্বঙ্গ-নিউজ ডটকম: সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডে খুনিরা এখনও শনাক্ত হয়নি। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের পর দেড় বছর পার হলেও হত্যারহস্যের জট কবে খুলবে_ এমন প্রশ্নের ব্যাপারে সঠিক কোনো উত্তর আপাতত নেই।তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এখন অপেক্ষা করছেন, সাতজনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার। হত্যারহস্য উদ্ঘাটনে এসব নমুনা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায় এ হত্যা মামলার তদন্ত সংস্থা র্যাব। এতদিন পার হলেও খুনিরা শনাক্ত না হওয়ায় স্বজনরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
এদিকে দারোয়ান হুমায়ুন ওরফে এনামুলকে গ্রেফতারে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্যতম সন্দেহভাজন হিসেবে চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি তাকে গ্রেফতার করে র্যাব।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে এনামুলকে গ্রেফতারের তিন মাসের বেশি সময় পার হলেও পুরস্কারের টাকা এখনও পায়নি র্যাব। জানা গেছে, পুরস্কারের টাকার ব্যাপারে কথা রাখেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
র্যাবের নির্ভরযোগ্য সূত্র বলেছে, সাগর ও রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাদের বাসভবনের দারোয়ান হুমায়ুন ওরফে এনামুলকে প্রথম থেকেই সন্দেহ করা হয়েছিল। ঘটনার পর ডিবির হাতে একবার গ্রেফতারের পর আত্মগোপনে থেকে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আরও সন্দেহ তৈরি করে এনামুল।
যদিও র্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর তার কাছ থেকে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি বলে দাবি করছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র।
সন্দেহের আট ‘আসামি’ কারাবন্দি :সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া আটজন বর্তমানে কারাবন্দি।
তারা হলেন_ রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাঈদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ, দারোয়ান এনামুল, সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও সাংবাদিক দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান। গ্রেফতার হওয়া প্রথম পাঁচজনই গত বছরের আগস্টে রাজধানীর মহাখালীতে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নিতাই হত্যার মামলার আসামি।
র্যাব বলছে, গ্রেফতার হওয়া সাতজনের সঙ্গে ঘটনাস্থলে পাওয়া আলামতের মিল পাওয়া যায়নি। এমনকি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর দারোয়ান এনামুলও সাগর-রুনি হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে।
সাতজনের ডিএনএ নমুনা যুক্তরাষ্ট্রে : সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে এখনও শনাক্ত করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। কারা, কেন, কী কারণে সাগর-রুনিকে নৃশংসভাবে খুন করেছে_ এমন কোনো প্রশ্নের উত্তরও মেলেনি। সন্দেহের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সাগর-রুনি হত্যা মামলা।
হত্যারহস্য উদ্ঘাটনে র্যাব ১২৭ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এর আগে ডিবি ও থানা পুলিশ শতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো আলামতের নমুনা থেকে র্যাব দু’ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ বৃত্তান্ত পেলেও তাদের খোঁজ মেলেনি।
এমনকি হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া সন্দেহভাজন আট ব্যক্তিসহ আরও ১৬ জনের ডিএনএ নমুনা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। ইতিমধ্যে ৯ জনের ডিএনএ নমুনার প্রতিবেদন র্যাবের হাতে এসে পেঁৗছেছে। তাদের কারও সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ পাওয়া ওই দুই ব্যক্তির ডিএনএ নমুনার মিল নেই।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি। ১২ ফেব্রুয়ারি সকালে ওই বাসা থেকে পুলিশ তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে। ওই দিনই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারের ঘোষণা দেন।
এ ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে ডিবি। তবে সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২তম দিনে ব্যর্থতা স্বীকার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর হাইকোর্টের নির্দেশে মামলাটির তদন্ত শুরু করে র্যাব।
স্বজনরা হতাশ : গতকাল মঙ্গলবার সাগর সরওয়ারের পুরনো ঢাকার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন তার মা সালেহা মনির। পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন আমার কারও বিরুদ্ধে কিছু বলার নেই। একমাত্র ছেলে হারানো মা-ই শুধু বুঝতে পারে, সে কী যন্ত্রণা নিয়ে বসবাস করছে।
সাগর বেঁচে থাকতে মাঝে মধ্যে দুপুরে সে বাসায় আসত। তারপর একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসতাম। এখনও আমার মনে হয়, এই বুঝি সাগর এসে দরজায় দাঁড়াবে_ অচেতন মনে আমি গিয়ে দরজায় দাঁড়াই, ছেলের অপেক্ষা করি।’ কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
সমকালের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘দেড় বছর পার হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত জানা গেল না, কারা হত্যার সঙ্গে জড়িত। মাঝে মধ্যে র্যাবের কর্মকর্তারা ফোন করে খোঁজ-খবর জানতে চান। কিন্তু আমি তাদের কী জানাব? আমি নিজেই তো তাদের কাছে খোঁজ জানতে চাই। ঘাতকরা ধরা পড়ল কি- না জানতে চাই।’
সালেহা মনির ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা কেন, কী কারণে হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করতে পারছে না, তাও আমাদের জানাচ্ছে না। যদি তারা ঘাতকদের শনাক্ত করতে না পারে তবে আমাদের বলুক আমরা বিচারের আশা ছেড়ে দেব।’
তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, সাগরের বাসায় কোনো চোর ঢোকেনি। এখন চোরের গল্প বানানো হচ্ছে। ডিএনএ পরীক্ষার নামে সময়ক্ষেপণ করে আসল অপরাধীদের আড়াল করা হচ্ছে।
রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, প্রথম থেকেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করে যাচ্ছি। মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাব ডিএনএ পরীক্ষার নামে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রেখেছে। র্যাবের কাছে মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তাদের এক কথা_ কোনো অগ্রগতি নেই। এখন আর মামলা সম্পর্কে কোনো কিছু জানতে চাইতে ইচ্ছা করে না।
নওশের বলেন, কয়েকদিন আগে র্যাব সদস্যরা আমাদের দুই ভাইয়ের ডিএনএ নমুনা নিয়েছে। আমরা বুঝতে পারছি না, আমাদের ডিএনএ নমুনা কেন নেওয়া হলো। তবুও হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের আশায় ডিএনএ নমুনা দিয়েছি।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের এএসপি জাফর উল্লাহ রুনির মায়ের ফার্মগেটের বাসায় যান। জাফর উল্লাহর কাছে তখন মামলার তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চান রুনির ভাই নওশের আলম রোমান।
উত্তরে জাফর উল্লাহ জানিয়েছেন, বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। এখনই এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি জানানো যাবে না। এ ছাড়া সন্দেহভাজনদের ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলও এখনও র্যাবের কাছে পেঁৗছেনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:৩২:৫১ ৪৪৩ বার পঠিত