বঙ্গ-নিউজঃ কিছুটা কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছয় বছরের মেয়েটি বলল, ‘আর কতক্ষণ, বাবা?’ আঙুল ধরে রাখা বাবা সান্ত্বনা দেন মেয়েকে, ‘এই তো আর একটু।’ সামনের দিকে তাকায় মেয়েটি। অধৈর্য পায়ে দুটো নাচুনি দিল সে, ‘এত বড় লাইন!’
মহাবিরক্ত স্ত্রীও, ‘খাবারের জন্য এভাবে আর লাইনে দাঁড়াতে ভালো লাগছে না। চলো তো বাসায় চলে যাই। আজ না খেয়েই থাকব।’ ঘড়ির দিকে তাকালেন পুরুষটি, ‘আর একটু।’
‘সেই কখন এসেছি! লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছে- ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি। চলো।’ বিরক্তির শেষ পর্যায়ে চলে যান তিনি।
বিয়াল্লিশ মিনিট চলে গেছে এরই মধ্যে। ঝাড়া এক ঘণ্টা সাত মিনিট পর তারা যখন হোটেলের কাউন্টারের সামনে পৌঁছলেন, তখন ভেতর থেকে যে ছয়টা পরোটা দেওয়া হলো- সেগুলো তখনও কাঁচা, দেখতেও বেশ বিশ্রী।
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। সেই গদ্যে মজে মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেল তাদের। টেবিলে এসে বসতেই দেখতে পেলেন- এলাকার প্রায় সবাই এসেছেন হোটেলে, নাস্তা খেতে এসেছেন তারা সকালের। কারণ গত রাত থেকে কোনো গ্যাস জ্বলেনি চুলোয়।
‘শীত আসবে আর রান্না নিয়ে ভোগান্তি হবে না- এমনটা হতেই পারে না। গত ১১ বছরের অভিজ্ঞতা তাই বলে। প্রতি বছর এই সমস্যা বেড়েই চলছে।’ ঢাকার মোহাম্মদপুরের কাটাসুর এলাকার বাসিন্দা আসমা জাহান এভাবেই নিজের দুরবস্থার বর্ণনা দিলেন।
তিনি জানালেন, দিনের বেলা গ্যাস থাকেই না। খুব সকালে গ্যাস চলে যায়, আসতে আসতে বিকেল। কোনো দিন রাত হয়ে যায়। গত ডিসেম্বরের শেষ থেকে অবস্থা বেশি খারাপ হয়েছে। সারাদিন দুই ঘণ্টাও ঠিকমতো চুলা জ্বালানো সম্ভব হয় না। তিন বেলার রান্না এক বেলাই সারতে হচ্ছে।
শুধু মোহাম্মদপুরেই নয়, ধানমণ্ডি, আদাবর, মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, কাজীপাড়া, ইন্দিরা রোড, কলাবাগান, শুক্রাবাদ, কাঁঠালবাগান, মগবাজার, মালিবাগ, রামপুরা, বনশ্রী, বাসাবো, বারিধারা, কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় ভয়াবহ গ্যাসের সংকট ছড়িয়ে পড়েছে।
এসব এলাকার মানুষকে বিকল্প উপায়ে সকাল ও দুপরের রান্নার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। অবস্থাসম্পন্ন বেশিরভাগ বাড়িতে রান্না হচ্ছে ইলেকট্রিক কুকারে। কেউবা স্থায়ীভাবে সমাধানের জন্য এলপিজি ব্যবহার করছেন। মাটির চুলা ব্যবহার করছেন নিম্নবিত্তদের অনেকে। কেউ কেউ খাবার কিনছেন হোটেল থেকে। গৃহিণীদের রান্নার সময়সূচিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।
শ্যামলী কাজী অফিস এলাকার বাসিন্দা ফৌজিয়া কবির বলেন, ‘সকাল-রাত মিলিয়ে কয়েক ঘণ্টাও পাইপলাইনে গ্যাস থাকে না। আশপাশের বাসাগুলোতে মূলত ইনডাকশন ওভেন, হিটার ও এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করে রান্নার কাজ চলছে। একদিকে গ্যাসের বিল দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে এলপিজি বা হিটার-ওভেনের জন্য বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।’
বনশ্রী সি ব্লকের বাসিন্দা মামুনুর রশিদ বলেন, ‘গত সপ্তাহ থেকে হোটেল থেকে কিনতে হচ্ছে সকালের নাস্তা। অনেক সময় বাসি খাবার খেয়ে স্কুলে যাচ্ছে বাচ্চা। বাসায় এখন শুধু রাতেই রান্না হয়।’
রাজধানীর পুরান ঢাকার প্রায় সব এলাকায় বছরজুড়েই গ্যাসের সংকট রয়েছে। বছরের অধিকাংশ সময়ই গ্যাসের স্বাভাবিক সরবরাহ পান না এসব এলাকার বাসিন্দারা। আর শীতে এলে তাদের চুলা জ্বালানোই কঠিন হয়ে পড়ে।
শাঁখারীবাজার, পাটুয়াটুলী, ইসলামপুর, বাংলাবাজার, লক্ষ্মীবাজার, বংশাল, আরামবাগ, আর কে মিশন রোড, টিকাটুলী, মিরহাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, জাফরাবাদ, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় গ্যাসের সংকট আরও তীব্র।
পুরান ঢাকার বংশালের বাসিন্দা সৌমিত্র দাশ জানান, তাদের গ্যাস সংকট সারা বছরই থাকে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংকট আরও বেড়েছে। গত তিন সপ্তাহ থেকে প্রায় সারা দিন চুলা জ্বলছে না। বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে হচ্ছে। এতে মাসিক গ্যাস বিল ৮০০ টাকার বাইরেও দেড় হাজার টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে তাদের।
বর্তমানে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে উৎপাদন কমে গেছে কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্রের। সংস্কারের কারণে গ্যাস উত্তোলন বন্ধ আছে আরও কয়েকটি কূপের। এজন্য সংকট আরও বেড়েছে। এখন দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। পেট্রোবাংলা সরবরাহ করছে ২৬৯ কোটি ঘনফুট।
ঢাকায় গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা তিতাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান জানান, তার এলাকায় অন্য সময়ে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ২০০ কোটি ঘনফুট। তিনি ৩০ থেকে ৩৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস কম পান। শীতে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যায়।
গত কয়েক দিনের শৈত্যপ্রবাহে ঢাকায় গ্যাসের চাহিদা ২০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানান তিনি। মসিউর বলেন, আগের ঘাটতির সঙ্গে বাড়তি চাহিদা যোগ হওয়ায় গ্রাহকদের ভোগান্তি বেশি হচ্ছে। শীত কমলে সমস্যা একটু কমবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিতাসের এমডি।
সুত্রঃ সমকাল
বাংলাদেশ সময়: ০:১৪:০৫ ৯৪৩ বার পঠিত #bangla news #bangladeshi News #bd news #bongo-news(বঙ্গ-নিউজ) #breaking news #World News