বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০১৩ বাস্তবায়ন হলে তিন পাবর্ত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ভূমি সংক্রান্ত জটিলতায় সংঘাত, হানাহানি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।সম্প্রতি, মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদন হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন অনুযায়ী, কমিশনে তিনজন আদিবাসী প্রতিনিধি রাখা হলেও বাঙালি কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি।
সংশোধিত আইন অনুযায়ী, ইতোপূর্বে বাঙালিদের কাছে বন্দোবস্ত দেওয়া জমি নিয়েও নতুন জটিলতা তৈরি হবে। অথচ বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে মোট ১৬ লাখ অধিবাসীর মধ্যে প্রায় অর্ধেক আট লাখের কাছাকাছি অধিবাসী বাঙালি।
আইনটি বাতিলের দাবিতে পার্বত্য জেলাগুলোতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। ৩ জুন মন্ত্রিপরিষদে আইনটি পাস হওয়ার আগের দিন ২ জুন পার্বত্য তিন জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ (পিবিসিপি) ও ‘সমঅধিকার আন্দোলন’।
এর আগে গত ২৭ মে এই আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়ার পর ৩০ মে একই দাবিতে সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। একই দাবিতে তিন পার্বত্য জেলায় গত রোববার থেকে ৭২ ঘণ্টার সর্বাধিক হরতাল কর্মসূচি শেষ হয়েছে। বাঙালিদের পাঁচটি সংগঠন এই হরতালের ডাক দেয়। আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষার একপেশে আইনটি বাতিলের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠছে পার্বত্য জনপদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ সমস্যা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে মূল অন্তরায় হওয়ায় এর সমাধানে সরকার ইতোমধ্যে চারটি ভূমি কমিশন গঠন করে।
কিন্তু ভূমি বিরোধের সমাধান হয়নি। ভূমি কমিশনকে আরো কার্যকরি করতে সরকার ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ এর ১১টি সংশোধনী এনে গত ৩ জুন মন্ত্রিপরিষদে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়।
এ সংশোধনীগুলো মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক প্রস্তাবিত। সংশোধনীগুলো অনুমোদিত হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে এবং ভবিষ্যতে কঠোর কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি-আদিবাসী নির্বিশেষে সবার ন্যায্য ভূমির অধিকার নিশ্চিত করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখার বিষয়টি সর্বশেষ সংশোধনীতে উপেক্ষিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিদ্যমান ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ অনুযায়ী, কমিশনের মোট সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। এর মধ্যে তিনজন সদস্যের পদ আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত এবং অপর দুইজন সদস্যের মধ্যে একজন হলেন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও অপরজন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার বা তার মনোনীত একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার।
এ ক্ষেত্রে কমিশনের বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোতে মোট পাঁচজন সদস্যের মধ্যে আদিবাসীদের জন্য তিনটি সদস্যপদ সংরক্ষিত থাকলেও বাঙালিদের কোনো প্রতিনিধি নেই।
তাছাড়া কমিশনের চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার বাঙালি হবেন এরও কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। সে কারণে বর্তমান বাস্তবতায় যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক বাঙালি, সেখানে ভূমি কমিশনের সংগঠনে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় তাদের ভূমির অধিকার সংরক্ষিত হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
তাছাড়াও সংশোধনী অনুযায়ী, কমিশনের সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও আদিবাসীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এতে কমিশনের বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামোতে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে একদিকে আদিবাসীদের স্বার্থ শতভাগ সংরক্ষিত রাখা এবং বাঙালিদের স্বার্থ উপেক্ষিত থাকার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তাছাড়া ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন এবং রীতির কথা বলা হয়েছে। প্রচলিত আইনে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আদিবাসীদের ভূমি অধিকারের ক্ষেত্রে রীতির কোনো সুনির্দিষ্ট আওতা এবং ব্যাখ্যা নেই।
সে ক্ষেত্রে আদিবাসী সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং বাঙালি প্রতিনিধিত্ববিহীন ভূমি কমিশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রীতি শব্দটির অপব্যাখ্যা এবং অপপ্রয়োগ হওয়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সংশোধনীতে ভূমি কমিশনের কার্যসীমার কলেবর বাড়িয়ে পুনর্বাসিত শরণার্থীদের (ভারতে গিয়ে পার্বত্য চুক্তির পর ফিরে আসা) ভূমি সংক্রান্ত বিরোধের সঙ্গে অবৈধ বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া ভূমি এবং জলেভাসা ভূমিসহ যে কোনো ভূমিকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
এর ফলে, গত চার দশকে বাঙালিদের কাছে বন্দোবস্ত দেওয়া জমির বৈধতা নিয়েও অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা সৃষ্টি হবে এবং যে কোনো ভূমি শব্দটি যুক্ত হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনায় ব্যবহৃত ভূমি অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সূত্র জানায়, তাছাড়া সংশোধিত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০১৩ এর বিধিমালা তৈরির কাজ ভূমি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত হলেও এর খসড়া তৈরির দায়িত্ব পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়েছে।
এতে বিধিমালা তৈরির প্রাথমিক কাঠামোতে বাঙালি এবং আদিবাসী উভয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সমভাবে সংরক্ষণের ব্যাপারে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব প্রেক্ষাপটে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ এর সংশোধনী বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের ভূমির অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ভূমি সংক্রান্ত সংঘাত-সহিংসতা বেড়ে যেতে পারে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মন্ত্রিপরিষদে আইনটি অনুমোদন হওয়ার পর সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের বলেন, “আইনটি সংশোধনে পার্বত্য এলাকা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। সব মহলের বক্তব্য বিবেচনা করেই এই সংশোধনী আনা হয়েছে। এতে পাহাড়ি ও বাঙালি উভয়ে উপকৃত হবেন।”
‘সমঅধিকার আন্দোলন’-এর এক নেতা বলেন, “কমিশনে বাঙালির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। সাংগঠনিক কাঠামো, সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা আছে। এই কমিশন যখন সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা উপজাতীয়দের পক্ষেই যাবে। এই অবস্থায় বাঙালিরা জমি হারিয়ে পথে বসতে বাধ্য হবেন।”
তিনি বলেন, “এত কিছুর পর আবার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব দুজনেই উপজাতি সম্প্রদায়ের লোক।”
বাংলাদেশ সময়: ৮:০৬:৫১ ৪৬৮ বার পঠিত