বঙ্গ-নিউজঃ বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় দিবস আজ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বাণী দিয়েছেন।
পৃথক বাণীতে তারা দেশবাসীকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন অগণিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদের আত্মত্যাগের কথা।
রাজধানী ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত উদযাপিত হবে দিনটি। জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতাকে।
আজ সরকারি ছুটি। সকালে ঢাকার তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দর এলাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের অনুষ্ঠানমালার সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে।
এ বছর এমন এক সময়ে বিজয় দিবস পালিত হচ্ছে যখন বাঙালির মুক্তির সনদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত করেছে জাতিসংঘ।
১৯৪৭ সালে অবসান ঘটে দুশ বছরের ঔপনিবেশিক শোষণের। কিন্তু ইংরেজ চলে গিয়ে নতুন প্রভু হিসেবে আসে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। তারা আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ভাষার ওপর একের পর এক আঘাত হানে। অর্থনৈতিকভাবেও পূর্ববাংলার জনগণের ওপর চলে শোষণ। এর প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন করেছে বাঙালি, করেছে ৬ দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেলেও সরকার গঠন করতে দেয়নি পশ্চিম পাকিস্তানিরা। বরং চলতে থাকে নির্যাতন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেন এবং প্রকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আলোচনার নামে সময় ব্যয় করে ২৫ মার্চ রাতে অতর্কিত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। দেশজুড়ে শুরু হয় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের তা-ব। বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। বন্দি হওয়ার আগেই তিনি সংক্ষিপ্ত বার্তায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
এর পরের ইতিহাস বাঙালির প্রতিরোধের ইতিহাস। মুজিবনগর সরকার গঠন হয়, গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং পূর্ববাংলার পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এতে যোগ দেন। অন্যদিকে পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে জামায়াতে ইসলামী, রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও শান্তি কমিটির বিশ্বাসঘাতক কিছু মানুষ। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ ও সম্মুখযুদ্ধের সামনে পাকিস্তানিরা পরাজিত হতে থাকে। ডিসেম্বরে গঠিত হয় ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনী। যৌথবাহিনীর আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে শত্রুরা। কিন্তু পরাজয়ের আগে তারা শেষ আঘাত হিসেবে হত্যা করে বাংলার প্রধান বুদ্ধিজীবীদের। ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশে ওড়ে লাল-সবুজ পতাকা।
বিজয় দিবসের নানা কর্মসূচি
আজ সরকারি ছুটি হলেও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। হাসপাতাল, কারাগার ও এতিমখানাগুলোয় পরিবেশন করা হবে উন্নত মানের খাবার। বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে সংবাদপত্রগুলো। এ ছাড়া বেতার ও টিভি চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে।
এদিকে ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিবসের সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে একাত্তরের বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে সকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে এবং স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।
এর পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
ঢাকায় অবস্থান করা বিদেশি কূটনীতিক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর আমন্ত্রিত সদস্যরা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। সকাল ১০টায় তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সম্মিলিত বাহিনীর বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমভিত্তিক যান্ত্রিক বহর প্রদর্শনী হবে। রাষ্ট্রপতি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করবেন। প্রধানমন্ত্রীও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমীসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করবে।
আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারা দেশের সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। ভোর ৬টা ৩৪ মিনিটে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন। সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। সকাল ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। বিকাল ৩টায় বিজয় শোভাযাত্রা সহকারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত হয়ে শিখা চিরন্তনে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ধানম-ি ৩২ নম্বর অভিমুখে বিজয়র্যালি শুরু হবে। ১৭ ডিসেম্বর বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ সময়: ১২:০০:১৭ ১৮১১ বার পঠিত