বঙ্গ-নিউজঃ পত্রিকা জগতের সাথে আমার পরিচয় বেশ পুরনো । একজন পাঠক হিসাবে দৈনিক দুই তিনটা পত্রিকার খবরাখবর গোগ্রাসে গিলতাম; চোখ বুলাতাম আরও কয়েকটার ওপর । এক সময় ডেইলি স্টার ও ভোরের কাগজে নিয়মিত সাপ্তাহিক কলাম লিখতাম। যে চাইতো তার পত্রিকায়ই লিখতাম। বস্তুত, আমি ও প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এসএমএএস কিবরিয়া ইংরাজি ও বাংলায় একই সাথে কলাম লিখতাম বলে আমদেরকে বলা হত বাই লিঙ্গুয়াল কলামিইস্ট । লেখালেখির যৌবন কালে জাবি প্রশাসনে জড়িয়েছিলাম বলে সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে । দহনের কথা চিন্তা না করে দহরমমহরম সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলাম। অনেকের মধ্যে সোহেল আহসান নিপু, রাসেদ মেহেদি, আলমগির স্বপনের সাথে কালেভদ্রে কথা হয়। । সাধারণত সাংবাদিক সমিতির সাথে প্রশাসনের গ্যাপ তৈরি হয়; আমি যতটুকু পেরেছি ওদের দাবিদাওয়া মেনে নিতাম । যেমন, সিনেট অধিবেশনে ওদের আমন্ত্রন জানানো হতোনা – আমি উপস্থিতি নিশ্চিত করেছিলাম।
ভিসি অফিসে একদিন সহকর্মী আফসার আহমেদ আমার কাছে তার এক ছাত্রকে নিয়ে এলেন।খুব গরিব ঘরের ছেলে; বাবা দিন মজুর। সে আবার কোন এক পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা। অর্থের অভাবে পরীক্ষার ফি দিতে পারছেনা ; পাঠ চুকিয়ে দেবার সিদ্ধান্তে অটল। ছেলেটিকে দেখে মায়া লাগলে আমি তার ব্যয়ভার বহন করলাম এবং পরিক্ষার টাকা নগদ দিলাম। সাত দিনও যায়নি দেখি ভিসি বিরোধী এক বিরাট মিছিলের অগ্রভাগে আমার সেই সোনার সৈনিক । টাকা দেয়া কিন্তু বন্ধ ছিলনা ।
আমার খুব বড় একজন ভক্ত মোবারক হোসেন খান । পরিসংখ্যা বিভাগের তুখোড় ও তীক্ষ্ণ মেধাবি ছাত্র এবং শিক্ষক । আমার এই ধরনের লিবেরাল মনোভবের সাথে সে একমত নয় । তার কথা শত্রুপক্ষের শেকড় উপড়ে ফেলতে হয় । অবশ্য তার তেরছা চাহনি ও শব্দ চয়নের কারণে সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট নিয়েও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে বেশ দেরী হয়েছিল । এখন পরাণটা তার দেশে, পড়ান বিদেশে ।
যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় এক ধরনের টাইম বোমা । কখন ফাটবে কেউ জানেনা । ক্ষমতার দেড় থেকে দুই বছরের মাথায় তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছিলাম এই ভেবে যে ছোটোখাটো সংকট ছাড়া বড় ধরনের বিপর্যয় পার করা গেছে ।হঠাৎ দেখি বজ্রপাত, চারিদিক অন্ধকার । ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে। হাওয়া গরম, তাওয়া গরম। মিছিলের পর মিছিল। কি হল?
এক ধর্ষক পরীক্ষা দেবার নিয়তে ফাঁকফোকরে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। খুব সম্ভবত ইংরাজি বিভাগের পরীক্ষা ছিল। তাৎক্ষনিক নির্দেশে ওই ছেলের পরীক্ষা নেয়া বন্ধ করা হয়েছিল। তারপরও আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকল। ওই ছেলের পরিক্ষা কেন নিলাম না তা জানতে চেয়ে প্রশাসনের উপর উচ্চ আদালতের রুল নিশি দেখান হল ।কিন্তু তারপরও আন্দোলন থামলোনা কেন তা একটা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন – সেদিনের জন্য এবং আজও। এই ধরনের স্পর্শকাতর আন্দোলনের পেছনেও যদি সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনীতি গুটি নাড়ে তা হলে সেটা খুবই দুঃখজনক ।
সেই আন্দোলনের সময় আমার বিভাগেরই একজন ছাত্রী সাংবাদিক পরিচয়ে আমার রুমে ঢুকল; চলমান পরিস্থিতে আমার পদক্ষেপের কথা জানতে চাইল । আমি খোলামেলা তাকে বললাম, ছেলেটির পরীক্ষা যে নেয়া হচ্ছেনা তার সাক্ষি উচ্চ আদালতের চিঠি । সুতরাং, প্রশাসন তাকে পরীক্ষা দিতে দিয়েছে অন্তত এই যুক্তিতে আন্দোলন অর্থহীন । মেয়েটি বাইরে গিয়ে আন্দোলনকারীদের কাছে ঠিক তার উলটোটা বলল । আন্দোলনকারীরা আরও বেশি ক্ষেপে গিয়ে আমাদেরকে প্রশাসনিক ভবনে আটকে রাখল। সহকর্মী আমির হসেন খান ও কয়েকজন না বেরুবার পরামর্শ দিলেও আমি বেরুবার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারন, অপরাধ না করে শাস্তি ভোগ করব কেন? ধ্বস্তাধস্তি করে অফিস ছেড়ে দলবেঁধে বাসায় ফেরার সময় ভিসি অফিসের লাগোয়া ব্রিজের কোনায় আবছা আলোতে দাঁড়িয়ে থাকা আমার ‘ সৎ ও সুযোগ্য’ সেই ছাত্রীটি চিৎকার করে বলে উঠে , ‘ওই ধর্ষক ভিসি যায়’ ।
মানুষ ফেরেশতা নন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের আহমেদেকে যতটা ন্যায়বান মনে করা হয় ততটা তিনি নন বলে আমার বদ্ধমূল ধারণা। তার কাছ থেকে সময় নিয়ে আমরা সমাবর্তনের আয়োজন করেছিলাম অথচ পদে পদে তিনি আমাদের ভুগিয়েছেন। একবার খবর এল তিনি আসবেননা । কারন বহুদিন আগে কোনোএক সাপ্তাহিকে তিনি পড়েছিলেন জাবির এক কর্মচারী যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত । ওর বিচার কি হয়েছে জানতে চান। তার উত্তর আমরা দেই। তারপর, নানা বাহানায় তিনি আমাদেরকে সন্ত্রস্ত রাখেন। আজ এটা তো কাল ওটা । সবশেষে যে জঘন্য কাজটি তিনি করেছেন তার তুলনা হয়না। গণতন্ত্রের লেবাসধারি এই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ২০০১ সালের নির্বাচনের পর তিনজন নির্বাচিত উপাচার্যকে ৩০০ বছরের পুরনো এক ধারায় সরিয়ে দিয়ে তৎকালীন সরকারকে তুষ্ট রেখেছিলেন।বঙ্গভবন থেকে বেড়িয়ে যাবার মাত্র কদিন আগে তিনি এই কুখ্যাত কর্মটি না করলেও পারতেন।
সমাবর্তনের একদিন পর মাঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ হবার কথা । পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এই খেলা দেখার জন্য পায়ের উপর কিন্তু সারা মাঠে গর্তের জন্য সৃষ্ট সংকটে বিসিসিবি বাগড়া দিয়ে বসলো। অগত্যা, সারারাত ধরে বহু কর্মী দিয়ে গর্ত পূরণ করা হয়। পরের দিন পরিদর্শক এসে মাঠ খেলার উপযোগী বলে সায় দেন। খাইরুল ইসলাম খান, আব্দুর রাজ্জাক, মাহাবুবুর রহমান, সেফায়েত উল্লাহ, প্রমুখ সহকর্মীর কাছে আমি ব্যাক্তিগতভাবে ঋণী ।
নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরের দিন থেকে আমি ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার ।আমরা মানসিকভাবে নতুন ভিসিকে স্বাগত জানাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। রেজিস্ত্রারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি আসামাত্রই যেন আমাকে জানানো হয় যাতে নতুন ভিসির হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারি। এটা এখানকার ট্র্যাডিশন, পরম্পরা।
টিভি স্ক্রিনে চোখ পড়তেই আক্কেলগুড়ুম – রাত নটায় আমি উপাচার্য ভবনে বসে আছি অথচ রাত নয়টায় ভিসির অফিসে চেয়ারে বসে গেছেন মহামান্য নতুন উপাচার্য । কি আর করা, মনে মনে চণ্ডীদাসের চরণ আওড়াই -
সই! কেমনে ধরিব হিয়া?
আমার বঁধুয়া, আন বাড়ি যায়,
আমার আঙিনা দিয়া!
অর্থনীতি বিভাগে ফিরে এলে উচ্চতর শিক্ষা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পাই। এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রির ব্যাপারে এই কমিটি কাজ করে। একদিন দেখি একটি মেয়ে আমার রুমের দরজার ফাঁকে উঁকিঝুঁকি মারছে; ঢুকবে কি ঢুকবে না এ নিয়ে ইতিউতি লখ্য করি। ‘কে ওখানে’- বলে দরজাটা খুলতেই দেখি সেই মেয়েটি ‘ধর্ষক ভিসির’ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে । এমফিলে ভর্তি হতে চায়। আমি তাকে উপদেশ দিলাম পিএইচডি তে ভর্তি হবার জন্য এবং কিভাবে তাও বাতলে দিলাম । অনেক দিন পরে জেনেছি মেয়েটির দীর্ঘদিনের বয় ফ্রেন্ড তাকে পরিত্যাগ করেছে বলে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং জীবনের নানা জটিলতার জালে আটকা পড়ে গেছে।
মেয়েটিকে খুব মনে পড়ে।
সুত্র অধ্যাপক আব্দুল বায়েস
সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আশুলিয়া,সাভার ঢাকা
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৫০:২৮ ১৩৭৪ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bangladesh news #bd news #daily newspaper #World News