বঙ্গ-নিউজঃ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার রায় নিয়ে দেশে আরেক দফা রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জনমনে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন দেশের বিশিষ্টজন।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার সংগঠকরা বলেন, দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সবাইকে সহনশীল হতে হবে। রায় যাই হোক, আইনের শাসন ও আদালতের প্রতি আস্থা দেখিয়ে আইনগতভাবেই বিষয়টি মোকাবেলা করতে হবে বিএনপিকে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও যেন এমন কোনো আচরণ না করে, যাতে বিরোধী দল সহিংসতার পথ বেছে নেওয়ার উস্কানি পায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেও প্রতিহিংসা এড়িয়ে চূড়ান্ত ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে।
খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে বহুল আলোচিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় দেওয়া হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশনের করা ওই মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হয় গত ২৫ জানুয়ারি। এরপর থেকেই এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। রায়ে খালেদা জিয়ার শাস্তি হলে বিএনপি ‘কঠোর আন্দোলনের’ হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। সেরকম পরিস্থিতিতে দেশে ‘আগুন জ্বলবে’ কিংবা ‘পরিণতি ভয়াবহ’ হবে- বিএনপির এমন হুমকির মুখে আওয়ামী লীগসহ সরকারি মহল থেকেও সতর্ক অবস্থান নেওয়ার কথাই বলা হচ্ছে। বিশৃঙ্খলা ও নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা হলে তা দমনে নেতাকর্মীরা প্রয়োজনে সহযোগিতার জন্য পুলিশের পাশে থাকবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
অবশ্য সম্ভাব্য নাশকতা ঠেকাতে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বসে নেই। ৮ ফেব্রুয়ারির রায় ঘোষণার দিনকে ঘিরে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থা। সারাদেশে সম্ভাব্য সহিংসতা দমনের বিভিন্ন নির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক বিজ্ঞপ্তিতে ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর ৪টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাজধানীতে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এমন কঠোর অবস্থানের পরও অবশ্য জনমনে সৃষ্ট উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কমছে না। ৮ ফেব্রুয়ারি দেশে কী ঘটে, সত্যি সত্যিই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় কি-না- সেটি দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন সবাই। এই অবস্থায় করণীয় কী, তা জানতে দেশের কয়েকজন বিশিষ্টজনের মুখোমুখি হয়েছিল সমকাল। তাদের প্রায় সবাই অভিন্ন ভাষায় বলেছেন, দুই পক্ষের উত্তেজনাকর বক্তৃতা-বিবৃতিতে যে পরিস্থিতি সৃষ্টির আলামত দেখা দিচ্ছে, তাতে জনগণের উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণই নেই। আর পরিস্থিতি সত্যিই যদি সেদিকে যায়, তা হলে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়েও এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। সেইসঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও ব্যাহত হবে, যা কারও জন্যই সুখকর হবে না। তাই সব পক্ষেরই সহনশীল আচরণের কোনো বিকল্প নেই।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারি দল ও বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক হবে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ। নিজেদের প্রতিটি ছোটখাটো ইস্যু ও সমস্যা মানবিক গুণাবলির ভিত্তিতে সমাধান করবে তারা। যাতে সাধারণ মানুষ অনুভব করতে পারে, সরকার ও বিরোধী দল কেউ কারও প্রতিহিংসাপরায়ণ নয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত জনগণের চিন্তা-ভাবনা ও আবেগ-উচ্ছ্বাসকে বিচার-বুদ্ধির মাধ্যমে মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিতে সবাইকে ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। দেশকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে নিতে সবাইকে হিংসা ও প্রতিহিংসা ত্যাগ করে চলা উচিত। একই সঙ্গে তিনি বলেন, দেশবাসীর প্রত্যাশা হচ্ছে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন হবে। জনগণের এই চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত হবে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া।
রাজনৈতিক বিশ্নেষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মামলার রায় কী হবে, সেটা একান্তই আদালতের এখতিয়ার। যেহেতু মামলাটি স্পর্শকাতর এবং একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা এর সঙ্গে জড়িত, সে কারণে দেশের দুটি প্রধান দলের অনেক নেতাই মন্তব্য করছেন। এতে এমন ধারণা হতে পারেই, রাজনৈতিক নেতারা বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে চেষ্টা করছেন। তবে আইন সবার জন্য সমান। এ নিয়ে মন্তব্য করাই বেআইনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, আইনের চোখে সবাই সমান- এটা যে কোনো সভ্য সমাজে স্বীকৃত। গণতান্ত্রিক পরিবেশে আইন প্রয়োগে কোনো ভুল হলে তার সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহিতা কাঙ্ক্ষিত থাকে। অন্যদিকে, এর প্রয়োগ সঠিক হলে, তার ইতিবাচক প্রভাব সর্বত্র পড়ে। খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের আগের কয়েকটি দিনে আমরা পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা শুনছি, যা দুঃখজনক। এতে আইনের শাসনের প্রতি অনাস্থাই প্রকাশ পাচ্ছে। এটা সংক্রামক হয়ে যেতে পারে, যার কুফল পড়বে সমাজের সর্বত্র। এভাবে গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভের অবমূল্যায়ন করা হয়, যা শুভ লক্ষণ নয়। আশা করব, সংশ্নিষ্ট সব পক্ষ সংযত হবে। জনগণ যেন নিরুদ্বিগ্ন থাকতে পারে তেমন পরিবেশ সৃষ্টিতে মনোযোগী হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি এম. হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, আদালতের রায়ে যদি খালেদা জিয়া খালাস পেয়ে যান, তাহলে তেমন কোনো সমস্যার সৃষ্টি হবে না। কিন্তু তার যদি শাস্তি হয়, তাহলে দেশে সংকট দেখা দেবে। এ অবস্থায় উভয় পক্ষকেই সংযত ও ধৈর্যশীল আচরণ দেখাতে হবে। বিএনপির সামনে সংঘাতে না গিয়ে আইনগতভাবে মোকাবেলা কিংবা রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ রয়েছে। আবার আওয়ামী লীগ যদি ওই রায় উদযাপন করতে যায় কিংবা এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে যায়, তাহলে সংকট-সংঘাত আরও বাড়বে। তাই আওয়ামী লীগেরও ধৈর্য ও সহনশীলতা দেখানো দরকার।
সমকাল থেকে নেওয়া
বাংলাদেশ সময়: ১১:৪৩:২২ ৬০৭ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #breaking news #World News