একেবারে তৈরি অবস্থায় কেনা হবে ১৮টি, বাকি ১০৮টি সরবরাহকারী দেশের প্রযুক্তি সহায়তার মাধ্যমে তৈরি করা হবে কর্ণাটকের হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেডের
(হ্যাল) কারখানায়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০৭ সালে টেন্ডার ডাকা হয়। রাশিয়া, ফ্রান্স, আমেরিকা ও সুইডেনের কোম্পানিরা আগ্রহ দেখায়। ২০১২ সালে ফ্রান্সের তৈরি রাফায়েল উঠে আসে পছন্দের প্রথম তালিকায়। শুরু হয় দরদাম নিয়ে আলোচনা। ২০১৪ সালে আলোচনা চূড়ান্ত হয়ে গেলেও চুক্তি সই না হয়ে ঝুলে থাকে। সেটা ছিল লোকসভার ভোটের বছর।
প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদি পরের বছর ২০১৫ সালে ফ্রান্স সফরে যান। সেখানে তিনি ঘোষণা করেন, দুই দেশের সরকারের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী ভারত ৩৬টি তৈরি রাফায়েল যুদ্ধবিমান কিনবে। ফ্রান্স ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ইউরো দর হাঁকায়। প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণার পর ওই বছর প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় ২০০৭ সালের বিশ্ব টেন্ডার, যাতে ১২৬টি যুদ্ধবিমান কেনার জন্য দরপত্র চাওয়া হয়েছিল। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ ভারত সফরে এসে বললেন, ৩৬ ফাইটার বিমানের জন্য তাঁদের ৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ইউরো দিলে চলবে। চার মাসের মধ্যে ভারত তার চূড়ান্ত দর জানাল। ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ইউরোয়, ভারতীয় মুদ্রায় যা ৫৮ হাজার কোটি রুপি, দুই দেশ রাজি হলো। ওই বছরের আগস্টে কেন্দ্রীয় সরকারের নিরাপত্তাবিষয়ক কমিটি চুক্তির অনুমোদন দেয়। সেপ্টেম্বরে চুক্তি সই হয়।
কংগ্রেস আমলে ২০০৭ সাল থেকে আলোচনা শুরু করে ২০১৪ সালে যে চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত হয়েছিল, তাতে মোট খরচ পড়ত ৭৯ হাজার ২০০ কোটি রুপি। যুদ্ধবিমান আসত ১২৬টি। সেই চুক্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যালও উপকৃত হতো। বিজেপি আমলের এই চুক্তিতে বিমান আসবে ৩৬টি, খরচ ৫৮ হাজার কোটি। হ্যালের কোনো ভূমিকাও এখানে থাকছে না। কংগ্রেস আমলের চুক্তিতে বিমানপ্রতি খরচ পড়ত ৬২৯ কোটি রুপি, বিজেপির চুক্তিতে খরচ পড়ছে ১ হাজার ৬১১ কোটি। কংগ্রেস হিসাব করে দেখিয়ে দিয়েছে, ৬২৯ কোটি রুপিতে ৩৬টি রাফায়েল কিনলে খরচ যেখানে ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি হতো, সেখানে বিজেপি সরকার ওই ৩৬টি বিমানের জন্য দিচ্ছে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি! অর্থাৎ আড়াই গুণেরও বেশি!
কংগ্রেস দুর্নীতির গন্ধই শুধু পায়নি, দুর্নীতির অভিযোগ সরাসরি এনেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর দাবি, এক একটি রাফায়েল বিমান কিনতে কত খরচ পড়ছে, সরকার তা জানাক। প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সংসদে সেই তথ্য জানাতে অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, চুক্তিতে গোপনীয়তার শর্ত আছে। তাই জানানো যাবে না। তাতে দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা। অথচ তাঁরই প্রতিমন্ত্রী সুভাষ ভামরে ২০১৬ সালে সংসদে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন, বিমানপ্রতি খরচ পড়ছে ছয় শ কোটির বেশি।
রাফায়েল চুক্তিকে রাহুল আঁকড়ে ধরেছেন ঠিক সেভাবে যেভাবে তিরিশ বছর আগে তাঁর বাবাকে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রমাণে বিজেপিসহ বিরোধীরা আঁকড়ে ধরেছিল বোফর্সকে। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি লোকসভায় রাহুলকে কটাক্ষ করে বলেছেন, ইউপিএ সরকার ১৫টি প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে সংসদকে কোনো তথ্য জানাতে অস্বীকার করেছিল। রাহুল তার জবাবে জেটলিকে বলেছেন, ‘মিস্টার জেটলি, আপনি ভুল বলছেন। যুদ্ধজাহাজ অ্যাডমিরাল গর্শকভ, ফাইটার বিমান সুখোই ৩০ ও মিরাজ-২০০০ কেনাবেচা-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য কংগ্রেসের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি সংসদকে জানিয়েছিলেন।’ রাহুলের কথায়, ‘আমরা বাড়তি কিছু জানতে চাই না। শুধু এটুকু জানানো হোক, কত টাকায় এক একটা বিমান কেনা হচ্ছে। এবং কোন যুক্তিতে।’
বোফর্স কেলেঙ্কারি মাথাচাড়া দিয়েছিল নির্বাচনের আগের বছরে। রাফায়েলও ভোটের আগের বছর নানা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে যেগুলোর কোনো সন্তোষজনক উত্তর মোদি-সরকার এখনো দিতে পারেনি। বোফর্স শেষ করে দিয়েছিল রাজীব গান্ধীকে। রাফায়েল কি পারবে নরেন্দ্র মোদির সততা, স্বচ্ছতা ও ঘুষ না খাওয়ার অহংকার খান খান করে ভেঙে দিতে?
বাংলাদেশ সময়: ১২:৫৬:০৪ ৮৫৮ বার পঠিত