খুব কাছ থেকে দেখেছি সেলিনা পারভীনের মৃত্যু !
Home Page » এক্সক্লুসিভ » খুব কাছ থেকে দেখেছি সেলিনা পারভীনের মৃত্যু !বঙ্গ-নিউজঃ দেলোয়ার হোসেনের বয়স তখন ২৮। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ। গ্রিনল্যান্ড মার্কেন্টইল কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবরক্ষক হিসেবে চাকরি করছেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শান্তিবাগের বাসা ছেড়ে চলে যান কুমিল্লায় সীমান্তঘেঁষা গ্রামের বাড়িতে। চার ভাইয়ের সঙ্গে তিনি ভারতে গিয়ে মেজর সালাউদ্দনের কাছে যুদ্ধের প্রশিক্ষণও নেন।
মে মাসে ঢাকায় ফেরেন দেলোয়ার। চাকরিও করতেন। মুক্তিযুদ্ধে গোয়েন্দার কাজও চালিয়ে যেতেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে ১৪ ডিসেম্বর সকালে দেলোয়ার হোসেনকে তাঁর ২১৫/১ নম্বর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজে নিয়ে তাঁর ওপর চলে নির্যাতন। সেখানে দেখতে পেয়েছেন শহীদ মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ওপর অমানুষিক নির্যাতন। বরেণ্য এই ব্যক্তিদের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার দৃশ্য।
মধ্যরাতে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয় দেলোয়ার হোসেনসহ প্রায় এক হাজার মানুষকে। সেখানে দেখেছেন দুই আলবদর নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের দানবীয় রূপ। দেখেছেন সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে কীভাবে টেনেহিঁচড়ে মৃত্যুর মুখে ফেলে দেয় বদরনেতা আশরাফুজ্জামান। প্রাণ বাঁচাতে গায়ে মৃত মানুষের রক্ত মেখেছেন দেলোয়ার হোসেন, যাতে শত্রুরা তাঁকে গুলিবিদ্ধ ভাবে। তৃষ্ণায় ছটফট করেছেন এক ফোঁটা পানির জন্য। সুযোগ পেয়েই গভীর রাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তুরাগ নদে। প্রচণ্ড শীতেও কাবু হননি দেলোয়ার হোসেন। আজ বয়সের ভারে ক্লান্ত। একাত্তরের সেই স্মৃতি আওড়ে আজও শিউরে ওঠেন তিনি। তাঁর মুখেই শুনুন সেই মৃত্যুপুরীর রক্তগঙ্গার গল্প:
ঢাকার শান্তিনগরে আমার বাসা। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকালে খুব খিদে পেয়েছিল। ওই সময় শহরে কারফিউ ছিল। ঘরের খাবারও শেষ। এর মধ্যে আমি বাইরে যাই খাবার কিনতে। দোকান সব বন্ধ। বাসায় ফিরে ভাবছি—কী করব। এমন সময় দরজায় শব্দ। উর্দুতে দরজা খুলতে বলা হয়। আমার ঘর টিন ও বেড়া দিয়ে তৈরি। বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা চেষ্টা করি। এমন সময় দরজা ভেঙে দুজন ঘরে ঢুকে পড়ে। আমার হাত ধরে তারা বাইরে নিয়ে আসে। ওরা আশরাফুজ্জামানের নাম ধরে কথা বলছিল। পরে জানতে পারি, আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। সঙ্গীদের আশরাফুজ্জামান আশপাশের অন্য বাসাগুলোয়ও তল্লাশি চালাতে নির্দেশ দেয়। এই দলে থাকা একজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার কাছে আমাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বাইরে দাঁড়ানো একটি মাইক্রোবাসের সামনে আনা হয় আমাকে। মাইক্রোবাসটি ছিল কাদা মাখানো। এটিতে তুলেই আমার চোখ ও হাত বেঁধে ফেলা হয়। প্রথমে মনে হচ্ছিল ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হবে। কিন্তু পরে বুঝতে পারি, অন্য কোথাও নেওয়া হচ্ছে। বাংলামোটর (তৎকালীন পাকমোটর) সড়কের পর আর ধারণা করতে পারিনি যে কোথায় যাচ্ছি। মাইক্রোবাস থেকে নামানোর পর আমিসহ অন্যদের পাকা একটি ভবনের দোতলায় তোলা হয়। দোতলায় নিয়ে ধাক্কা দিয়ে একটি ঘরের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়।
ঘরের ভেতর ঢুকে ক্ষতবিক্ষত অনেকের দেখা মেলে। ধাক্কা মেরে ফেল দিতেই আমি হুমড়ি খেয়ে নরম কিছুর ওপর পড়ি। আসলে তা গাদাগাদি করে থাকা লোকজন। এটিই ছিল মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের দোতলার হলঘর। আমার হাতের বাঁধন এত জোরে বাধা ছিল যে আমি কাঁদতে থাকি। এ সময় খুব পিপাসা লাগে। তখন একটা ছেলে আমাকে বলে, ‘এত জোরে কাঁদলে আপনাকে মেরে ফেলবে।’
আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি কে?’
ছেলেটি বলে, ‘আমি সিএমএইচের এক সার্জেন্টের ছেলে তারেক।’
এরপর আমার হাতের বাঁধন খুলে দিতে অনুরোধ করি ছেলেটিকে। অনেক বলার পর ছেলেটি আমার হাতের বাঁধন খুলে দেয়। এরপর চোখের কাপড় সরিয়ে বন্ধ করা জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে দেখি, আর্মির পোশাক পরা লোকজন ঘুরছে। আমার পাশে থাকা তারেকের হাতের আঙুল ফোলা। লোহার রড দিয়ে আঙুলগুলো থেঁতলানো হয়। মাথায় রক্ত। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, হলরুমে আরও অনেক লোক। একজন আরেকজনের ওপর কাত হয়ে আছেন। কারও চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। কারও চোখ বের হয়ে আছে। অনেকের আবার দুই কাঁধে বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো হয়েছে। পুরো মেঝে রক্তে সয়লাব। এ সময় আমি আমার চোখ ও হাত দুটি এমন করে বেঁধে ফেলি, যেন দেখাও যায়, আবার কেউ বুঝতেও না পারে। আর সুযোগ খুঁজছিলাম পালানোর।
১৪ ডিসেম্বরই দেখা পাই মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে। সন্ধ্যা সাতটার দিকে তাঁদের হলরুমে ঢোকানো হয়। এঁদের মধ্যে পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরা ব্যক্তি ছিলেন মুনীর চৌধুরী। হলরুমে নিয়েই তাঁদের ওপর শুরু হয় নির্যাতন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র ছিলাম। পাশের আর্টস বিল্ডিংয়ে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। সেখানে তাঁকে বহুবার দেখেছি। হলরুমে ঢোকানোর পর রাত আটটার দিকে অস্ত্রধারী ১০-১২ জন লোক আবার আসে। এদের একজন মুনীর চৌধুরীর নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি সাড়া দেন। নাম বলার পর জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু লিখেছেন? জবাবে মুনীর চৌধুরী বলেন, ‘হ্যাঁ, লিখেছি।’
এরপর আরেকজনের কাছে তাঁর নাম জানতে চায়। তখন ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমি মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী।’ তাঁর কাছে একই প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি রবীন্দ্রনাথের ওপর কী লিখেছেন?’
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী লেখার কথা জানান। এর মধ্যে বদরবাহিনীর একজন লোক এসে বলে, ‘আমাদের হাতে সময় কম। ভারতীয় বাহিনী বিমান থেকে বোম্বিং করছে।’
তখন আমি বুঝতে পারি যে আমাদের মেরে ফেলবে। দোয়া পড়তে থাকি। এ সময় মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে লোহার রড দিয়ে পেটাতে থাকে। মুনীর চৌধুরীর মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। তিনি কলেমা পড়তে পড়তে কাত হয়ে পড়ে যান। এরপর বদরবাহিনীর লোকেরা বাইরে যায়। এই ফাঁকে আমি মেঝে থেকে রক্ত শরীর ও পোশাকে মেখে মাথা নিচু করি। কিছুক্ষণ পর মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার মাথায় বাড়ি দেওয়া হয়।
সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের মৃত্যু খুব কাছ থেকে দেখেছি। রাত ১০টার দিকে আমাকে দোতলা থেকে নামিয়ে আবারও বাসে তোলা হয়। বাইরে ২০-২২টি বাস ছিল। সব মিলিয়ে প্রায় এক হাজার লোক বাসগুলোয় তোলা হয়। রায়েরবাজারে দিকে এনে বটতলার সমানে ১৫-২০ জন করে দল করা হয়। রাত তখন প্রায় একটা। সবার বাঁ হাত লম্বা দড়ি দিয়ে বেঁধে ইটভাটির দিকে নেওয়া হচ্ছে। যাঁরা চিৎকার করছেন, তাঁদের গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে। আর যাঁরা চুপ করেছিলেন, তাঁদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। আমি দেখলাম, বেয়নেট দিয়ে মারা হলে কষ্ট বেশি। তাই মৃত্যুর জন্য রাইফেলের গুলিকে বেছে নিলাম। এমন সময় মেয়েদেরও চিৎকার শুনতে পাই। আমার পাশে থাকা এক নারী বলতে থাকেন, ‘তোমরা আমার বাপ-ভাই। আমার একটি ছোট ছেলে আছে। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাব।’
তখন একজন বলল, ‘তোমাকে তো বদরবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। তারপরও তুমি লিখেছ।’
মেয়েটা তখন খুব চিৎকার করছিল। আমার দুপাশে দুজন ছিল। একজন ওই মেয়ের কাছে গেল। তখন মেয়েটি বলল, ‘আশরাফ ভাই, তুমি থাকতে আমাকে মেরে ফেলবে!’ তখন আমার পাশ থেকে অপরজনও মেয়েটির পাশে যায়। এই ফাঁকে আমি পালিয়ে যাই।
পরে জানতে পারি, মেয়েটি হলেন শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। আমি প্রাণ নিয়ে ফিরে আসার পর সেলিনা পারভীনের স্বজনেরা তাঁর ছবি দেখিয়েছিলেন। তখন তাঁকে চিনতে পারি।
পালানোর সময় প্রথমে দুই হাতের বাঁধন খুলি। এরপর চোখের কাপড় খুলে বাঁ হাতের দড়ি শরীরে সব শক্তি দিয়ে খুলে ফেলি। এত জোরে খুলি যে আঙুল ছিলে যায়। বাঁধন খুলে দৌড় দিই বিলের দিকে। কাদা-পানি ঠেলে নদীতে নেমে সাঁতার কাটতে থাকি। এ সময় বদরবাহিনী লোকেরা ‘ধর ধর’ বলে টর্চলাইট দিয়ে দেখতে শুরু করে। আসলে আমি তখন টর্চলাইটের রেঞ্জের বাইরে চলে গেছি। ওরা গুলি ছুড়তে থাকে। কিন্তু আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে গুলি লাগেনি। রাত তখন তিনটা হবে। অন্য পাড়ে এসেও ওঠার সাহস করিনি। বিলের মাঝে সারাটা রাত কাটিয়ে দিই।
পরে বছিলায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখা পাই। আমাকে প্রথমে অনেকে পাগল মনে করে। সবাই জড়ো হয় আমাকে দেখতে। তাই বাধ্য হয়ে বক্তৃতার মতো বলে পুরো ঘটনা বলি। পরে গ্রামবাসীদের দেওয়া চিড়া, পান্তাভাত ও লাউ খেয়ে মনে হয়েছিল—জীবনে আমি এত সুস্বাদু খাবার খাইনি!
এরপর ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় চলে আসেন দেলোয়ার হোসেন। পরদিন দৈনিক বাংলা (তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান) ও বিবিসিতে তাঁর দেখা ঘটনার বিবরণ প্রকাশিত হয়।
নির্যাতনের সেই ধকল আজও সহ্য করতে হচ্ছে জানিয়ে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি চাকরি ঠিকমতো করতে পারিনি। মাথায় সমস্যা হতো। মাঝেমধ্যে রেগে যেতাম। ভুল বকতাম। এই সমস্যা এখনো হয়। আমার স্ত্রী হাফিজা বেগম তেজগাঁও কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর রোজগারে সংসার চলেছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাইনি। এতে কোনো কষ্ট নেই। তবে কষ্ট হয় চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানেরা বহাল তবিয়তে আছেন।’
বাংলাদেশ সময়: ১৩:০৭:২১ ৪৪৭ বার পঠিত #bangaldesh news #bangla news #bangla newspaper #bd news #daily newspaper #world news.bongo-news.com
পাঠকের মন্তব্য
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)এক্সক্লুসিভ’র আরও খবর
এস এস সি পাশের হার কমছে বেড়েছে জিপিএ-৫
শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্রে সানি লিওনের ছবি!
শক্তিশালী প্রসেসরে নতুন স্মার্টফোন বাজারে আনছে মটোরোলা
ভারত ৩৬টি স্যাটেলাইট স্থাপন করল একসঙ্গে !!
স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস, পরে কথিত স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে পদযাত্রা
রাশিয়ার নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সাবমেরিন!
টিকিট দুর্নীতির প্রতিবাদে রনি, সহজ ডটকমকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
ট্রাকচাপায় মেয়েসহ তারা তিনজন নিহত; রাস্তায় গর্ভস্থ শিশু ভুমিষ্ঠ
রোহিঙ্গা যুবক নুর বারেক আটক ,২০ লাখ টাকা উদ্ধার
-
সালাম, আমান, রিজভী, খোকন, শিমুল ও এ্যানিসহ গ্রেফতার শতাধিক
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
ভারতকে হারিয়ে টাইগারদের সিরিজ জয় নিশ্চিত
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ,নিহত ১
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারে ভূষিত ওসমানীনগরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিক
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
বিয়েবর্হিভূত যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ: প্রতিবাদে বিক্ষােভ ইন্দোনেশিয়ায়
মঙ্গলবার ● ৬ ডিসেম্বর ২০২২ -
আড়াইহাজারে অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
মঙ্গলবার ● ৬ ডিসেম্বর ২০২২
আর্কাইভ
Head of Program: Dr. Bongoshia
News Room: +8801996534724, Email: [email protected] , [email protected]