বঙ্গ-নিউজঃ ব্যাক্তি ও ক্ষেত্র বিশেষ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদটি আর্থিক দিক থেকে কোনোক্রমেই লাভজনক হবার কথা নয় । ভিসি হওয়া মানে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত অবস্থা । তবে স্বীকার করতেই হবে যে, সামাজিক অবস্থানের দৃষ্টিকোণ থেকে পদটি লোভনীয় এবং কিঞ্চিত লোমহর্ষক । ক্ষমতার প্রতি যৎকিঞ্চিত লোভ সবারই থাকে । সেই লোভ আবার কারো কারো জন্য কাল ও লোমহর্ষক হয়ে উঠতে পারে । সে কথা না হয় আপাতত থাক।
যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে বসলে পরে ব্যাক্তিটির মধ্যে একটা উলসানি ভাব জাগে, মন ঊরু উরু করে । এটাই স্বাভাবিক কারণ উপাচার্য মানে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠের বস; অধ্যাপকদের অধিপতি , ছাত্রছাত্রীর মাথার ওপর ছাতি । বলতে দ্বিধা নেই যে এই অনুভূতির ছিটেফোঁটা আমার মধ্যেও কাজ করেছিল
সেই উপাচার্যের চেয়ারে বসে উৎসব উদযাপন করার মুহূর্তে ছোটখাটো একটা হোঁচট খেতে হল । জাবি পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অফিসের (পি এন্ড ডি ) একটা সংবাদ আমাদের উৎসবের সকল আমেজে যেন পানি ঢেলে দিল । সংবাদটি হল, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) যেকোনো সময় জাবির অর্থ বরাদ্ধ বাতিল করে দিতে পারে।
এর পেছনে অবশ্য নাতিদীর্ঘ একটা ইতিহাস আছে। জাবি শহীদ মিনার লাগোয়া ঠিক উত্তর দিকটায় লেকের পাড়ে গাছগাছড়ায় চারিদিক আবৃত জায়গাটিতে নতুন কলাভবন নির্মাণ করার কথা ছিল। সেই মতে ইউজিসি থেকে ভিত্তি স্থাপনের নামে, এমনকি প্রথম তলা তোলার নামে টাকা এনে খরচ করা হয়েছে অন্য কাজে। তার মানে কাজির গরু কাগজে থেকে থাকলেও বাস্তবে গোয়াল ছিল খালি। বেশ কয়েকবার সতর্কীকরণ নোটিশের পর ইউজিসির বর্তমান কঠোর অবস্থান দেখে ভাবলাম, অভাগা যে দিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়; আমিও মাঝি হলাম আর গাঙ্গও বাঁকা হল । সবই কপাল । পরিচালক আনোয়ার জানালেন আগামি দুতিন মাসের মধ্য গাঁথুনি দিতে না পারলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। বলা বাহুল্য, পিলে চমকানো এই সংবাদ শুনে আমার টেনশন স্ফীত হতে থাকল – বমি বমি ভাব , চুনা চুনা ঢেকুর !
বিপদ একা আসলে না হয় কথা ছিল। বিপদ আসলো এক মহা বিপদ সঙ্গী করে । নতুন কলা ভবন নির্মাণের জন্য নির্বাচিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক এই কাজে হাত দেবেন না বলে বেঁকে বসেছেন । তার অকাট্য যুক্তি, প্রায় বছর খানেক পূর্বে পাওয়া কাজের খরচ ইতিমধ্যে মোটা দাগে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই খবর শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল । নতুন ঠিকাদার খুঁজে সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কাজ শুরু করতেও ৪-৫ মাস কিংবা তারও বেশি সময় লাগার কথা । এর মধ্যে সব খেলা শেষ হয়ে যাবে – ডাক্তার আসবার আগে রুগীর মৃত্যু ঘটবে ।
আর এক জ্বালার কথা না বললেই নয় । নতুন কলা ভবন নির্মাণের জন্য ইতিহাস বিভাগের প্রখ্যাত অধ্যাপক আতাউর রহমান খানের নেত্রিত্তে শিক্ষকগণ মৃদুমন্দ চাপ দিতে থাকলেন । তাদের কথা, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত এবং ইউজিসির বরাদ্ধের পরও কেন কর্তৃপক্ষ নির্মাণ নিয়ে নীরব ? অপর দিকে, শ্রদ্ধাভাজন কিছু শিক্ষক নির্বাচিত জায়গায় নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে পরিবেশ ও নৈসর্গিক শোভা নষ্টের প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন । দ্বিতীয় পক্ষ এমনকি গাছের ডালে লাল ফিতা বেঁধে প্রতীকী প্রতিবাদ জানানো শুরু করলেন। সাক্ষাতে দু একজনকে বললাম, প্রায় একবছর পূর্বে নেয়া সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ আজ কেন? এত দেখছি গণ্ডারের কাতুকুতুর মত অবস্থা – কাতুকুতু খাবার দশ দিন পর হাসে । মশকরা করে আরও বললাম, চুলের লাল ফিতা বেঁধে লাভ নেই, লাল রক্ত ঝরাতে পারলে সিদ্ধি সাধন হতে পারে। ।
একদিন হাজার রকমের দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে অফিসে বসে আছি এমন সময় কলা ভবনের কিছু শিক্ষক আমার সাথে দেখা করতে এলেন। আমি সাতসকালে তাদেরকে শুকনো মুখে বসার অনুরধ জানিয়ে বললাম,
‘বলুন কি করতে পারি’ ।
‘স্যার, আমরা নতুন কলা ভবনের নকশাটা একটু বদল করতে চাই ‘
‘কেন’?
‘আমরা চাই সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের মতো প্রত্যেক সিনিয়র শিক্ষকের রুমে সংযুক্ত টয়লেট থাকবে। তা না হলে আমাদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে বলে ধরে নেব।‘
যুক্তি শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেলে ওদের দিকে কটমট তাকিয়ে রাগত স্বরে বললাম ,
‘তাদের না হয় ঘন ঘন পয়খানা দরকার তাই বলে তোমাদেরও? অতো পায়খানা পায়খানা করলে কিন্তু বিল্ডিং হবেনা বলে দিচ্ছি’ ।
‘ঠিক আছে স্যার । পায়খানার দরকার নাই, বিল্ডিঙই চলুক’ – বলে চটপট চা খেয়ে চম্পট দিলেন ।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে ডাক্তার আব্দুল হান্নানকে দিয়ে ঠিকাদার বুলবুল চৌধুরীকে ভিসি অফিসে চায়ের আমন্ত্রন জানালাম । সব কথা শুনে তার কাছে অনুরধ রাখলাম ঃ(ক) বৃহত্তর কুমিল্লার একজন উপাচার্যকে সমুহ বিপদ থেকে রক্ষা করে কুমিল্লার ইজ্জত রক্ষা করা আপনার দায়িত্ব (বেগার দাই নেইবার পলিসি) ; (খ) লাভালাভ হিসাব না করে সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টিকোণ থেকে অতিরিক্ত অর্থায়ন ছাড়া কাজটা অতি দ্রুত সম্পন্ন করুন এবং (গ) যেদিন ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপিত হবে তার ঠিক এক বছর পর নতুন কলাভবনে আমরা চা খাব আপনার কাছ থেকে আমি এমন প্রতিশ্রুতি চাই।
আনন্দের কথা শিক্ষিত , বিনয়ী ও মার্জিত ঠিকাদার বুলবুল চৌধুরী আমার অনুরধ রক্ষা করে ছিলেন । আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি । সত্যি সিত্যি আমরা ঠিক এক বছরের মাথায় নতুন কলা ভবনের লাউঞ্জে বসে চা খেয়েছিলাম ।
খুব শীঘ্রই সেই নতুন কলা ভবন ছাত্র-ছাত্রিদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠতে লাগলো । মনে হল, ‘পাখি- সব করে রব, রাতি পোহাইল / কাননে কুসুমকলি , সকলি ফুটিল’ । ডীন হয়ে আসলেন আমার সুদিন- দুর্দিনের সাথীরা – আফসার আহামেদ, মহাম্মদ নাসিরুদ্দিন (প্রয়াত) , আসিত বরন পাল, কামরুল হাসান টিটু, মজাম্মেল হক প্রমুখ । এই আনন্দ রাখি কোথায় -
আলো আমার, আলো ওগো ,আলো ভুবন-ভরা,
আলো নয়ন- ধওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা ।
সুত্র অধ্যাপক আব্দুল বায়েস
সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আশুলিয়া,সাভার ঢাকা
বাংলাদেশ সময়: ১৩:২৫:৩১ ১০৩০ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bangladesh news #bd news #daily newspaper #World News