‘উপাচার্য উপাখ্যান-৭’ আব্দুল বায়েস

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » ‘উপাচার্য উপাখ্যান-৭’ আব্দুল বায়েস
সোমবার, ২২ জানুয়ারী ২০১৮



ছবি সংগৃহীত

বঙ্গ-নিউজঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবার বাসনা নিয়ে অনেকে উপাসনা করেন। কেউ করেন ‘মানত’ । দিন-রাত মাটি করে, ক্লাশ ও পড়াশুনা বর্জন করে দিনের পর দিন ভিসি নামের এই ‘সোনার হরিণের’ পেছনে ছুটে থাকেন কেউ কেউ। চাই কি শিক্ষা মন্ত্রীর পিএস কিংবা কোনো উপ-সচিবের কক্ষে বসে বসে মন্ত্রীর অপেক্ষায় প্রহর গুণতে কারো বিবেকে একটুও বাধে না। মোট কথা, ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই’।

ছবি সংগৃহীত

সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য বলি, আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ওরকম কিছু ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কেন, কোনো হলের প্রভোষ্ট হবার সামান্যতম বাসনাও কোনোদিন মনে পোষণ করেছি বলে মনে পড়ে না। ১৯৭৫ সালে জাবিতে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেবার পর থেকে বিশেষ দলভুক্ত হবার জন্য টানাহ্যাঁচড়া কম হয় নি। কিন্তু কেন জানি মন সায় দিত না। কোনোকালেই শিক্ষক রাজনীতিতে নাক ডুবাতে চাইতাম না। যাই হোক, এক সময় পরিস্থিতির চাপে পড়ে শিক্ষকদের একটা দলের সভায় সরাসরি বক্তব্য রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেটা সম্ভবত ১৯৯০-৯১ সালের কথা। জাবিতে যোগ দেবার পনের বছর পর যখন আমি একজন অধ্যাপক।
১৯৯৭ সালে তৎকালীন সরকার আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার নিয়োগ দিলে চিত্রপট পুরোপুরি পালটে যায়। সময়ের আবর্তনে এবং ঘটন অঘটনের পরিক্রমায় প্রো-ভিসি ও ভিসির দায়িত্ব বর্তায় আমার ওপর। একদিন শুনি আমাকে জাবির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। উপাচার্য উপাখ্যানের শুরু এই সময় থেকেই। এযাবৎকালে জাবিতে আমিই একজন ব্যক্তি যে ট্রেজারার, প্রোভিসি ও ভিসির পদ অলংকৃত করেছি। পেশা জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া কী হয়? করুণাময়ের কাছে বলতে ইচ্ছে করে:

ছবি সংগৃহীত
আমারে তুমি অশেষ করেছে এমনি লীলা তব,
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।

উপাচার্যের দায়িত্ব নেবার পর ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী একে একে ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির হয়। ফুলে কাঁটা থাকে জেনেও ফুল নিতে হতো কারণ, ‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে, দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে’। সুখ ও দুঃখের কথা নিয়েই উপাচার্য উপাখ্যান।

ছবি সংগৃহীত

উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর প্রধান দায়িত্ব দাঁড়ালো বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর তথা দেশের রাষ্ট্রপতি ও সরকার প্রধানের (প্রধানমন্ত্রী) সাথে সাক্ষাৎ করা। এটাকে বলে সৌজন্য সাক্ষাৎ। তদানীন্তন মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও জাবি চ্যান্সেলর বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎকারটি ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। মিনিট পনেরো ধরে চলা সেটা কেন্দ্রীভূত ছিল জাবিতে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনা, বিশেষত ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে চলমান পরিস্থিতি। তিনি জানতে চাইলেন ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এখন পরিস্থিতি শান্ত কি না। কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করলেন শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতির ওপর। তাঁর মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবতীয় অবনতির জন্য একমাত্র দায়ী রাজনীতি।

ছবি সংগৃহীত

এদিকে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এপিএস, ইব্রাহিম হোসেন খানের (জাবির প্রাক্তন ছাত্র) সহযোগিতায় খুব দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের সুবর্ণ সুযোগ হাতে এলো। নির্ধারিত দিনে নির্দ্দিষ্ট সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উপস্থিত হলাম। ইব্রাহিমের রুমে অপেক্ষমান আমার বুক দুরুদুরু, হাত-পা কাঁপা শুরু। প্রধানমন্ত্রীকে টিভিতে অথবা দূর থেকে কোনো জনসভায় দেখছি কিন্তু জীবনের এই প্রথম মুখোমুখি হওয়া, কথা বলা। তাও আবার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংগালীর কন্যা শেখ হাসিনার সাথে কথা বলার কথা। আমার বক্তব্য যাতে তালগোল পাকিয়ে না যায় সেজন্য বিড়বিড় করে রিহার্সেল করলাম। ইব্রাহিম আমার অস্থিরতা টের পেয়ে একের পর এক চা ও পানি আনাতে লাগল।

ছবি সংগৃহীত
এক সময় ডাক পড়ল। প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করে তাঁর আন্তরিক সম্ভাষণ আর মায়িক মুখ দেখে আমার সব নার্ভাসনেস যেন নিমিষে উবে গেল। মনে হল, দেশের প্রধানমন্ত্রী নয়, আমি একজন সাধারণ গৃহবধুর মুখোমুখি হয়েছি। আমার নার্ভাসনেস দূর করার জন্য কি না জানিনা, তিনি মাথার আঁচল আরও একটু টেনে স্মিতহাস্যে বললেন,
‘আপনার অনেক লেখা আমি পড়েছি’।
এরপরের বক্তব্যটি ছিল আরও অনেক বেশি আশ্বস্তকর, হৃদয়গ্রাহী এবং ষ্টেটসম্যান লাইক, ‘যে দলেরই হোক, বিশৃংখলাকারীদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। দরকার হলে সরাসরি আমার কাছে ফোন করবেন। আমি চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা হোক’।
ভাবলাম, এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। ইতোমধ্যে আমার নার্ভাসনেস দূর হয়েছে, কন্ঠের জড়তা কেটে গেছে। একটু গুটিসুটি হয়ে বিনীতভাবে বললাম,
“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন। তাই সুযোগ পেলেই সেখানে ছুটে যান। কিন্তু দেশে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে, সেগুলোতে আপনার যাওয়া উচিত নয় কি’?
বেশ জোড়ে একটা হাসি দিয়ে উত্তর দিলেন, ‘আমি কি কখনো যাব না বলেছি? নিশ্চয় যাবো, যাবো না কেন?’
‘তা হলে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জাবিতে আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। দীর্ঘ ২৫ বছরেও সেখানে কোনো প্রধানমন্ত্রী পা ফেলেন নি অথচ ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ কিঃমিঃ উত্তরে দেশের একমাত্র সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়টি অবস্থিত’।
‘ঠিক আছে আমি আপনার ক্যাম্পাসে যাব। দিন-তারিখ ঠিক করুন।’
নদীতে পলি পড়ার মতো জীবনে অনেক আনন্দ মনে জমা হয় যার মধ্যে কিছু হারিয়ে যায় আবার নতুন কিছু আনন্দ প্রতিস্থাপিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার অনুরোধে সাড়া দিয়ে জাবি ক্যাম্পাসে আসতে রাজি হয়েছিলেন, আমার মনে ওই আনন্দটা চিরস্থায়ী আসন গেড়ে বসে আছে।
যাই হোক, ক্যাম্পাসে ফিরে এসে এই সুখবরটি দেবার পর হৈ চৈ পড়ে গেল। জাবি যেন নতুন জীবন ফিরে ফেল। সিদ্ধান্ত হলো শহীদ মিানারের পশ্চিম দিকের লাগোয়া বাগানে মঞ্চ তৈরি হবে যাতে তিনি সুধী সমাবেশে ভাষণ দিতে পারেন। তার আগে তিনি বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত হলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করবেন। কিন্তু মূল সমস্যা দাঁড়াল অন্য এক জায়গায়। ক্যাম্পাসের মূল রাস্তা থেকে বঙ্গবন্ধু হল পর্যন্ত একটা রাস্তা নির্মাণ করতে হবে। এমনিতে জাবি অর্থসংকটে কাবু হয়ে আছে তার ওপর এই বাড়তি ব্যয় কীভাবে মেটাবো সে চিন্তায় অধীর। ঠিক সেই সময় ইব্রাহিম জানালো, প্রধানমন্ত্রী যেখানেই যাবেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ ওখানে যাবতীয় অবকাঠামোর দায়িত্ব নিয়ে থাকে। আসলেও তাই- একদিন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ থেকে আমাকে আশ্বস্ত করে বলা হলো, খুব বেশি অসুবিধা নেই। মাত্র ছোট একটা রাস্তা, বেশি সময় ও অর্থ লাগার কথা নয়।
আমি দেখলাম এই মওকা হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। তাদেরকে বললাম, প্রধানমন্ত্রী সারা ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে দেখবেন। সুতরাং সব রাস্তাঘাট তৈরি/রক্ষণাবেক্ষণ চাই। সেই সুবাদে সারা ক্যাম্পাসের রাস্তায় পিচ ঢালা হলো এবং নতুন রাস্তা হিসাবে তৈরি হলো টিএসসি টু মোশাররফ হোসেন হল রাস্তাটি।
এরিমধ্যে শেখ হাসিনার ক্যাম্পাসে আগমনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিল সরকার বিরোধী শিক্ষক সমাজ। এমন কি তাঁর সফর প্রতিহত করার কথাও কেউ কেউ বললেন। আমার টেনশন বাড়তে থাকে- বমি বমি ভাব আর চুনা চুনা ঢেকুর। অবশ্য প্রোভিসি তাজুল ইসলাম ও ট্রেজারার শরীফ এনামুল কবীরের শত অভয় বাণী স্বত্বেও টেনশন ক্ষণিকের জন্য স্থগিত হলো কিন্তু দূর হলো না।
সকল প্রস্তুতির প্রায় শেষ পর্বে একদিন হঠাৎ প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ফোন পেয়ে আামর শরীর কেঁপে উঠল। শংকা জাগল, বিরোধীদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী কর্মসূচি বাতিল করে দেবেন না তো? শুধু এইটুকুই খবর পেলাম যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমার হাত পা ঠাণ্ডা হলো, মস্তিষ্ক কাজ করল না। দোয়া-দরূদ পড়তে পড়তে আর বুকে ফু দিতে দিতে হাজির হলাম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রথম কথাতেই যেন আমার শরীরে ঘাম ঝেরে জ্বর চলে গেল-
‘প্রস্তুতি কেমন চলছে?’
‘জ্বি ভা - ল - ই’। অনেকটা বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে আমি বললাম।
‘শুনলাম একটা লিফলেটে আমার সফর বাতিল করার কথা বলা হয়েছে’
‘মাথানিচু করে বললাম, ‘জ্বি’।
‘আপনি এ নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না। আমি জাবি ক্যাম্পাসে যাবই’।
তাঁর আশ্বাসে পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেলাম। বললাম, ‘ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’,
‘এবার বলুন আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যাগুলো কী কী?’
আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা লন্ড্রি লিস্ট তুলে ধরলাম যার মধ্যে ছাত্র/ছাত্রী ও ক্যাম্পাসের সম্পদের নিরাপত্তার খাতিরে ক্যাম্পাসের চারিদিক দেয়াল নির্মাণ অন্যতম ছিল।
‘দেয়াল কেন?’ প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন।
‘তা না হলে বহিরাগতরা বেশ বিরক্ত করে’।
‘তার চেয়ে বরং প্রাকৃতিক প্রতবন্ধকতা তৈরি করুন- যেমন দীঘি বা পুকুর কাটুন। মাছ চাষও হবে, বহিরাগতদের অবাধ চলাচলও বাধাগ্রস্ত হবে’।
‘কিন্তু নেত্রী মানুষ যে মাছ চুরি করে খেয়ে ফেলবে’?
‘আর তাতে কী? একটু আধটু খাক না, তবুও তো প্রোটিন পাবে। তারপরও যা থাকবে তা আপনার জন্য কম হবে না’।

প্রধানমন্ত্রী জাবি ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। মনে পড়ে, শীতের মৌসুমে অতিথি পাখির আগমণ তাঁর ভাষণকে কাব্যময় করে তুলেছিল। বললেন, যে ক্যাম্পসে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে পাখি আসে, সে ক্যাম্পাসে যেন একটা গুলির শব্দ শোনা না যায়। ওই সভা থেকে তিনি বিভিন্ন প্রকল্পে প্রায় ৪০ কোটি টাকার অনুদানের প্রতস্রুতি দিলেন। সেই প্রতিশ্রুত অর্থ গেল ২৫ বছরে জাবি যা পেয়েছিল তার চেয়ে বেশি।

‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর
মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগণমাঝে,

সুত্র অধ্যাপক আব্দুল বায়েস

সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আশুলিয়া,সাভার ঢাকা

 

বাংলাদেশ সময়: ১৮:৪৪:৩১   ১০৫১ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আজকের সকল পত্রিকা’র আরও খবর


নেতাকর্মীদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন হাজী মোহাম্মদ হারিজ খান
সেরে উঠলেন ক্যানসার রোগীরা
আশুলিয়ায় খুশবু রেস্তোরাঁ উদ্বোধন
ধর্মপাশায় ১০ম গ্রেড বাস্তবায়নের দাবিতে শিক্ষকদের কর্মসূচী
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা ও কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে কৃষি পণ্য সরবরাহ
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা ও কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে কৃষি পণ্য সরবরাহ
বিশ্বব্যাপী প্রবাসীদের প্রতি দায়িত্ব পালনে কূটনীতিকদের আন্তরিক হতে হবে: শেখ হাসিনা
শেখ রাসেলের ৫৮ তম জন্ম বার্ষিকী ও জাতীয় ইদুর নিধন
শেখ রাসেলের ৫৮ তম জন্ম বার্ষিকী ও জাতীয় ইদুর নিধন

আর্কাইভ