আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন,আমি বাবার সঙ্গে স্কুলে যাবো

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন,আমি বাবার সঙ্গে স্কুলে যাবো
রবিবার, ১০ ডিসেম্বর ২০১৭



ছবি সংগৃহীত

বঙ্গ-নিউজঃ আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি বাবার সঙ্গে স্কুলে যাবো। আমার বাবার সঙ্গে আমি খেলা করবো। বড় হয়ে গেছি, কিন্তু আমার বাবা ফেরত আসে না। বাবা যদি ফেরত না আসে তাহলে আমাকে বাবার কাছে নিয়ে নিন।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর গুম হওয়া যুবদল নেতা পারভেজ হোসেনের ৪ বছরের ছোট্ট মেয়ে হৃদি পারভেজ হোসেন। তখন হৃদির বয়স ছিল দেড় বছর।

রবিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে গুম হওয়া পরিবারদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘মায়ের ডাকে’ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় হৃদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে এই আকুতি জানায়। মাইকে কথা বলার সময় হৃদি যখনই ‘বাবা’ বলছিল তখনই তার গলার স্বর কান্নায় ভিজে যাচ্ছিল। আর সেই ডাক ও কান্না যেন ভিজিয়ে দিচ্ছিল উপস্থিত প্রতিটি মানুষের হৃদয়।

নিখোঁজ, গুম ও অপহরণের শিকার এমন ৩৫ ব্যক্তির পরিবার এই আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছিল। তাদের অনেকের স্বজন গত চার বছরেরও বেশি সময় ধরে নিখোঁজ রয়েছে। সভায় অংশ নেওয়া স্বজনদের অধিকাংশই বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের গুম হওয়া নেতা-কর্মীদের পরিবার।

বাবা পারভেজ হোসেনকে খুঁজে দেওয়ার দাবিতে প্রেসক্লাবে এসে মায়ের পাশে গুমরে কাঁদছে হৃদি

সভায় আসা গুম বা অপহৃতদের স্বজনরা বঙ্গ-নিউজকে বলেন, তারা তাদের অপহৃত পরিবার সদস্যদের ফেরত চান, সন্ধান চান। এজন্য তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

হৃদি তার মা ফারজানা আক্তারের সঙ্গে সভায় এসেছিল। তার মা ফারজানা বঙ্গ-নিউজকে বলেন,পারভেজ যখন গুম হয় তখন হৃদির বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। তখন কিছুই বুঝতো না। এখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে সবার মতো তার বাবা নেই। তবে ওর বাবার কী হয়েছে, কেন সে নেই তা আমি তাকে বলতে পারছি না। কান্না ভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, চার বছর ধরে বাবাকে নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রশ্ন করে যাচ্ছে তার দুই ছেলেমেয়ে। এসব প্রশ্নের কোনও জবাব দিতে পারছি না আমি।’

গুম হওয়া সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুর বোন রেহানা বানু মুন্নি বঙ্গ-নিউজকে বলেন, ‘আজকে চারটা বছর ধরে কেবল আমরাই বুঝি, আমরা কিভাবে যে আছি! আমার মা ঘুমাতে পারেন না, খেতে পারেন না। আমরা তাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বলি, মা, পিন্টু আছে, আসবে। তুমি খাও। আমার মা পথের দিকে চেয়ে থাকে। মাও বিশ্বাস করে পিন্টু ফিরবে। কিন্তু আমরা জানি না, মা কোন বিশ্বাসে পিন্টুর পথের পানে বসে আছে। ইদানিং খুব ভয় হয়। কোন খবর শুনি আবার? আমার মা-বাবা কী আমার ভাইয়ের মুখটি না দেখেই কি দুনিয়া থেকে চলে যাবেন!’

তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, আমার ভাইটি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে। আমার ভাইকে ২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বরে বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারা সরকারি প্রশাসনের লোক পরিচয়ে নিয়ে গেছে। এরপর আমরা র‌্যাব পুলিশ সবখানে আমরা গিয়েছি। জিডি করেছি, মামলা করেছি। বর্তমানে সিআইডি মামলাটি তদন্ত করছে। কিন্তু কোনও অগ্রগতি নেই।’

মুন্নি বলেন, ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাদার অব হিউমিনিটি। আজকের মানবাধিকার দিবসে আমাদের প্রশ্ন, আমাদের চোখের পানি, কান্নার শব্দ কি আপনি শুনতে পান না? আমাদের মানবাধিকার কোথায়? আমরা কার কাছে বিচার চাইবো? আমরা কাকে বলব যে আমাদের ভাইটাকে ফেরত দিন। আমরা আল্লাহর কাছে আবেদন করছি। তার কাছেই বিচার চাই। কারণ, আমাদের পাশে কেউ নেই। আমাদের বিচার চাওয়ার কোনও জায়গা নেই।’

বাবার খোঁজ চায় আরেক শিশু

তারই পাশে বসে ছিলেন গুম হওয়া আব্দুল কাদের মাসুমের (২৩) মা। বুকে ছেলের ছবি আগলে তিনি বলেন, ‘ছেলেটা আমার তেজগাঁও কলেজে ফিন্যান্সে পড়তো। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন তাকে তুলে নেওয়া হয়েছে। আজও খোঁজ পেলাম না। ছেলেটাকে কারা নিলো? এর কি কোনও জবাব কেউ দিতে পারবে না কোনোদিন?’

তার সঙ্গে কথা বলার সময় দেখা গেলো তার পাশেই বসা একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তি। হাতে এক তরুণের রঙিন ছবি। নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার নাম শফিকুর রহমান। তার ছেলে সাইফুর রহমান সজীব নিখোঁজ। তাকে আর পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আমার ছেলেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। আমরা সবার কাছে গিয়েছি, কিন্তু কেউ আমার ছেলেকে ফেরত দিতে পারেনি। আমি আমার ছেলেকে ফেরত চাই।’

এক নিখোঁজের সন্ধান চেয়ে প্রেসক্লাবে তার স্বজন

স্বামীকে ফেরত চাই:

মিনা আক্তার নামে এক নারী তার মেয়ে লামিয়া আক্তার লিয়াকে কোলে নিয়ে নিখোঁজ হওয়া স্বজনদের পরিবারগুলোর মধ্যে বসে ছিলেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার স্বামীর নাম কাওসার হোসেন। পেশায় গাড়িচালক ছিলেন। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর তিনি গুম হন। সন্তান নিয়ে কোনোভাবে ছাত্র পড়িয়ে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।

মিনা আক্তার বলেন, ‘আমি কোনোভাবে সংসার চালিয়ে নিচ্ছি। এরকম আর কত দিন চালাতে পারবো বুঝতেছি না। আমার স্বামীকে আমি ফেরত চাই।’

ওরা সবাই গুম

অপেক্ষায় আরও অনেকেই:

২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গুম হওয়া ঢাকার ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন। একই বছরের ২৮ নভেম্বর গুম হয় খালিদ হাসান সোহেল। একই বছরের ৫ ডিসেম্বর গুম হওয়া আদনান চৌধুরী। তাকে র‌্যাব পরিচয়ে তার বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন তার বাবা। এছাড়াও ২০১৩ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গুম হওয়া ১৯ সদস্য হলেন- সাজেদুল ইসলাম সুমন, জাহিদুল করিম তানভীর, আবদুল কাদের ভূঁইয়া মাসুম, মাজহারুল ইসলাম রাসেল, আসাদুজ্জামান রানা, আল আমিন, এমএ আদনান, কাউসার, সেলিম রেজা পিন্টু, খালিদ হাসান সোহেল, সম্রাট মোল্লা, জহিরুল ইসলাম, পারভেজ হোসেন, মো. সোহেল, মো. সোহেল চঞ্চল, নিজাম উদ্দিন মুন্না, তরিকুল ইসলাম ঝন্টু ও মাহবুব হাসান সুজন।

নিখোঁজ মাহবুব হাসান শুভর ভাই জাহিদ হাসান বঙ্গ-নিউজকে কে বলেন, ‘২০১৩ সালের ৭ ডিসেম্বর আমার ভাইকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। এই ঘটনায় সবুজবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছি। তবে এখনও কোনও সন্ধান কেউ দিতে পারেনি। তার একছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী তানজিনা আক্তার বেঁচে থাকার লড়াই করছে। তার সন্তানকে আমরা বলতে পারছি না তাদের বাবা কোথায়। এর চেয়ে কষ্ট আর কী হতে পারে?’

জাতীয় মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে নিখোঁজদের খুঁজে পেতে সংবাদ সম্মেলন করে মায়ের ডাক

নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে আরও একজন হলেন, কাজী ফরাদ। তার খালাতো ভাই আমান বলেন, মাহবুব হাসান শুভর সঙ্গেই নিখোঁজ হয় কাজী ফরাদ। এরপর তার আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।

এছাড়াও সাবেক রাষ্ট্রদূত, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক উৎপলসহ গত চার মাসে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে রহস্যজনকভাবে ‘নিখোঁজ’হন ১৪ জন। এদের মধ্যে আট জন ফিরেছেন। বাকি ছয় জনের এখনও সন্ধান মেলেনি। উৎপলের বাবার মতো অন্য নিখোঁজ পাঁচ ব্যক্তির বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বোন ও স্বজনরা এভাবে তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন। অসহায় স্বজনরা বলছে, অপেক্ষা ছাড়া তাদের কিছুই করার নেই। কারণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিখোঁজদের বিষয়ে কিছুই জানাতে পারছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এরকম চলতে পারে না। রাষ্ট্রের কাছেই আমরা এর বিচার চাইবো। জানতে চাইবো, নিখোঁজ ও গুম হওয়া মানুষের কী ঘটেছে।’

বাংলাদেশ সময়: ১৯:১২:০২   ৬১১ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আজকের সকল পত্রিকা’র আরও খবর


নেতাকর্মীদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন হাজী মোহাম্মদ হারিজ খান
সেরে উঠলেন ক্যানসার রোগীরা
আশুলিয়ায় খুশবু রেস্তোরাঁ উদ্বোধন
ধর্মপাশায় ১০ম গ্রেড বাস্তবায়নের দাবিতে শিক্ষকদের কর্মসূচী
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা ও কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে কৃষি পণ্য সরবরাহ
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা ও কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে কৃষি পণ্য সরবরাহ
বিশ্বব্যাপী প্রবাসীদের প্রতি দায়িত্ব পালনে কূটনীতিকদের আন্তরিক হতে হবে: শেখ হাসিনা
শেখ রাসেলের ৫৮ তম জন্ম বার্ষিকী ও জাতীয় ইদুর নিধন
শেখ রাসেলের ৫৮ তম জন্ম বার্ষিকী ও জাতীয় ইদুর নিধন

আর্কাইভ