বঙ্গ-নিউজঃ আদালতের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বড় একটি অংশ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। বিদ্যমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে যারা এখনও সততার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের পক্ষেও সততা বজায় রাখা কঠিন হবে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
রবিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এসব অভিযোগ করেন।
অনুষ্ঠানে মাহবুবে আলম বলেন,‘সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে বহুবার। বেশকিছু সময় আমাদের এই আদালতের বিচারকরা তাদের রায়ে সে সম্পর্কে কোনও বিরূপ মন্তব্য করেননি। বরং এই সর্বোচ্চ আদালত সামরিক ফরমানকে সংবিধানের ওপরে স্থান দিয়ে অনেক মামলা নিষ্পত্তি করেছেন এবং আমাদের মনোজগত এমন হয়েছিল যে, রক্তের অক্ষরে লেখা আমাদের সংবিধান ও সামরিক ফরমানকে সমান্তরাল অবস্থায় রেখে রায় দেওয়া হয়েছিল।’
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রসঙ্গ টেনে মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমাদের মনোজগতকে যিনি নাড়া দিলেন এবং স্রোতের বিপরীতে নিজেকে দাঁড় করালেন, তিনি হলেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। পঞ্চম সংশোধনীর মামলায় তিনি বললেন, কোনও সামরিক ফরমান, সামরিক আদেশ ইত্যাদি সংবিধানে স্থান পেতে পারে না এবং সংবিধানের সঙ্গে তুলনা করে তাকে কোনোভাবেই আইন হিসেবে গণ্য করা যায় না। ওই রায় আমাদের মনোজগতকে নাড়া দিলো এবং মনে হয় আমরা জেগে উঠলাম। আমাদের বিচার বিভাগের রেনেসাঁ শুরু হলো।’
রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘বেশ কয়েকবছর ধরে আমাদের বিচার বিভাগের অবক্ষয় ঘটেছে। সাধারণ জনগণের কাছে এ আদালতের যে ভাবমূর্তি ছিল, তাতে পরিবর্তন এসেছে। এর আগে একজন প্রধান বিচারপতিকে এই আদালতে সংবর্ধনা দেওয়ার সময় আমি এ আদালতের অবক্ষয়ের কিছু নমুনা তুলে ধরেছিলাম। আমার ওই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি তদন্তের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং তদন্ত অনেকটা অগ্রসরও হয়েছিল। কিন্তু যখন নতুন প্রধান বিচারপতি আসলেন, উনার দফতর থেকে সেই ফাইলটি নিখোঁজ হয়ে গেলো।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘হাইকোর্ট বিভাগের বিভিন্ন বেঞ্চ নিয়ে যেসব আলোচনা হয়, তা এখানে প্রকাশ করার মতো নয়। শুধু ভাবি, ১৯৭৫ সালে যখন এই আদালতে ঢুকেছিলাম, তখন একজন বেঞ্চ অফিসার সম্পর্কেও কোনও ধরনের বিরূপ মন্তব্য শুনিনি। কিন্তু জেনারেল এরশাদের সময় আদালত বিকেন্দ্রীকরণের নামে যখন হাইকোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চ ঢাকার বাইরে গেলো, আবার অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ের পর যখন ফিরে এলো, তখন আর সেই আগের অবস্থা রইল না। আদালত ফিরলেও বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার চোরাবালিতে আটকা পড়ল এ প্রতিষ্ঠান।’
বিভিন্ন মামলায় দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়ে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে মাহবুবে আলম বলেন, ‘হয়তো দেখা যায়, চার বছর আগে দায়ের করা মামলা লিস্টে বহাল তবিয়তে আছে, অথচ দুই মাস আগে দায়ের করা মামলার চূড়ান্ত শুনানি হয়ে যাচ্ছে। আদালতের কিছু অসাধু কর্মচারী মামলা ওপরে ওঠানোর কাজ করে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। কিছু মামলার শুনানি করা যাচ্ছে না, কিছু মামলার শুনানি হয়ে যাচ্ছে রকেট গতিতে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যখন এই আদালতে ঢুকলাম, তখন দেখেছি— একটি মামলা শুনানি হয়েছে এবং তার রায় দেওয়া হয়েছে সঙ্গে সঙ্গেই। কালে-ভদ্রে দু-একটি মামলা রায়ের জন্য সিএভি (অপেক্ষমাণ)করে রাখা হতো এবং আগের মামলার রায় শেষ হওয়ার পরে পরবর্তী মামলাটি ধরা হতো। এখন দেখা যাচ্ছে, কোনও কোনও আদালতে বিনা নোটিশে মামলা আংশিক শ্রুত হচ্ছে। অনেক মামলা শুনানির পরে রায় দেওয়া হচ্ছে না দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। আবার দেখা যায়, মামলার রায় হলেও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হচ্ছে না মাসের পর মাস।’
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়টি হলো— বিশেষ বিশেষ কোর্ট এখন বিশেষ বিশেষ আইনজীবীর কোর্ট হয়ে গেছে। বিচারপ্রার্থী ব্যক্তিরা অনেকে জেনে গেছেন, কোন কোর্টে কাকে নিয়ে গেলে মামলায় জয়ী হওয়া যাবে। এটা তো ন্যায়বিচারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অনেকেই ছুটছেন বিচারপতিদের স্ত্রী-সন্তানের কাছে। ভেবেছেন, এদের কাছে গেলে হয়তো মামলায় জয়লাভ করা যাবে। বিচারপতিদের আত্মীয় বা সন্তানরা আগেও এ পেশায় ছিলেন। কিন্তু কখনও এমন অবস্থা তৈরি হয়নি। এখন কেন বিচারপ্রার্থীদের আচরণ এমন হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।’
প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি আপনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এজন্য যে, আপনার স্ত্রীও এই আদালতের একজন আইনজীবী। তিনি আমাদের দেশের প্রথম ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) ও পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র সচিব, তার কন্যা। কিন্তু আপনি আপনার ভাবমূর্তিতে কোনও ধরনের দাগ পড়ুক, তা চিন্তা করে তাকে আদালতে আইন পেশা করতে দেননি এবং তিনিও আপনার ভাবমূর্তিকে সমুন্নত রাখার জন্য নিজের পেশাগত জীবনকে বিসর্জন দিয়েছেন। এজন্য তার প্রতিও আমি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।’
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘এরই মধ্যে আদালতের রায় নিয়ে জাল-জালিয়াতি শুরু হয়ে গেছে। আদালত থেকে জামিন দেওয়া হয়নি, অথচ জামিনের কাগজ তৈরি করে আসামিরা জেল থেকে বেরিয়ে গেছে। কিভাবে তথ্যপ্রযুক্তিকে আদালতের কাজে আরও বেশি ব্যবহার করা যায়, সে ব্যাপারে নিশ্চয়ই আপনি ব্যবস্থা নেবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি।’
আদালতে কিছু পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ফৌজদারি মামলার জামিনের শুনানির ব্যাপারে কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। নিয়ম করা উচিত যে আদালতে জামিনের জন্য প্রার্থনা করা হবে, সে আদালতে ডিউটিরত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বা সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলদের কাছে কপি দিতে হবে যেন তারা মামলাটির ব্যাপারে আদালতকে সাহায্য করতে পারেন। এখন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে কপি সার্ভ করার যে বিধান আছে, বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিধান পরিবর্তন হওয়া দরকার।’
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান এই আইনজীবী বলেন, ‘আমি ঢালাওভাবে হাইকোর্টের সব বেঞ্চের জন্য এসব কথা বলছি না। অনেক বিচারকই বিচারকাজ হাতের মুঠোয় রেখেছেন এবং আদালতের কর্মকর্তারা তাদের কথামতো কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং সঠিকভাবে ও আইনজীবীদের প্রত্যাশামতো তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু বিচারপতির আদালত চালানোর অব্যবস্থার কারণে সার্বিকভাবে গোটা বিচারালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তার কারণ, সুগন্ধের পরিধি হয় সীমিত, অথচ দুর্গন্ধের পরিধি হয় বিস্তৃত।’
নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতিকে সব ধরনের সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আমরা আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি এই বলে যে, আদালতের ভাবমূর্তি উন্নত করার জন্য, বিচারকাজকে গতিশীল করার জন্য, দেশের বিচার ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য, বিচারকাজে স্বচ্ছতা আনার জন্য এবং বিচারক ও আইনজীবীদের মঙ্গলের জন্য আপনি যেসব পদক্ষেপ নেবেন, সে বিষয়ে আমরা আপনাকে নিঃশর্ত সমর্থন করব। আমাদের প্রত্যাশা, আপনি এগিয়ে চলুন। আমরা থাকবো আপনার সঙ্গে।’
বাংলাদেশ সময়: ১৬:৩৫:১১ ৫৫৬ বার পঠিত #bangla newspaper #bd news #daily newspaper #world newspaper