বঙ্গ-নিউজঃ আগামীকাল বৃহস্পতিবার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজধানীসহ সারা দেশে ত্রিমুখী প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার ও আওয়ামী লীগ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের পাশাপাশি রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে সরকার।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের জড়ো হওয়া ঠেকাতে কাল বাস চলাচল বন্ধ রাখবেন সরকার-সমর্থক পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা। তাঁরা রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনালে ২০ হাজার মানুষের পাহারা বসানোর ঘোষণা দিয়েছেন। ঢাকার বাইরে থেকে অযাচিত মানুষের আগমন ঠেকাতে তাঁরা তল্লাশিও করবেন বলে মালিক-শ্রমিক সংগঠন সূত্র জানিয়েছে।
রায় ও এর পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি ও রাজনৈতিক উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, বড় জমায়েত মাঠে রেখে খালেদা রায় শুনতে চান—বিএনপির এমন পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে পাল্টা পরিকল্পনা নেয় সরকার। আর তা হচ্ছে বিএনপিকে কিছুতেই ঢাকায় জড়ো হতে দেবে না। এর জন্য যতটা কঠোরতা দরকার, এর সবই করা হবে।
রাজধানীর বাইরে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে প্রতি জেলায় একটি কোর কমিটি রয়েছে। তারা জেলা পর্যায়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া খালেদা জিয়ার সাজা হলেও দেশ স্বাভাবিক আছে—এটাও নিশ্চিত করতে চায় সরকার। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরিশাল সফরে যাবেন—এটা অনেক আগেই ঠিক করা হয়েছে। সবকিছু স্বাভাবিক দেখানোর জন্য এই সফরেও কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানেই তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন। খালেদার সাজা হলে তা কার্যকর করার জন্যও কারা প্রশাসনের প্রস্তুতি রয়েছে। কাশিমপুর কারাগারের নারী সেলে তাঁকে রাখা হতে পারে।
এর বাইরে সরকার-সমর্থক পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা গতকাল মতিঝিলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির কার্যালয়ে বৈঠক করে আজ বুধবার বিকেল থেকেই রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী ও ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালে ২০ হাজার মানুষের পাহারা বসানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
বৈঠক শেষে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানান, বৃহস্পতিবার লাঠি হাতে পাহারা চলবে। তবে রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডিএমপি লাঠি নিষিদ্ধ করেছে বলে তাঁরা লাঠি রাখার সিদ্ধান্ত বাদ দিয়েছেন।
একাধিক পরিবহনমালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বুধবার বিকেল থেকেই বাস চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে। রাতে সব বাস টার্মিনাল ও এর আশপাশের মাঠে রাখা হবে। এর অর্থ হচ্ছে বুধবার বিকেল থেকেই বাসের সংকট তৈরি হবে।
আগামীকাল বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত ৫-এ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য আছে। এই মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তাঁর ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জন আসামি।
জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা পুলিশের
সরকারের তিন স্তরের প্রস্তুতির মধ্যে প্রথমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার শুরু করে। এরপর রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোতে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে। গতকাল মঙ্গলবার সভা-সমাবেশ, এমনকি সংগঠিত হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামানের নামে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৮ ফেব্রুয়ারি বিচারাধীন একটি মামলার রায়কে কেন্দ্র করে ঢাকা মহানগরীতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অরাজকতা, নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে জননিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা বিঘ্নের অপপ্রয়াস চালাতে পারে বলে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সূত্রে জানা যায়। এ জন্য বৃহস্পতিবার ভোর চারটা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত মহানগর এলাকায় ছড়ি, লাঠি, ছুরি, চাকু বা ধারালো অস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য ও দাহ্য পদার্থ বহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ সময় যানবাহন, জনসাধারণের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা বসে মিছিল করা যাবে না।
জেলা পর্যায়ে কমিটি
জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে প্রতি জেলায় একটি কোর কমিটি রয়েছে। বেসামরিক প্রশাসনের প্রস্তুতি হিসেবে সারা দেশেই এই কমিটির বৈঠক হয়েছে। কয়েকটি জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব বৈঠকের যেসব সিদ্ধান্ত জানা গেছে এগুলো হচ্ছে খুচরা পেট্রল বিক্রি বন্ধ করা, মসজিদের মাইক আজান ছাড়া অন্য কাজে অর্থাৎ লোক জমায়েতে যাতে ব্যবহার না হয় সেটা নিশ্চিত করা, রেললাইনগুলোতে পাহারা বাড়ানো এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় (কেপিআই) নিরাপত্তা জোরদার করা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও (ওসি) সমন্বয় করে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছেন। এর বাইরে ভ্রাম্যমাণ আদালতও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রস্তুতি
সরকারি দল আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রস্তুতি হিসেবে প্রতিটি জেলা, মহানগর ও উপজেলা কমিটিকে নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস হতে পারে—এমন আশঙ্কা করে তা ঠেকাতে সতর্ক অবস্থান নেওয়ার জন্য কেন্দ্র থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দলীয় কার্যালয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পাহারা বসানোর লক্ষ্যে ঢাকায় মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি সভা করেছে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা গতকাল মঙ্গলবার দলের ধানমন্ডি কার্যালয়ে সহযোগী সংগঠনের নেতাদের নিয়ে যৌথ সভা করেন। সেখানে দলের নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সরকারের শরিক ১৪ দল গত সোমবার আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে বৈঠক করেছে। মাঠে নেমে পাল্টা কর্মসূচি পালন না করলেও সতর্ক থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গতকাল সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে যৌথ সভা শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি যদি উসকানি দেয় এবং প্রিজন ভ্যানে হামলার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করে তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে। প্রয়োজনে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পাশে থাকবেন।
একই সঙ্গে সরকারের শরিক, আবার সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দলটির সূত্র বলছে, খালেদার রায়কে ঘিরে তারা প্রকাশ্যে কোনো ভূমিকা রাখবে না। তবে এ বিষয়ে দলটির অবস্থান সরকারের পক্ষেই আছে। কারণ, খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে দুর্নীতির দায়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ কারাভোগ করেন। এরশাদের কাছে খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলা অনেকটা প্রতিশোধের মতোই।
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
এদিকে আগামীকাল রায়কে ঘিরে জনমনে নানা উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে চলমান এসএসসি পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা বেশি। এদিন ধর্ম পরীক্ষা রয়েছে। কর্মজীবীরা ওই দিন ঘর থেকে বের হবেন কি না, বের হলে যানবাহন পাবেন কি না, এ নিয়ে তাঁরা উদ্বেগে আছেন। সপ্তাহের শেষ দিন অনেকে কাজ শেষে করে ঢাকার বাইরে যান এবং ঢাকার বাইরে থেকেও আসেন।
অতীতেও বিভিন্ন সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের জমায়েত ঠেকাতে প্রশাসন, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও তাদের সহযোগী পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখেছিল। তল্লাশির নামে যাতায়াত আটকে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত সোমবার থেকেই ঢাকার সাতটি প্রবেশপথে তল্লাশিচৌকি বসিয়েছে। সরকার-সমর্থক পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরাও রাজধানীর টার্মিনালগুলোতে পাহারা বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাজধানীর ভেতরেও বিভিন্ন সড়কে, মেসে ও আবাসিক হোটেলে তল্লাশি চলছে।
গ্রেপ্তার অভিযান চলছে, চলবে
সরকারি সূত্র বলছে, টানা কয়েক দিনের গ্রেপ্তার অভিযান শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত রাখা হবে। বেশি নেতা-কর্মী নামাতে পারেন, বেছে বেছে এমন নেতাদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বড় জমায়েতের পরিকল্পনায় ধাক্কা দেওয়া গেছে বলে সরকারি সূত্রগুলো বলছে। রায়ের আগের দিন কর্মী পর্যায়েও প্রয়োজন হলে গ্রেপ্তার চলবে। রায় ঘোষণার দিন বিএনপির নেতা-কর্মীরা যাতে কোথাও সংগঠিত হয়ে দাঁড়াতে না পারেন, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেবে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:৪৫:৫০ ৫৫৮ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bangladesh news #bd news #daily newspaper #World News