বঙ্গ-নিউজঃ আমি ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব নেবার পর ক্যাম্পাস জুড়ে কানাঘুষা শুরু হয় । এমনকি মহিলা মহলেও । সেই সময়ের ভাবীগণের কাছে পতি ছিল পরমেশ্বর – স্বামীর দলকে অন্তত মহিলা মহলে জিতিয়ে আনতে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা । কেউ কেউ আবার স্বামীর উপদেষ্টাও। গ্রুপের খবর যতটুকু ভাইয়ের কাছে, তার চেয়ে বেশী ভাবীর কাছে থাকতো।
বিষয় ছিল আমার ভবিষ্যৎ । আমি কি আগামি তিন মাস নির্বাচন পর্যন্ত আছি, নির্বাচিত হয়ে পুরো টার্ম পার করবার পায়তারায় করছি না অগণতান্ত্রিক পথে পথ আগলে থাকার প্রয়াস নিচ্ছি । এই ধরণের চিন্তা কারো আরামের ঘুম হারাম করে দিতে লাগলো। । পথেঘাটে সালাম জুটতো ওই কায়দাতেই। যারা মনে করতেন আমি তিন মাসের বৈরাগী অন্নকে বলছি ভাত, তারা মুখ না তুলেই সালাম দিয়ে কেটে পড়তে চাইতেন; অন্য দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে কুশলআদি বিনিময় করতেন । অপরপক্ষে, যারা ভাবতেন আমি ভিসি চেয়ারে বসেছি বসার জন্যই তারা লম্বা সালাম দিতেন; হ্যান্ডসেক করার নামে অনেকক্ষণ ধরে হাত ঝাঁকাতেন – ব্যাথা পাচ্ছি কি পাচ্ছিনা সেই দিকে কোন খেয়াল নেই । যাই হোক ,সকল প্রশাসকের জন্য একটা ‘হানিমুন’ পিরিয়ড থাকে । সে সময় এমনকি শত্রুপক্ষও ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি মেনে নেয় । আমার হানিমুন পিরিয়ড যে দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে তা আজাদ ও সালাম সাক্লায়েন বিভিন্ন ঘটনা ও রটনার উপাত্ত দিয়ে সমঝাত ।
ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসাবে প্রথমবারের মতো জাবিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করার সুবর্ণ সুযোগটি ঘটেছিল । নিঃসন্দেহে স্বর্ণের আখরে লিখা থাকার কাজ। সেখানেও দেখি ঝামেলা – কে মিছিলের নেতৃত্ব দেবে এবং কিভাবে দিবে । গরিবের বউ যেমন সবার ভাবী, ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যও তেমনি । আমি তৎকালীন কোষাধক্ষ ড: শরীফ এনামুল কবিরকে নিয়ে অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে প্রশাসন চালাচ্ছিলাম। যতদূর মনে পড়ে আমির হোসেন খান, ইমামউদ্দিন, আবু সাইদ খান, সলিমুল্লা খান, আতিকুর রহমান, আনু মুহম্মদ, আমির হোসেন, নইম সুলতান, শামসুল আলম সেলিম, নাসিম আক্তার হুসেইন প্রমুখের সাথে সর্বক্ষেত্রে সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করে আলাপ করেছিলাম। খুশীর খবর যে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সর্বদলীয়ভাবে উদযাপিত হয়েছিল।
সেই সময় জাবির ইতিহাসের পাতায় এও লেখা হল যে জাবির উপাচার্য হিসাবে ৪০ বছর পর আমি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সভাপতি হলাম। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সভাপতি হতে হলে প্রায় ৬০ বছর কিংবা তারও বেশী সময় অপেক্ষা করতে হবে! আমার সভাপতিত্বের সময়ে আন্ত-বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অলিম্পিকস-এর সূচনা ঘটে। অন্যদিকে, সহকর্মীদের সাথে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেই প্রতিবছর জাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালন করার। সেই থেকে ১২ জানুয়ারী জাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিবস বা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালিত হয়ে আসছে। জাবিকে অনুকরণ করে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েরও জন্মদিন পালন করা শুরু হয়।
আমার দায়িত্ব গ্রহণকালে জাবির সেশন জ্যাম ছিল তুঙ্গে। আমরা বিকেলে ক্লাস নেবার সিদ্ধান্ত নিলাম । প্রথমবর্ষের ছাত্র/ছাত্রী যাতে ঢাকা থেকে আসতে পারে সেজন্য বিআরটিসিকে অনুরোধ করে দোতলা বাসের ব্যবস্থা করা হলো। দুতলা বাস দেখতে ছুটে আসতো স্কুলকলেজের ছেলেমেয়েরা । যেন গরিবের বাড়িতে হাতির পা পড়েছে। ইউজিসির কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থের যোগান দেয়া হলো যাতে শিক্ষকদের অতিরিক্ত পরিশ্রমের পারিশ্রমিক দেয়া যায় । সাড়া ক্যাম্পাসে সোডিয়াম লাইট বসানোর ব্যবস্থা করা হলো।
এরিমধ্যে তিন মাসের মাথায় অনুষ্ঠিত সিনেট নির্বাচনে সর্বাধিক ভোটে জিতে নির্বাচিত উপাচার্য হিসাবে চেয়ারে বসলাম। প্রো-উপাচার্য আমার বন্ধু তাজুল ইসলাম ও কোষাধ্যক্ষ ড: শরীফ এনামুল কবির। মনে পড়ে, ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডকে অনুরোধ করে অনুর্ধ্ব-১৯ আন্তর্জাতিক ম্যাচের একটা খেলা জাবি মাঠে নিয়ে আসলাম। এখানে পা ফেললেন বিখ্যাত ক্রিকেটার ও ভাষ্যকার রবীশাস্ত্রী, নাসিমুল গণি প্রমুখ। তাছাড়া, আমার সময়ে প্রথমবারের মতো দেশের নির্বাচিত কোনো প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) ক্যাম্পাসে এসে জাবি জনগোষ্ঠীর সামনে ভাষণ দিয়েছিলেন। আমি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছেও কৃতজ্ঞ।
মাঝে-মাঝে উপাচার্যের অফিসে বসে শুনতে পেতাম পিলে চমকানো সব শ্লোগান- ‘প্রশাসনের চামড়া তুলে নেব আমরা’। সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের উদ্ধত্য আচরণ না মানলেই গগনবিদারী শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হত- ‘এক কথা এক দাবি ভিসি তুই কবে যাবি’। এগুলু ছিল আমার বমি বমি ভাব ও চুনা ঢেকুরের প্রধান কারণ । দলে দলে মারামারির চেয়ে দলের ভেতর মারামারি সামাল দিতে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। রাতবিরাতে প্রকটর অজিত কুমার মজুমদারের বাসায় গিয়ে হাঁপাতেহাঁপাতে হাতপা ছেড়ে বসে পড়তাম । সদা হাসি মুখের ছাত্রলীগ নেতা মেহেদি জামিল ও সৈকত অত্যন্ত ভাল ছিল বলে সেই যাত্রায় কিছুটা হলেও রক্ষা । সকল ছাত্র সংগঠনের নেতা-নেত্রিদের শর্তহীন সমর্থনও আমার চলার পথ সুগম করেছিল।
আমার ছোট মেয়ে সেই সময়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী এলিজার বড় সখ ছিল ছাত্র-ছাত্রীরা তার বাবার বাড়ি ঘেরাও করুক। ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিল দেখলেই উত্তেজিত হয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করত ‘আচ্ছা বাবা ওরা তোমাকে ঘেরাও করবে না?” ‘কেন’? আমি জানতে চাই। ‘ঘেরাও অবস্থায় তোমাকে কেমন লাগে তাই দেখতে চাই’। আমি বিড়বিড় করে বলি, মা রে, ‘ fun to you, foul to me’।
জাবির শিক্ষক রাজনীতির প্রকৃতি ছিল অভাবনীয় কিন্তু অনুকরণীয় নয়। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ শিক্ষকদের মিশ্র প্যানেলে ভোটাভুটি হত । আওয়ামী ভিসির বড় শত্রু বিএনপি নয়; বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ। তেমনি বিএনপির বেলায় । সুতরাং, শত ষড়যন্ত্রেরে মুখেও একজন ভিসির বন্ধুহীন হবার অথবা পড়ে যাবার সম্বাভনা খুব কম ছিল । শুধু তাই নয়, কেউ কেউ আবার শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়ার কাছে দল ভারী দেখানোর জন্য অন্যদলের নামগোত্রহীন সমর্থক টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলত ।
সময়টা সম্ভবত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০১ ।
আঠার কি উনিশ মাস বাঁচা –মরা লড়াইয়ে লিপ্ত আমি । একদিন একটা গ্রামে যাবার আমন্ত্রন পেলাম। গ্রামটি যমুনা নদির গর্ভে গড়ে উঠা – নাম বাঁচামরা। গ্রামের নাম বাঁচামরা কেন কেউ বলতে পারলনা তবে অনুমান করি, আগ্রাসি যমুনায় চর জাগলে মানুষগুলু বাঁচে নয়তো মরে । জীবন ও মৃত্যু একটা নদীর হাতে সমর্পিত বলেই বোধ হয় তার নাম বাঁচামরা।
মানিকগঞ্জ থেকে যন্ত্র নৌকায় যেতে হয় সেই গ্রামটিতে । সহকর্মী মান্নান চৌধুরীর বাড়ি ওখানটায় এবং ওখানকার চেয়ারম্যান তার এলাকার লোকজনকে ভিসি দেখাবেন বলে এত তোড়জোড় আয়োজন করেছেন। নৌকায় বেশ কজন গাদাগাদি করে বসেছি। এর মধ্য একজন প্রবীণ ব্যাক্তি আছেন যিনি আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী ।
‘ আপনি তো নির্বাচনী প্রচারে থাকার কথা , এখন আমাদের সাথে যে?’ – আমি বিনয়ের সাথে বললাম। নৌকার মাচায় পায়ের ওপর পা তুলে তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলেন, ‘সবাই আমারে চেনে ; কারো কাছে আমার যাওয়ার দরকার নেই।‘
‘তার পরেও মানুষের ঘরে ঘরে গেলে ভাল হয়না?’
‘ ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট ভিক্ষা কেন? তারা তো জানেই যে আমি দাঁড়িয়েছি, খামাখা সময় নষ্ট করে কি লাভ‘।
তড়িঘড়ি সংলাপ শেষে যমুনার ছোবলের ছায়া দেখি। যান্ত্রিক নৌকাটি তার স্বভাবজাত শব্দ তুলে বাচামরার দিকে যাচ্ছে । নদীর তীর ভাঙ্গনের শব্দ শোনার সাথে সাথে ওই গানটা মনে পড়ে – ‘নদীর একূল ভাঙে ওকুল গড়ে এইতো নদীর খেলা ‘ । মান্নাদের গাওয়া সেই গানটিও সেদিন মন্দ লাগেনি, ‘ তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড় , তারি মাঝে প্রেম যেন গড়ে খেলা ঘর …’।
নৌকা যত এগোচ্ছে গন্তব্যস্থলের দিকে, ততই ব্যান্ড বাজার শব্দ কানে ভেসে আসে । দেখা গেল সত্যি সত্যি একটা ব্যান্ড পার্টি বিওগল আর ড্রামে রুপবানের গান বাঁজাতে বাঁজাতে ঘাটে এসে হাজির - ‘কিসের লেখা কিসের পড়া গো, ও দাইমা কিছুই ভাল লাগেনা আমার দাইমা দাইমা গো’। । তারা আমাদের সবাইকে সন্মান দিয়ে গ্রামে নিয়ে গেলেন । মিছিলের অগ্রভাগে আমি – বাচামরার সেই মুহূর্তের ‘বর’।
সারাদিন আনন্দ ফুর্তি শেষে সেই রাজনীতিবিদের সাথে নৌকায় উঠি । শুনলাম, এখানে এসেও তিনি কারো কাছে ভোট চাননি ; সমর্থকগণ বলেছে তার অবস্থা নাকি আগের চেয়ে ভাল।
নির্বাচনের রাত্রে ভিসির বাড়িতে নিচের তলায় টিভি নিয়ে হাজির হলেন হান্নান সাহেব । সারারাত সুখবর শুনবো আর সুখাদ্য চলবে । আবার বসবে মেলা হাট তলা , বট তলা । কিন্তু রাত এগারোটা বাজতেই দেখি তিনি বলছেন, শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা; বেশি রাত জাগা ঠিক হবেনা ।
২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল মাত্র বেড়িয়েছে। প্রথম ধাক্কায় আমাদের সাথে যাওয়া সেই নেতার জামানত খোয়া গেছে । হান্নান, রাসেদ, আজাদ – সবাইকে খুঁজেছিলাম কিন্তু কেউ কোথাও ছিলনা সেই মুহূর্তে ।
নির্বাচনের ফল বেরুবার পর সারা দেশে নাচনকোঁদন শুরু হয়েছে এবং ঠিক সেই সময় উপাচার্যের বাড়ি ঘেরাও হয়। নতুন উপাচার্য আসা পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়ার দাবীতে এই ঘেরাও। আমার পরিবার ভীতসন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ল। ছোট মেয়ের ফ্যাকাশে মুখ বলে দিল কারো বাড়ি ঘেরাও কোন ফান নয়, এটা নিতান্তই একটা ফাউল। আমার পাশে আমার সমর্থকরা তো ছিলেনই; এমনকি বিএনপি সমর্থক শিক্ষক মফিজউদ্দিন আহমেদ ও কামরুল ইসলাম টিটু সর্বক্ষণ পাশে থাকলেন। আমি তাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
এই অভাগা দেশে সরকার বদলালে উপাচার্য বদলায়। নিয়তির এই পরিহাস মেনে নিয়ে আমি ফিরে এলাম আমার নিজের নীড়ে ‒ অর্থনীতি বিভাগে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ওম শান্তি!
‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে
ময়ুরের মতো নাচে রে——-,।’
সুত্র অধ্যাপক আব্দুল বায়েস
সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আশুলিয়া,সাভার ঢাকা
বাংলাদেশ সময়: ১০:১১:১০ ১৩১১ বার পঠিত #bangla newspaper #bd news #daily newspaper #world newspaper