‘উপাচার্য উপাখ্যান – ৯’ আব্দুল বায়েস

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » ‘উপাচার্য উপাখ্যান – ৯’ আব্দুল বায়েস
রবিবার, ২৮ জানুয়ারী ২০১৮



ছবি সংগৃহীত

বঙ্গ-নিউজঃ বোকা লোক নাকি কামানের সামনে বুক উঁচু করে দাঁড়ায় । ১৯৯৯ সালে ভারপ্রাপ্ত ভিসির দায়িত্ব নেবার পর আগপাছ না ভেবে ৩-৪ মাসের মধ্যে সিনেট অধিবেশন ডেকে বসলাম । বিষয় উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন । সেই ‘সুসংবাদটি’ সাংবাদিকরা লুফে নিলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসলো এবং আমাকে ঘিরে থাকা সবার চোখ কপালে উঠল । ভাবটা এমন যে বসতে না বসতেই চেয়ার ছেড়ে দেবার জন্য তাড়াহুড়ো করছি । ছানাবড়া চোখে দুএকজন সহকর্মী তো বলেই ফেললেন, ‘আপনি জেনেশুনে বিষ করেছেন পান’ । কেউ বললেন, ঘৃতাহুতির কথা শুনেছি কিন্তু এ যে আত্মাহুতির শামিল! আর নির্বাচন ? নিজে বাঁচলে নির্বাচনের নাম ! এসব শুনে হাত থেকে কাঁচের প্লেট খসে পড়ে গেলে যেমন ভ্যবাচেকা ভাব হয়, আমার মধ্যেও তেমনটি ঘটলো ।

ছবি সংগৃহীত
খুব শীঘ্রই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে থেকে ডাক পড়ল । ওখানটায় গিয়ে বুঝতে পারলাম, শ্রদ্ধেয় সুহৃদ তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রি প্রয়াত জনাব এএসএইচকে সাদেক আমার হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়াটা ভালো চোখে দেখেন নি । তাঁর প্রধান যুক্তি হচ্ছে, মন্ত্রনালয়ের সাথে আলাপ করে কাজটা করা উচিত ছিল । তিনি প্রস্তাবিত নির্বাচনের সময় দেশের বাইরে থাকবেন । সরকার চায় তার দলের কেউ ভিসি হোক । আর চাওয়াই পাওয়া নয়; এর জন্য কসরত করতে হয় ।

ছবি সংগৃহীত

বললাম ‘স্যার, আমি অধ্যাদেশ –’৭৩ পইপই করে পড়েছি যেখানে লেখা আছে নব্বুই দিনের মধ্যে প্যানেল নির্বাচন দিতে হবে। আমি জানি আপনি আমাকে নিয়ে ভাবছেন এবং এই জন্য আপনার কাছে কৃতজ্ঞ । কিন্তু বিশ্বাস করুণ, সিনেট সদস্যরা যদি আমাকে ভোট না দেন তা হলে আমি ভিসি হতে চাইনা ‘ । আমার কথা শুনে তিনি এমন তির্যক দৃষ্টিতে তাকালেন মনে হল যেন তার সামনে উপন্যাসিক দয়স্তাভস্কির ‘ইডিয়ট ‘ বসে আছে । ভ্রু কুঞ্চিত করে ইব্রাহীম হসেন খানকে নির্দেশ দিলেন, যা হবার তাতো হয়েছে; এবার সরকারি প্যানেল জাতে জয়লাভ করে সে ব্যবস্থা করো । স্পষ্ট মনে আছে যে সিংহ হৃদয়ের মানুষটি আমার নির্বাচনের জন্য বিদেশ সফর সংক্ষিপ্ত করেছিলেন । আমি ওই নির্বাচনে সর্বাধিক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলাম এবং এই জন্য সংশ্লিষ্ট সবার কাছে আর এক পশলা কৃতজ্ঞতা।ছবি সংগৃহীত
কৃষি মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর কাছ থেকে কথাটা শোনা ঃ অন্য কেউ না বাজালে নিজের ঢোল নিজেই বাজাতে হয়। একটু আগে নিজের ঢোল যে বাজালাম, তার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে । আগে-পরে হিসাব করে দেখি ভিসির চেয়ারে বসার পর, তা যেমন করেই হোক, অধ্যাদেশ –‘৭৩ অনুযায়ী নির্বাচনের দিকে পারত কেউ পা বাড়াতে চায় না। কারণ অনেকটাই সুবিদিত । প্রথমত, যতো আইন ততো ফাঁকফোকর – অধ্যাদেশের ভেতরেই নির্বাচন পরিহার করার পদ্ধতি বাতলানো আছে । দ্বিতীয়ত, নির্বাচন না করে যত দিন থাকা যায় ; তারপর নির্বাচন করে আরও কমপক্ষে চার বছর। এরপর দ্বিতীয় টার্ম । দ্বিতীয়ত, এই ছুতায় সেই ছুতায় আদালতে যাওয়া এবং প্রক্রিয়াকে প্রলম্বিত করার সুযোগ তো থাকছেই। সুতুরাং নো চিন্তা ডু ফুর্তি । তৃতীয়ত, জয় নিশ্চিত না করে নির্বাচনে না যাওয়ার মনোভাব ।অর্থাৎ নির্বাচন মানি কিন্তু জিতাটা আমার চাই। যতক্ষণ না আমি জয়লাভ করছি, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচন নির্বাসনে থাকলে ক্ষতি নেই!ছবি সংগৃহীত
বলাবাহুল্য, এসব করতে গিয়ে যেনতেন শিক্ষক সিলেকশনের নামে ভোটার নিয়োগ, পেটোয়া বাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি স্থিতিশীল দেখানো, ক্ষমতাসীন দলের কিংবা অঙ্গসংগঠনের সমাবেশে প্রথম কাতারে বসে আনুগত্য প্রকাশ , ইত্যাদি হেন হীন কাজ নেই যা উপাচার্য করেন না। অবশ্য গাধা যেমন জল ঘোলা করে খায়, তেমনি দু একজন আছেন যারা নানান চাপে নির্বাচন দিতে বাধ্য হন । তখন তার আমছালা দুটোই যাবার উপক্রম হয়।
সময়মতো ভিসি প্যানেল নির্বাচন, সিনেট নির্বাচন এবং ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হবার কারণে মনে করবার যথেষ্ট যুক্তি আছে যে অধ্যাদেশ – ’৭৩ আজ শুধু অর্থহীন নয়, উচ্চ শিক্ষার উন্নয়নের জন্য অপকারীও বটে। এ কথা সত্য যে, অন্যান্য যেমন ডীন , সিন্ডিকেট ইত্যাদি নির্বাচন সময়মত নাহলে্‌ও হয় কিন্তু অধ্যাদেশের মধ্যমণি বা প্রধান আকর্ষণ ভিসি প্যানেল নির্বাচন নিয়ে যত নষ্টামি । এটা অত্যন্ত লজ্জার কথা যে স্বৈর শাসনের সময় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের অথবা ভিসির নিয়মিত নির্বাচন হতো অথচ নির্বাচিত সরকারের সময় সেটা হয় না। ।
অধ্যাদেশ –’৭৩ চুয়াল্লিশ বছর পার করতে চলল। এই অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পেছনে বেশ কিছু মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল । আমরা আমাদের আর্থ –সামাজিক –রাজনৈতিক উন্নতির সময় সময় পর্যালোচনা করে থাকি। প্রয়োজনে ভালোটা রাখি, খারাপটা ফেলে দেই। আজ পর্যন্ত চুয়াল্লিশ বছর বয়সী অধ্যাদেশ –’৭৩ নিয়ে কোন রিভিউ হয়েছে বলে অন্তত আমার মনে পড়েনা । কোন সরকারই এটা করতে সাহস পায় না কেন তা বোধগম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয় কি আজীবন শুধু লেজুড়বৃত্তির লালন ক্ষেত্র হয়ে থাকবে?ছবি সংগৃহীত
অভিযোগ আছে যে , এই দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার নামে যা চলছে তা জাপানি ভাষায় বলে ‘হারিকিরি’ বা আত্মহনন। পুরো দেশ ও সমাজ ওখানে সংঘটিত কর্মকাণ্ডে হতাশ ও বিক্ষুব্দ । শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের ‘ফাদার’ হবার কথা কিন্তু কেউ কেউ ‘গড ফাদার’ বনে যায়; অভিযোগ আছে কোন কোন শিক্ষক সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিরিক্ত অর্থের জন্য বেশি সময় দেয়; ছাত্র থাকার কথা পড়াশোনায়, কিন্তু কিছুসংখ্যক আছে কেবল টাকা গোণায় । মোট কথা, রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করেছিল সে মরে নাই অথচ অধ্যাদেশ –’৭৩ বেঁচে প্রমাণ করে সে মরে গেছে ।

কিন্তু তা হবার নয়। তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রধম সরকার কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয় জনগোষ্ঠীর জন্য একটা ‘উপহার’ স্বরূপ। অনেক আশা-আকঙ্খা, স্বপ্ন নিয়ে রচিত এবং মহান জাতীয় সংসদে পাশকৃত এই অধ্যাদেশ। ধরে নেয়া হয়েছিল যে একটা পূর্ণ স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে জনগোষ্ঠী ‒ শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীও কর্মকর্তা-কর্মচারী ‒ শিক্ষা ও গবেষণার কাজে স্বাধীন এবং মুক্ত মন ও চেতনা নিয়ে দেশের ও দশের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করবেন। একটা গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের স্বাধীনতার সুফল পাবে দেশ, সমাজ ও বিশ্ব। বলা যায় যে, তিয়াত্তরের অধ্যাদেশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনেকটা নতুন নির্মিত মহাসড়ক বা রাস্তার মতো - হাই ওয়ে টু লার্নিং। এই সড়ক ধরে জ্ঞানীগুণীদের যাতায়াত ঘটবে, সৃষ্টি হবে সৃজনশীল সমাজ ‘গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, দেশ হইতে দেশান্তরে যাইবে সেই পথ’।

আজ কী দেখছি? সমস্ত স্বপ্ন মাটিতে মিশিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আজ নৈরাজ্যকর অবস্থা। শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের মুক্ত মনের বন্যায় জন্ম নিচ্ছে বড় বড় অন্যায়। সুযোগ ঘটছে যত দুর্নীতি, মারামারি, হানাহানি, ও বন্দুক যুদ্ধের মতো নিন্দনীয় ঘটনা । ক্ষমতা দখলও চলছে। চলছেনা শুধু যথাযথভাবে পড়াশোনা, উদ্ভাবন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও গবেষণা । অধ্যাদেশ নামক এই মহাসড়কের বিষটাই যেন আমরা বেশি করে বেছে নিয়েছি।
প্রসঙ্গত শামসুদ্দিন আবুল কালামের ‘পথ জানা নাই’ গল্পটি কেন জানি মনে পড়ছে।
গ্রামটিকে শহরের সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য রাস্তা দরকার। গরিব গহুরআলিকে বোঝানো হল যে তাঁর শেষ সম্বল জমিটুকু রাস্তার জন্য দিলে অধিক অর্থ উপার্জনের জন্য মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়বে, গ্রাম-শহর দৌড়াদৌড়ি লেগে যাবে (এমনকি তারও)। গহুরআলি মনে মনে ভাবল, ‘আর কাহাতক এইভাবে দুটি দুটি ধান খুঁটিয়া জীবন চালানো যায়’। সুতরাং, সে জমি দিল এবং রাস্তা হলো। “এ কী কেবলই সড়ক! একটা নতুন জীবনের রাস্তা- সুখের আর সমৃদ্ধির। — কিন্তু সাদামাটা সরল জীবন আসিতে লাগিল কুটবুদ্ধি আর কৌশলের দড়িজাল। অনেক বাঁক অনেক মোড়। — ধীরে ধীরে এই সড়ক বহিয়াই আসে হ্যানোত্যানো জিনিস কিনিতে মিলিটারির দালাল। গহুরআলির নিদারুণ কষ্ট। ভাবিল, তাহাকে (মিলিটারির দালাল) ধরিয়া যদি কোনো একটা উপায় মিলিয়া যায়; কিন্তু উপায় হইল না কিছুই । কেবল একদিন গহুরআলি খুঁজিয়া পাইল না হাজেরাকে। আর সে দালালেরও দেখা মিলিল না। গহুরআলি তখন উন্মাদের মতো সড়কটাকে কোপাইতেছে । চিৎকার করিয়া বলিতেছে ভুল, ভুল অইছিলো এই রাস্তা বানাইন্যা″।

আমাদের অধ্যাদেশ‒’৭৩ ঘিরে আজ অমানিশা অন্ধকার বিরাজ করছে। চুয়াল্লিশ বছরের পুরনো অধ্যাদেশ‒’৭৩ নিয়ে একটা চুলচেরা বিশ্লেষণ দরকার । এমনকি মহান জাতীয় সংসদে এ নিয়ে বিতর্ক হওয়া উচিত । এবং তা এখনই। নইলে গহুরালির মতো আমাদেরকেও অধ্যাদেশ কোপাইতে বলতে হবে ভুল, ভুল অইছিলো এই অধ্যাদেশ বানাইয়া’।

ছবি সংগৃহীত

সুত্র অধ্যাপক আব্দুল বায়েস

সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আশুলিয়া,সাভার ঢাকা

 

 

বাংলাদেশ সময়: ১৫:০০:১৭   ৭০৬ বার পঠিত   #  #  #  #




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আজকের সকল পত্রিকা’র আরও খবর


নেতাকর্মীদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন হাজী মোহাম্মদ হারিজ খান
সেরে উঠলেন ক্যানসার রোগীরা
আশুলিয়ায় খুশবু রেস্তোরাঁ উদ্বোধন
ধর্মপাশায় ১০ম গ্রেড বাস্তবায়নের দাবিতে শিক্ষকদের কর্মসূচী
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা ও কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে কৃষি পণ্য সরবরাহ
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা ও কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে কৃষি পণ্য সরবরাহ
বিশ্বব্যাপী প্রবাসীদের প্রতি দায়িত্ব পালনে কূটনীতিকদের আন্তরিক হতে হবে: শেখ হাসিনা
শেখ রাসেলের ৫৮ তম জন্ম বার্ষিকী ও জাতীয় ইদুর নিধন
শেখ রাসেলের ৫৮ তম জন্ম বার্ষিকী ও জাতীয় ইদুর নিধন

আর্কাইভ