‘আমি এবং আমিত্বের গ্রাস’ (যেতে যেতে পথে…৬৬)- ড. মনিরুস সালেহীন

Home Page » সাহিত্য » ‘আমি এবং আমিত্বের গ্রাস’ (যেতে যেতে পথে…৬৬)- ড. মনিরুস সালেহীন
শনিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০১৮



 ড. মনিরুস সালেহীন

“জানেন, আমি কে?” - এ ধরনের দম্ভোক্তি শুধু টিভির জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনেই না, প্রায়শই আমাদের কানে আসে চলার পথে, বিভিন্ন সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ায়। তবে, আফসোস, দম্ভোক্তির বিপরীতে টিভি বিজ্ঞাপনের সেই তরুণীর মতো আমরা বলতে পারি না, ‘ এই (দম্ভোক্তিকারী)ভদ্রলোক জানেন না তিনি কে’ ।

আমিত্বের জয়জয়কার আছে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায়। তার অনেক আগে অবশ্য আমিত্বের বিজয়ধ্বজা তুলে ধরেছেন ওয়াল্ট হুইটম্যান তার কবিতা সং অব মাইসেল্ফ এ- I celebrate myself, and sing myself, / And what I assume you shall assume….(কোনো কোনো নজরুল গবেষক বলেছেন নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার অনুপ্রেরণা হুইটম্যান থেকেই এসেছে। তো সে অন্য প্রসংগ)। তবে হুইটম্যান বা নজরুল যে আমিত্বের জয়গান গেয়েছেন তার দার্শনিক ভিত্তি প্রোথিত মানুষের অন্তর্নিহিত অজেয় শক্তির ওপর।

কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত প্রতিদিন চারপাশে যে আমিত্বের বড়াই দেখি তাতে থাকে ব্যক্তি শক্তির অহংকার। আমি তখন ছাড়িয়ে যায় ‘আমরা’কে। সামষ্টিকতা নুইয়ে পড়ে ব্যক্তির শক্তির কাছে।আমাদের রাজনীতির ক্ষমতাধরদের অধিকাংশরাই আমিত্বের বড়াই করেন বেশ জোরেশোরেই, তার কতকটা জেনেবুঝে, আর কিছুটা অভ্যাসের বশে, অবচেতনে। অনেক উচ্চ শিক্ষিত পদস্থ মানুষকেও বলতে শুনি ‘ আমার কমিটির সাধারণ সম্পাদক… ‘

এই আমি টা আসলে কে? মনে পড়ে কাহলিল জিবরানকে। ‘একটি প্রশ্ন একবার আমাকে বাকরূদ্ধ করে দিয়েছিল/ এটি হয়েছিল তখন যখন একজন লোক আমাকে প্রশ্ন করেছিল, তুমি কে? ‘

চেহারায় বা দর্শনধারিতে আভিজাত্য সবার থাকে না, কারো কারো থাকে। যাদের থাকে তাদের অনেকেই আসলেই অভিজাত, তাদের দেখলেই মনে হয় তারা দশজনের যে কোনো একজন নন, একেবারেই প্রথম জন। আবার অভিজাত, অর্থ, পদ বা ক্ষমতার দাপটে, হয়েও অনেকের চেহারায় সেটা থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্ষমতাধর একজনকে দেখিয়ে আমার এক বন্ধু বলেছিল, দেখো, এই লোকটাকে যদি লুংগি গেঞ্জি পড়িয়ে মাঠের কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়, কেউ কি ভুল করেও ভাববে তিনি আসলে অন্য কেউ, ভুল করে ওই কাজে লেগেছেন?

এ কথা বোধহয় আমাদের প্রায় সবার জন্যই প্রযোজ্য। আমি যে সম্মান বা খাতিরটা পাই তা আমার চেহারাসুরতের জন্য নয়, আমার কৃতির জন্য। কৃতি বলতে শুধু মেধা বা পদপদবী নয়, অর্থ ক্ষমতা শিল্পকৃতি বা অর্জন সবই বোঝাচ্ছি।

গোলাপের সতত বা অন্তর্গত মূল্যের জন্যই গোলাপকে যে নামেই ডাকি তা গোলাপই। কিন্তু মানুষের সতত মূল্য বা ইন্ট্রিঞ্জিক ভ্যালু যে সামান্যই তা বার বার বলে গেছেন ঋষি মনীষীরা। বায়রন বলেছেন, হু এম আই? নাথিং। বাট নট সো ইজ মাই আর্ট। আমি কেউ না। কিন্তু আমার শিল্প কিন্তু কোনো ‘নাথিং’ না। আমাদের যে মূল্য তা অর্জিত কিংবা আরোপিত। সেটা সরে গেলে? কা তব কান্তা… তুমি কার, কে তোমার?

একই উপলদ্ধির প্রকাশ আছে রবীন্দ্র নজরুলেও। সোনার তরী কবিতার ‘ঠাই নাই ঠাই ছোট সে তরী/ আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’ বলে কবি যে জিজ্ঞাসা উত্থাপন তা হচ্ছে সোনার তরী তো আমার সোনার ধান নেবে, আমাকে নেবে কি? কিংবা, নজরুলের আমায় নহে গো, ভালোবাস শুধু ভালোবাস মোর গান- এই উচ্চারণেও কি একই আকূতির প্রকাশ হচ্ছে না?

কাহলিল জিবরান বোধহয় এ জন্যই বলেছেন, আমাদের মধ্যে যা সহজাত তা নীরব আর যা অর্জিত তা প্রকাশ- উন্মুখ।

এসব কথা বলছি এ জন্য যে, যে চেয়ারের গুণে আমি বাড়তি সম্মানটুকু পাই সেই চেয়ারে বসলেই আমাদের অধিকাংশ’র ই মাথা ঠিক থাকে না। চেয়ারের উলটোদিকে থাকা মানুষকে তখনকে একজন উমেদার ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে ইচ্ছে করা না। না, এ দৃশ্য শুধু সরকারী দপ্তরে নয়, প্রাইভেট পাবলিক যে কোনো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সুযোগ পেলে একজন রিক্সাওয়ালাও আপনাকে একহাত দেখে নেবে। সেবা প্রদান বা সার্ভিস মেন্টালিটি বলে যে কথাটা আছে তা আমাদের চর্চার মধ্যে এখনো রপ্ত হয়নি।

আমজনতার একজন হয়ে সেবা পাওয়া বা সম্মান পাওয়া বেশ কষ্টকর আমাদের এ সংস্কৃতিতে। অনেক আগে এক বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম এখানে রেফারেন্স ছাড়া প্রেফারেন্স পাওয়া যায়না। বলাবাহুল্য, এই রেফারেন্সটা হতে হয় ক্ষমতার কিংবা স্বজনের।

যে অর্জিত বা আরোপিত গুণের অহংকারে আমিত্ব গ্রাস করে নেয় ‘ আমরা’ বা সামষ্টিকতাকে, তাতে মহিমান্বিত হয় না সেই ‘আমি’ যার জয়গান গেয়েছেন হুইটম্যান বা নজরুল। রবি ঠাকুর বলেন, ‘আপনাকে যে চেনা আমার শেষ হলো না’। এই উচ্চারণে আছে জীবনের অর্থ খোজার এক শাশ্বত জিজ্ঞাসা। কিন্তু রবিবাণীর আক্ষরিক অর্থেই আমাদের অধিকাংশরা নিজেদের চিনি না কিংবা চিনি ভুলভাবে। আর সেই খন্ডিত বা ভুল চেনার কারণেই আমাদের ‘আমিত্ব’ গ্রাস করে ‘আমাদের’ কে। এবং আমরা সদর্পে বলি, ‘জানেন, আমি কে?’

আন্তঃনগর তিস্তা ট্রেন
ঢাকা থেকে গফরগাঁও যাওয়ার পথে
২০ জানুয়ারি ২০১৮

বাংলাদেশ সময়: ৯:৫০:১৮   ৯৮৪ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ